Monday, December 23
Shadow

ফক্কা- সিজার বাগচীর গল্প

গল্পরাত আটটা পাঁচে যে লোকাল ট্রেনের হাওড়া স্টেশন থেকে ছাড়ার কথা, সেই ট্রেন একগাদা যাত্রী নিয়ে হাওড়ায় এসেই ঢুকল আটটা পনেরোয়। প্ল্যাটফর্ম জুড়ে তখন তুমুল হইচই। ট্রেন দেরি করায় পরের গাড়ির কিছু প্যাসেঞ্জারও এসে পড়েছে।

অনির্বাণ একবার তাকিয়ে দেখল চারপাশে থিকথিক করছে লোক। ট্রেন এসে থামতেই কামরা থেকে গলগল করে যাত্রী নামতে লাগল। আর যে মানুষজনেরা এতক্ষণ ধরে এই ট্রেনের অপেক্ষায় ছিল, তারাও একই সঙ্গে ওঠার চেষ্টা করতে থাকল। শুরু হল প্রবল হুড়োহুড়ি। ধাক্কাধাক্কি। অনির্বাণও শামিল হল তাতে। এক দল ট্রেন থেকে নামার জন্য ঠেলছে। অন্য দল ট্রেনে ওঠার জন্য ঠেলছে। সমুদ্রের ঝোড়ো ঢেউয়ের মতো আশপাশের লোকজনের ঠেলায় অনির্বাণ একবার এগোচ্ছে। আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। এমন গুঁতোগুঁতি করতে-করতে ওর আফসোস হল, কলেজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তীর্থার টান এড়াতে না পেরে কফি হাউসে আড্ডা দেওয়াটাই ভুল হয়েছে। দেরি না-করলে এই ভিড়ের মধ্যে ওকে পড়তে হত না।

এইভাবে ঠেলাঠেলি করে কামরায় উঠেই অনির্বাণ দেখল প্ল্যাটফর্মের দিকের জানলার ধারে একটা সিট খালি। বাকি যাত্রীরা জলের স্রোতের মতো উঠছে। তবু অনির্বাণ এক লাফে গিয়ে ওই সিটে বসে পড়তে পারল। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওর আশপাশের সব সিট ভরে গেল। মায় মুখোমুখি দুই সিটের মাঝের যে জায়গা সেখানেও গাদাগাদি করে মানুষজন দাঁড়িয়ে পড়েছে। গোটা কামরায় একটা আলপিন রাখার জায়গাটুকুও নেই।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল অনির্বাণ। কপাল জোরে জানলার ধারে সিট পেয়েছে। এই গরমে ট্রেন ছাড়লে হাওয়া পাওয়া যাবে। সিটে এলিয়ে বসে ও মোবাইল বের করে ইন্টারনেট অন করল। ফেসবুক খুলল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ওর উলটো দিকের সিটে বসে থাকা লোকটা ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। লোকটা প্রথমে নিজের পকেট হাতড়াল। কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে তাতে আঁতিপাতি করে কিছু খুঁজল। না পেয়ে সিটের তলা দেখবে বলে নিচু হতে গেল।

লোকটার ছটফটানিতে আশপাশে অনেকেই বিরক্ত হচ্ছিল। একে এত ভিড়! তার উপর যদি একজন এভাবে নড়াচড়া করে অসুবিধে তো হবেই। অনির্বাণের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা টাকমাথাওয়ালা এক ভদ্রলোক আর থাকতে না-পেরে বললেন, “কী হচ্ছে কী ভাই! ঠিক করে বোসো।”
সিটের তলায় উঁকি দিয়ে গিয়ে লোকটা থামল। ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। বলল, “আমার নতুন মোবাইল… পরশু কিনেছিলাম…”

অনির্বাণ ফেসবুক থেকে মুখ তুলল। লোকটার কাছাকাছি থাকা যাত্রীরাও ঘুরে দেখল। একজন জানতে চাইলেন, “কোথায় রেখেছিলেন?”

“বুক পকেটে,” লোকটা একইভাবে বলল, “স্টেশনে এসে একটা ফোন এল… কথা বলতে-বলতে ট্রেন ঢুকল…”

“অমনি তুমি বুক পকেটে মোবাইল রেখে এই ভিড়ে ট্রেনে উঠলে,” টাকমাথাওয়ালা ভদ্রলোক হাসলেন, “কত দাম ছিল?”

“সাড়ে ষোলো হাজার,” লোকটা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল।

“এত দামি মোবাইল কেউ ওইভাবে নেয়? নির্ঘাত কোনও পকেটমার তুলে নিয়েছে,” ভিড়ের ভিতর থেকে একজন বলে উঠল।

সেই কথার জেরে আর-একজন বলল, “আরে মশাই হাওড়া লাইনের সব স্টেশনে পকেটমারদের গ্যাং ঘুরে বেড়াচ্ছে। বছরদশেক আগে শেওড়াফুলি স্টেশন থেকে আমার ছোটভাইয়ের মানিব্যাগ তুলে নিয়েছিল। আমার ভাইও ছিল তেমনই ইন্টেলিজেন্ট। এই এর মতো বোকা নয়। ও মানিব্যাগে দশ টাকা রেখে বাকি টাকা সামনের পকেটে রেখেছিল।”

“আপনার ভাইয়ের কেস তো দশ বছরের। গত মাসে আমার কাকিমার ব্যাগ থেকে পার্স তুলে নিয়েছিল,” অন্য এক যাত্রী মন্তব্য করল, “কাকিমার ব্যাগের ভিতরে চেন দেওয়া খোপে পার্স ছিল। ভাবুন, কখন পরপর দুটো চেন খুলেছে কাকিমা টেরও পাননি। ব্যাটাচ্ছেলে শুধু পার্স বের করেই থামেনি। চেন দুটো আবার আগের মতো আটকে সরে পড়েছিল। বাসে উঠে টিকিট কাটতে গিয়ে কাকিমা টের পেয়েছিল ট্রেনে কেউ পার্স তুলে নিয়েছে…”

“আপনার কাকিমা বুঝল কী করে পার্সটা ট্রেনেই তুলেছে? বাসেও তো তুলে থাকতে পারে!”

অনির্বাণ দেখল দু’জন অচেনা মানুষ এক অদেখা কাকিমা এবং তাঁর হারিয়ে যাওয়া পার্স নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। আর এদিকে ওর উলটো দিকের লোকটা আবার নিচু হয়ে যাত্রীদের পা সরিয়ে-সরিয়ে নিজের মোবাইল খুঁজছে। লোকটার চেহারা দেখলে বোঝা যায়, এমন একজনের কাছে ষোলো হাজার টাকার মোবাইল হিরের নেকলেসের মতো দামি। খারাপ লাগল অনির্বাণের। ওর নিজের কুড়ি হাজার টাকা দামের ঝকঝকে মোবাইল ফোনটাও গত মাসে কেনা। হতেও তো পারত পকেটমার ওই লোকটার বদলে ওর মোবাইলটাই তুলে নিয়েছে। অত ভিড় ঠেলে ওঠার সময় কি মোবাইল, মানিব্যাগের দিকে খেয়াল রাখা যায়?

থাকতে না-পেরে অনির্বাণ বলল, “আপনার নম্বরটা বলুন তো!”

লোকটা একবার ওর দিকে তাকাল। তারপর গড়গড় করে নিজের মোবাইল নম্বর বলতে থাকল। নিজের মোবাইল থেকে অনির্বাণ ওই নম্বরে ফোন করল। ইন্টারনেট অন করা। তাই ট্রু কলারে একটা নামও ভেসে উঠল, ‘সন্তোষ’।

অনির্বাণ প্রশ্ন করল, “সন্তোষ কার নাম?”

“আমার। সন্তোষ ভৌমিক,” লোকটা বলল, “ফোন কি বাজছে?”

অনির্বাণ মোবাইল কানে দিয়ে অপরপ্রান্তে রিং শুনতে পেল। মাথা নেড়ে ও বলল, “বাজছে।”

সন্তোষ এবার চারপাশ ভালভাবে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও মোবাইল বাজার কোনও শব্দ পাওয়া গেল না।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা টাকমাথাওয়ালা ভদ্রলোক বললেন, “আহা, ফোনটা যে সিটের আশপাশে পড়েছে তা ধরে নিচ্ছ কেন? কামরার দরজার কাছেও তো পড়তে পারে!”

সন্তোষ উদ্‌ভ্রান্তের মতো ট্রেনের দরজার দিকে এগোতে লাগল। আর সেই সুযোগে টাকমাথাওয়ালা ভদ্রলোক ঝুপ করে সন্তোষের সিটে বসে পড়লেন। মুখে তৃপ্তির হাসি। অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ট্রেনটা বড্ড দেরি করছে। একে দেরিতে এল। তারপর ছাড়ার নাম নেই। এই করে-করে রাজ্যটা গোল্লায় গেল।”

অনির্বাণ কোনও জবাব দিল না।

ওদিকে সন্তোষ প্রবল ভিড় ঠেলে ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমেছে। জানলার কাছে এসে অনির্বাণকে বলল, “আচ্ছা, আমি যখন ট্রেনে উঠছিলাম, তখন ধাক্কাধাক্কিতে লাইনে পড়ে যায়নি তো?”

“সে তো যেতেই পারে,” অনির্বাণ বলল, “তা হলে আপনাকে ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”

“সে অপেক্ষা করব,” সন্তোষ ঘাড় নেড়ে বলল, “আচ্ছা এখনও কি রিং হচ্ছে?”

অনির্বাণ নম্বরটা ফের ডায়াল করল। অপর প্রান্তে রিং হওয়ার শব্দ শুনে বলল, “হচ্ছে।”

টেনশনে সন্তোষ নিজের চুল খামচে ধরল। বলল, “ওটাই একমাত্র ভরসা। যদি পকেটমার তুলে নিত তা হলে কি এতক্ষণ চালু রাখত? আমার মনে হচ্ছে ফোনটা কোথাও পড়ে গিয়েছে। ট্রেনে ভাল করে খুঁজলাম। নেই। এত দামি সেট!”

“সাইলেন্ট মোডে নেই তো?”

“না, না। আমি কখনও ফোন সাইলেন্ট করি না। সত্যি বলতে ফোনটার সব ফাংশন এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। কী করে সাইলেন্ট করে তাই জানি না।”

“আপনি একবার আর পি এফ কিংবা জি আর পি-র কাছে গিয়ে কমপ্লেন করুন। ওরা ঠিক ট্র্যাক করতে পারবে।”

সন্তোষের মনে ধরল কথাটা। বলল, “তাই যাব। তবু শেষবার দেখব লাইনে পড়েছে কিনা। ট্রেন ছাড়ার পরও যদি দেখি লাইনে ফোন পড়ে নেই, তা হলে পুলিশের কাছে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আচ্ছা, ফোনটা কি এখনও বাজছে?”

অনির্বাণের মায়া হল। আলতো হেসে বলল, “এইমাত্র তো বাজল। আচ্ছা, আবার দেখছি।”

ফের সন্তোষের নম্বর ডায়াল করল ও। শুনতে পেল ফোন রিং হচ্ছে। চোখের ইশারায় সেটা জানাল সন্তোষকে। আর তাতে সন্তোষের অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। ট্রেনের দরজার কাছে নিচু হয়ে ও দেখতে লাগল লাইনের ফাঁকফোকর। এদিকে ট্রেন ছাড়বে-ছাড়বে করছে। লোকজন দৌড়চ্ছে। দু’-একজন এসে দরজার সামনে ঝুলতে থাকা লোকজনকে ঠেলছে। বলছে, “একটু চাপুন দাদা। আরও একজন হয়ে যাবে।”

সেই কথা শুনে দরজায় ঝুলতে থাকা লোকজনের কোনও হেলদোল হল না। কেউ জায়গা ছাড়লও না।

এমন পরিস্থিতিতে সন্তোষ বোধ হয় কিছু দেখতে পেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ও কাঁধের ব্যাগটা আড়াআড়িভাবে নিল। উত্তেজিত হয়ে বলল, “ফোনটা বাজল তো? এক্ষুনি বাজল তো?”

অনির্বাণও একইভাবে বলল, “হ্যাঁ।”

“দেখি, দেখি একবার,” সন্তোষ কানটা বাড়াল জানলার দিকে, “ফল্স রিং হচ্ছে না তো?”

“মনে হয় না,” বলল অনির্বাণ। মোবাইলটা লাউডস্পিকারে দিয়ে ট্রেনের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ও এমনভাবে ধরল যাতে সন্তোষ রিং শুনতে পায়। অনির্বাণ কিছু বোঝার আগে সন্তোষ খপ করে ওর হাতটা ধরল। আর ছোঁ মেরে মোবাইলটা নিয়ে এক দৌড়ে ভিড়ে মিশে গেল।

সেই মুহূর্তে প্রবল জোরে হর্ন দিয়ে ট্রেনটাও ছেড়ে দিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!