রোমান্টিক গল্প উপন্যাস: ছায়া এসে পড়ে শেষ পর্ব ১৬-২১
রোমান্টিক থ্রিলার ঘরানার বইটি মধ্যবয়সী পুরুষ তৈয়ব আখন্দকে ঘিরে। জীবন সংসারের প্রতি খানিকটা উন্নাসিক কিন্তু বুদ্ধিমান এ মানুষটা পালিয়ে বেড়াতে চায়। কিন্তু আচমকা টাঙন নদী ঘেঁষা গ্রাম পদ্মলতায় এসে সে আটকা পড়ে চাঁদের আলোয় ঝুলতে থাকা একটা লাশ আর লাবনীর জালে। তৈয়ব নিজেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। চলতে থাকে জড়িয়ে পড়া ও ছাড়িয়ে আনার মাঝে এক সমঝোতা।
রোমান্টিক প্রেমের গল্প ও একই সঙ্গে থ্রিলার স্বাদের উপন্যাস ছায়া এসে পড়ে । লেখক ধ্রুব নীল
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -১ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -২ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৩ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৪ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৫ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৬ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৭ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৮ ও ৯ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -১০ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব ১১-১২
ছায়া এসে পড়ে পর্ব- ১৩-১৫
রোমান্টিক গল্প : ছায়া এসে পড়ে শেষ পর্ব ১৬-২১
১৬
শ্রাবণের মাঝামাঝি কোনো এক রাত। এ সময় বৃষ্টি হলেও বজ্রপাত হয় কম। ছইওয়ালা নৌকায় লাবনীর পাশে শুয়ে আছে তৈয়ব। ভাবছে আগের সেই সন্ধার কথা। লাবনী তাকে পালাতে বলেছিল কেন? সে কী জানতো পুলিশ তাকে ধরতে আসবে? ঝরনার কেইসে সে তো তাকে ফাঁসায়নি। শেষপর্যন্ত জিজ্ঞেস করেই বসলো।
‘আমার মন কইতাসিল তোমার বিপদ হবে। এ জন্য ভাগতে কইসিলাম।’
‘মিথ্যে কথা।’
‘এত সত্য জাইনা কী করবেন?’
‘সত্য না জানলে ভাত হজম হয় না আমার। পেটে ব্যথা করবে। আর নৌকার মধ্যে নাই বাথরুম।’
‘আপনি না চইলা যাইবেন একটু পর।’
‘যাব। লোকমান আলীর জন্য প্ল্যান রেডি।’
‘তারে মারবা কেমনে?’
‘সাপ মরবে লাঠি ভাঙবে না বলে একটা কথা আছে না? এখানে সাপ মরবে, লাঠি টেরও পাবে না।’
‘আমারে বলবা না?’
‘আমার সব বলতে ভালো লাগে না।’
‘তোমার মাইয়ার সঙ্গে কথা হয়?’
‘হুম। ভিডিও কল দেয় মাঝে মধ্যে। আগের মতো আর প্রশ্ন করে না।’
‘কী প্রশ্ন?’
তৈয়ব ভুল ধরতে পারলো। মিনু তাকে অতো প্রশ্ন করতো না। প্রশ্নগুলোর বেশিরভাগই ছিল তার কল্পনা।
রাত বারোটা পার হয়েছে। লোকমাল আলীর দেওয়া টর্চ হাতেই বের হলো তৈয়ব। আজ একটি বিশেষ দিন। আজ সে খুন করবে। এমন খুন অনেকেই করে। অনেক সাধারণ মানুষও করে। টের পায় না। তৈয়ব টের পাচ্ছে। অস্বস্তি লাগছে সামান্য। তবে লাবনীর জন্য এটা মেনে নেওয়া কোনো ব্যাপারই না।
‘আসো। বসো। ভাত খাও। আর এই নাও এক লাখ টাকা। বাকির নাম ফাঁকি।’
তৈয়ব টাকাটা সময় নিয়ে গুনে দেখলো।
‘জ্বি খাবো। তার আগে একটা সিগারেট ধরাতে চাই অনুমতি দিলে।’
‘সিগারেট, গাঁজা, মদ যা মন চায় খাও। অনুমতি লাগবে কেন। এত বড় একটা কাজ নিয়া আসছো।’
তৈয়ব টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে মনযোগ দিয়েই খেতে শুরু করলো। খাওয়ার সময় কাঁচা মরিচও চেয়ে নিল।’
লোকমান আলী ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, ‘মিলি রান্না করেছে। মেয়েটার রান্নার হাত সোনা দিয়া বান্দাইয়া দেওনের দরকার।’
তৈয়বের কাছে এমন আহামরী কিছু মনে হলো না। মুরগিতে লবঙ্গ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে। ঝোলও পাতলা। তবে সে বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে। সে চাচ্ছে তার তৃপ্তি করে খাওয়ার দৃশ্য দেখে লোকমানও খেতে বসুক।
‘আমিও চাইরটা খাই। কী বলেন। খিদা খিদা লাগসে।’
‘হুম। খাওয়া শেষে চায়ের কাপ হাতে দুজনে পিপল গাছের তলায় যাব। সেখানে আলাপ হবে।’
‘ভালো বুদ্ধি। কেউ আর বিরক্ত করবে না তাহলে।’
চা-টা বেশ বানিয়েছে মিলি। ওকে নিয়ে গল্প হয়েছে একদফা। বাড়ি কই। পরিবারের কে আছে না আছে এসব। লোকমান আলী মিলিকে বিয়ে করেছে সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে। অবশ্য লিখে দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে। কারণ লাবনী এখন আর তার সঙ্গে নাই। যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে। শেষ বয়সে দেখভাল করবে কে এই চিন্তা চেপে ধরেছিল লোকমানকে। চিন্তার ফল মিলি।
মেয়েটাকে আজ হাসতে শোনেনি তৈয়ব। কী কারণে মন খারাপ? তার কি ধারণা তৈয়ব লাবনীর ভাড়া করা খুনি? লোকমান আলীকে মেরে ফেলতে বাইরে নিয়ে এসেছে?
‘এবার বলো, তোমার চিন্তা ভাবনা কী।’
লোকমান আলী যে চিন্তাভাবনার কথা বলছে, সেটারমানেই একটা হলো প্ল্যান। লাবনীকে খুন করার প্ল্যান।
‘আমার চাকরিটা ছিল মূলত কনসালটেন্সি। মানুষকে ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে জমি আর ফ্ল্যাট কেনাবেচা। সহজ বাংলায় যাকে বলে দালালি।’
‘টেকাটুকা নিয়া চিন্তা কীসের। এক লাখ দিসি, কাজ শেষে আরও এক লাখ দিমু।’
‘আর লাগবে না। আর.. আর পরের টাকাটা চাইলেও দিতে পারবেন না। কারণ টাকা দেওয়ার আগেই সম্ভবত আপনাকে মরতে হবে।’
তৈয়ব সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো চাঁদের দিকে। চার লাখ কিলোমিটার দূরের গোলগাল এবড়োখেবড়ো প্রাণহীন বস্তুটাকে নিয়ে তৈয়বের বিশেষ আদিখ্যেতা নেই। তারচেয়ে পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহটা পরিষ্কার দেখা গেলে আরও ভালো হতো। ঝড় ঝাপটা দেখা যেত।
লোকমান আলী ভুরু কুঁচকে চাঁদ দেখছে। চাঁদটাকেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। তৈয়বের কথার মর্মার্থ বের করার চেষ্টা করছে।
‘আপনি লাবনীকে মেরে ফেলতে চান? মৃত্যু অতি সামান্য জিনিস। এক দুই মিনিটের খেলা। এরপর সব শেষ। সে আপনারে ধোকা দিল। দিনের পর দিন মানিসক যন্ত্রণা দিল, আপনারে অপমানের চূড়ান্ত করলো। আপনি এক মিনিটে সব প্রতিশোধ একবারে নিতে চান?’
লোকমান আলী আরেকটা সিগারেট চাইল। এর মানে, সে তা চায় না।
‘কিছু প্রতিশোধের মূল্য আছে। টাকায় কেনা যায় না। এ জন্য বললাম আপনাকে মরতে হবে। লাবনীও চায় না আপনি বেঁচে থাকেন।’
Bangla Romantic Story
‘তবে..? তবেটা শুনতে চাইতেসি। ঢং না কইরা পুরাটা একবারে কও।’
‘আপনি মরবেন। মানে আত্মহত্যা করবেন। তবে এবার আর কাঁচা কাজ হবে না। আপনার মৃত্যুতে যাবতীয় সাহায্য করবে লাবনী। আমিই সেটা করাবো। এরপর ঘটনা এমনভাবে সাজানো হবে যে সবাই ভাববে সম্পত্তির লোভে লাবনী আপনাকেও মেরেছে। সে যে আমার সঙ্গে নিয়মিত শোয় এটা গ্রামবাসী জানে। এরপর ঘটবে আসল ঘটনা।’
‘কী সেটা?’
লোকমান আলীর প্রশ্ন শুনে অবাকই হলো তৈয়ব। লোকটাকে মরতে হবে বলেছে। এটা শুনেও ভাবান্তর নেই।
‘এরপর মিলি একটা মামলা করবে লাবনীর নামে। সে সাক্ষী দেবে যে লাবনী প্রায়ই আপনাকে হুমকি দিতো। তারপর প্রমাণ হাজির করবো আমি। ওসির হাতে তুলে দিবো সব। আমার সঙ্গে একজন থাকবে। সে করবে ভিডিও। সাক্ষীও দেবে। তাকে দিতে হবে হাজার বিশেক। আর ওসির জন্য আরও লাখখানেক।’
‘ঠিক আছে। যাওনের সময় নিয়া যাইও বাকিটা।’
Bangla Romantic Story
‘আর এখন যাবজ্জীবন জেল মানে ত্রিশ বছর। লাবনীর আর মা হওয়া হবে না। জেলখানায় সে মা হতেও চাইবে না। ভেতরে ভেতরে প্রতিদিনই নরক যন্ত্রণা পোহাবে মেয়েটা। জেলখানায় অবশ্য আত্মহত্যাও করে বসতে পারে।’
একটা সিগারেটের আগুন দিয়ে আরেকটা ধরালো লোকমান আলী। তার মানে প্ল্যান তার দারুণ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এর জন্য যে নিজেকে মরতে হবে ব্যাপারটা সামান্য খোঁচাচ্ছে। ভাবার জন্য আরেকটু সময় নিল সে। তৈয়ব দেরি না করে চলে গেলো দ্রুত। ওদিকে বাড়িতে লাবনী অপেক্ষা করছে তার জন্য। আজ তার ছাদে চাঁদ দেখতে দেখতে শোয়ার শখ হয়েছে নাকি।
Bangla Romantic Story
১৭
রেবেকা আর মিনু চলে গেছে বছরখানেক হলো।শরবানু মৃত্যুপথযাত্রী। মরার আগে তার খায়েস হলো মিনুকে দেখার। কিন্তু রেবেকা রাজী না। মৃত্যুপথযাত্রী কাউকে দেখার ট্রমা সামলানোর বয়স হয়নি মিনুর। তৈয়ব বুদ্ধি করে ভিডিও করে রেখেছে শরবানুর এলোমেলো কথাবার্তা। পরে বড় হলে মেয়েকে দেখানো যাবে। কিন্তু শরবানু যখন দুম করে মরে গেলো, তৈয়বের নিজেরও বুঝতে সময় লেগেছে।
লাবনী এখন আর তার কাছে আসে না। শাড়িটাড়ি পরে মধ্যরাতে নৌকায় চড়ার বায়নাও ধরে না। তৈয়ব জানে তার ডায়াবেটিস। এ রোগ থাকলে স্মৃতি বড় প্রতারণা করে। সে মনে প্রাণে চায় লাবনীর সব স্মৃতি অক্ষত থাকুক। তবু সে মনে করতে পারছে না, কালো শাড়ি পরা অবস্থায় একদিন সন্ধ্যায় লাবনীর সঙ্গে যে সে নৌকায় ঘুরেছিল, সেই নৌকায় ছই ছিল নাকি ছিল না।
১৮
লোকমান আলীতার সিদ্ধান্তটা চাপা স্বরে বলেছে। মিলি খাতুনকে পাঠিয়ে দিয়েছে বাপের বাড়ি। সে থাকলে বিরাট সমস্যা। পরে মামলা টামলা করতে পারবে না। মুখ ফসকে আত্মহত্যার বিষয়টা বলে দেবে।
গলায় দড়ি দেওয়াটাই সবচেয়ে আরামদায়ক মনে হয়েছে লোকমান আলীর কাছে। গ্রামে নয়-দশ তলা বিল্ডিং নাই। বাজারের দিকে একটা পাঁচতলা আছে। তবে উঁচু থেকে লাফ দিতে ভয় করে লোকমান আলীর।
দড়ি কিনতে লজ্জা পাচ্ছিলেন বলে লাবনীকেই বললেন ব্যবস্থা করতে। লাবনী বলল, ‘মরবেন যখন পয়সা নষ্ট করার দরকার কী। ঘরে দড়ির অভাব নাই। আমার পুরান একটা সিল্কের শাড়ি আছে। ওটা বান্দেন। কত মাইয়া গলায় শাড়ি-ওড়না পেঁচায়। আর উনার জন্য স্পেশাল দড়ি কেনা লাগবো!’
‘ভালো বুদ্ধি। আর যা যা বলেছি সব মনে আছে তো?’
‘সব আছে। আজমল উকিল সব লিখে রাখছে। আপনার যাবতীয় সম্পত্তি মিলি খাতুনের নামে। আমার কিছু দরকার নাই। আমি এমনিতেই মহারানী। মহরানীর টেকাটুকা লাগে না।’
‘মিলিকে দেখে রাইখো। বাপ-মা মরা মেয়ে।অল্পবয়সে সম্পত্তিও পেয়ে গেছে অনেক। বিপদ হইতে পারে।’
‘আপনি ফাঁস লইবেন? নাকি বক বক কইরা যাইবেন। আমার আবার তৈয়বের সঙ্গে আজ হওনের কথা। আইজকা শেষ চেষ্টা। না হইলে তৈয়বের মুখে পানের পিক ফেইলা আসবো।’
‘গলায় ফাঁস নিলে সত্যিই মরবো তো?’
‘আপনে লম্বা মানুষ। এত বড় গাছ পাই কই বলেন তো।’
‘মিরাজ আলীর ওই গাছেই যাই।’
‘এক গাছে দুই ভাই ফাঁস লইবেন? এটা নিয়া আবার আরেক কাহিনি। হউক কাহিনি। গেরামে বহুদিন কাহিনি হইতেসে না। নেন আরও চাইরটা ভাত নেন। গরুর মাংস বেশি করে নেন। মইরাই তো যাইবেন। চিন্তা কইরা লাভ কী। খাওনের পর মদও খান এক বোতল। বিদেশি মাল। রেডি করে রাখসি। এরপর মিষ্টি খাইবেন। দই খাইবেন। যা মন চায় খাইবেন। এরপর পান চাবাইতে চাবাইতে গলায় দড়ি পরবেন। এমন ভাইগ্য কয়জনের হয় কন।’
‘তুমি আসলেই মহারানী। এতো বুদ্ধি তোমার।’
‘আমি মরমু সত্তর বছরের বুড়ি হইয়া। পোলার বউয়ের লাত্থি গুতা খাইতে হবে। তারপর একদিন কোমরের হাড্ডি ভাইঙা বিছানায় যামু। তারপর বিছানাতেই হাগামুতা সারতে হইব। বউ আইসা নাক ধইরা কইব, বেডি আর আগনের টাইম পায় নাই। সেই হিসাবে আপনে সঠিক কাজইকরতেসেন।’
গাছের ডালে দড়ি বাঁধতে গিয়ে দুবার আছড়ে পড়ল রবিউল। পা মচকালেও হাড় টাড় ভাঙেনি। কাজটায় সে কোনো উত্তেজনা বোধ করছে না। কারণ তাকে খুন করতে হচ্ছে না।
ফাঁসির দড়ি বাঁধা, টুল সরিয়ে দেওয়া এসব টুকটাক খুচরা কাজ তার সঙ্গে মানায় না। তারপরও হাজার পাঁচেক তো পাওয়া যাচ্ছে। এই আকালের দিকে এটা অনেক টাকা।
গলায় দড়ি পেঁচানোর পর লাবনী শূন্যদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল লোকমান আলীর দিকে। লোকটা নিশ্চয়ই এখন তার শৈশব, তারুণ্যের স্মৃতিগুলো ভাবতে শুরু করছে। বেশি ভাবতে গেলে পরে আবার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে। তার ভাবনার সুতো কাটতে হবে।
‘দোয়া দুরুদ পড়বেন কিছু? কালেমা পড়তে থাকেন। পাপের কামই তো করতেসেন।’
বুকের ভেতর আচমকা ভয়ের ঝাপটা বয়ে গেলো লোকমান আলীর। আশপাশের গাছগাছালিগুলো যেন তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে। কেউ সেকথা শুনছে না। পেছনের নিম গাছটা মিন মিন করে বলছে, দম নেন দম নেন। দম আটকাইলে শেষ। আর পাইবেন না। বাঁশঝাড়ের শোঁ শোঁ শব্দটাও কী ভয়ানক। ডোবার ভেতর ওটা কী! চাঁদটা পানিতে পইড়া গেলো তো! কেউ ওইটারে উঠায় না ক্যান!
‘আমারে নামাও! আমি মরবো না। আমি পলাইয়া যাব। এই গেরামে থাকবো না। আমি অন্য মানুষ হয়া যাব।’
‘কী বললেন বুঝতে পারছি না।’ শেষের কথাটা সত্যিই বুঝতে পারছে না লাবনী। না বোঝার কারণও আছে। তৈয়বের ডিব্বা থেকে দশ বারোটা বড়ি চুরি করে এনেছিল সে। মদের সঙ্গে সেগুলো গুড়ো করে মিশিয়েছিল। ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে।
মদ আর ক্লোনাজেপামের অতিরিক্ত ডোজে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে লোকমান আলীর। সে যা বলতে চাইছে সেটা পারছে না। মনের একটা অংশ মরার আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। একদিকে চরম বিষণ্নতা, অন্যদিকে সাজ সাজ রব। লোকমান আলীর মনে হলো তার নিয়ন্ত্রণ আর হাতে নেই। প্রকৃতি তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে দিচ্ছে বরণ করে নেওয়ার জন্য। বিয়ের গানবাজনার মতো মরার গান শুরু হয়েছে।
লোকমান আলী মনে মনে বলছে ‘আমি বাঁচবার চাই।’ কিন্তু মুখ দিয়ে বের হচ্ছে, ‘আসমানের চান পুকুরে পইড়া গেসে।’ রবিউল একবার উঁকি দিয়ে ডোবায় দেখলো সত্যিই কিছু পড়ল কিনা। তারপর রাস্তায় পড়ে থাকা ঠোঙার মতো টুলটা লাথি মেরে সরিয়ে দিল। পাঁচ মিনিটেই সব নীরব নিথর।
চাদর গায়ে হনহন করে চলে গেলো রবিউল। প্রচণ্ড শীতেও শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে লাবনী। সেও চলে গেলো একসময়।
এরপর ভরা পূর্ণিমায় চায়ের কাপ হাতে চাঁদ দেখতে এসে তৈয়ব আখন্দের মনে হলো সে আবার সময়ের চক্রে পড়ে গেছে। আবার সেই পূর্ণিমা। আবার সেই ঝুলন্ত লাশ। এবারও লাশের খুব কাছে এসে দাঁড়ায় সে। ওইপাশে চাঁদ। লাশের ছায়া এসে পড়ে তার গায়ে। তার সঙ্গে কেউ নেই। কেউ ভিডিও করেনি দৃশ্যটা। করার কথাও ছিল না।
লোকমান আলীর লাশটা বাতাসে দুলছে না। কুয়াশায় একবার দেখা যাচ্ছে, আবার ছায়া এসে পড়ছে। সামনের ডোবায় ভেসে ভেসে উঠছে থালার মতো চাঁদ। তৈয়বেরও হুট করে মনে হলো চাঁদটা পানিতে পড়ে গেলো নাকি!
Bangla Romantic Story
১৯
বাড়িঘর বেচে তৈয়ব একদিন চলে গেলো অন্য গ্রামে। কিসমতপুর হাইস্কুলের অংক স্যার হিসেবে জয়েন করলো। দুইটা এক্সট্রা ব্যাচ পড়ায়। ভালো টাকা আসে প্রতি মাসে।
ভালো স্যারের নামডাক ছড়ায় দ্রুত। তৈয়বের নামডাক ছড়ালো রকেটের গতিতে। তবে বেশি ছাত্র পড়াতে ভালো লাগে না। সে পড়ে থাকে তার গোয়েন্দাগিরির গবেষণা নিয়ে।
নানান বিষয়ে গবেষণা করে। গ্রামে কতো রকম মানুষ থাকে। কার সাইকোলজি কেমন, কার চুরি করার অভ্যাস আছে, কে অতিশয় ভালো লোক, এসব। কিসমতপুর পরিপাটি গ্রাম। তারপরও চুরি-ডাকাতি, খুনটুন লেগে আছে।
দাবা খেলার সুখ্যাতির কারণে থানার ওসির সঙ্গে খাতির জমেছে খুব। অনেক কেইসের সমাধান করেছে খেলতে খেলতেই। কিছু ঘটলেই ডাক পড়ে তৈয়বের। গত কয়েকদিন হলো ওসি তার পরিবার নিয়ে ঘুরতে গেছে। তৈয়বের দাবা খেলা হচ্ছে না।
পড়ন্ত বিকেল। নাস্তা করতে হবে। হালকা খিদে লেগেছে। নাস্তার কথা মনে আসলেই তৈয়বের মুড়ির কথা মনে পড়ে। আর মুড়ির সঙ্গে চলে আসে মিনুর কথা। প্রথম দিকে ঘন ঘন ভিডিও কলে কথা হতো।
রেবেকা বিয়ে করার পর মিনুর কল দেওয়া কমে গেছে। বিদেশে নাকি এত কথা বলার চল নেই। তারা মেসেজ পাঠায় বেশি।
তৈয়ব মেসেজ পাঠায় টুকটাক। হাই হ্যালো পর্যন্ত। মেয়েটার সৎবাবা নিশ্চয়ই খুব আদরযত্ন করে। মানুষ জিনগতভাবে আদরযত্নের কাছে ধরাশায়ী। তৈয়ব নিজেও কিসমতপুরের মণি বেগমের আদরযত্নে ধরা খেয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে লাবনীর কথা মনে পড়লেও সেটা প্রথম লাশের মতো দুলতে দুলতে একসময় হারিয়ে যায়।
‘টমেটো আর সরিষার তেল দিয়ে মুড়ি মাখানো হয়েছে। খেয়ে যান।’
মণি বেগম ইদানীং সব কিছুতেই ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। কারণ সেও মা হতে চলেছে।
২০
লাবনীর কোলে তার পুত্রসন্তান। এখনও নাম ঠিক করেনি। একবার এক নামে ডাকে। কখনও রাতুল, কখনও আবদুর রহিম, কখনও টাঙন, নাম নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। সন্তানকে নিয়ে সারাদিন গুন গুন করে আর এটা ওটা চেনাতে থাকে।
‘পোলাটারে একটু কোলে নাও। দুনিয়ার রান্নাবান্না বাকি। রবিউল কোলে নেয় তার পুত্রসন্তানকে। ছেলে হওয়ার পর তার কাছে মনে হলো সে এতোদিন স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্ন ভেঙেছে। এখন সে অন্য দুনিয়ায়। গাছির কাজ করে না। গ্যারেজে কাজ করে। মাঝে মধ্যে দুচারটা খুন খারাবির ঠিকাদারি নেয়। রেট এখন বাড়তি। এক কাজে লাখের উপরে পায়। বেশিরভাগ অর্ডার আসে ঢাকা থেকে। ঢাকার মানুষকে খুন করা সহজ। ওরা বেশি ভীতু হয়। রবিউলের মতে, যে যত ডরায় তারে মারা তত সোজা।
রেবেকার কাজ দিয়ে ঢাকা যাওয়া শুরু রবিউলের। খুনটা করতে গিয়ে দেখলো কাজ একেবারে জলবৎ তরলং। আরিফ নামের লোকটার অফিসে গিয়েছিল প্রথমে। অফিসে গিয়ে তার কানে কানে বলে আসে, ‘ভাইসাব, আপনার একটা বিপদ আছে। গোপন খবর। কেউ জানে না। আপনার পিছনে খুনি লাগছে। আপনি কী জানি খারাপ কাজ করছেন। আমি শুনছি। এখন আমারে পাঁচ শ টেকা দেন। চা-বিড়ি খাবো।’
টাকাটা নিয়ে চলে যায় রবিউল। রেবেকার কথামতো সহজে মারা যাবে না আরিফকে। আরিফ শিশুদের দিকে কুনজর দেয়। তাকেভয়ানক এক মৃত্যু দিতে হবে। এমনভাবে মারবে যেন পত্রপত্রিকায় খবর হয়। তার মৃত্যু কিভাবে হয়েছে সেটাই হবে খবরের শিরোনাম।
আরিফ বেশ সাবধানে চললো কয়েকদিন। চিরচেনা রুটিন আচমকা বদলে দিলো। গাড়িতে না উঠে সিএনজি অটোরিকশায় উঠলো। একদিন সেই সিএনজি অটোরিকশায় সে ঘুমিয়েও পড়লো। ঘুম ভাঙলো একটা ময়লার ভাগাড়ে। সম্ভবত সিটি করপোরেশনের জায়গা। তরল ময়লার গন্ধে এদিকে কেউ মাড়ায় না।
রবিউল লাশের গন্ধ হজম করা লোক। তার কাছে এসব কিছু না। সে আরিফকে একটা নালার ওপর উপুড় করে শুইয়ে গলায় চাকু ধরে বলল, ‘খা।’
‘কী খাবো! ও ভাই! কী খাবো!’
‘ময়লা খা।’
‘কী বলেন ভাই!’
চাকুটা উরুর গোড়ায় রেখে খানিকটা মোচড় দিল রবিউল। ও জানে, কোথায় সামান্য আঁচড়েও নরকযন্ত্রণা আছড়ে পড়ে মাথায়। আরিফের মাথাটা ময়লার মধ্যে চেপে ধরায় চিৎকারটা কেউ শুনলো না। চাকুটা তখনও জায়গামতো ধরা।
‘খা কইলাম।’
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল আরিফ। দেরি হচ্ছে দেখে মাথাটা চেপে ধরলো রবিউল। পুরোপুরি চেপে ধরলে দমবন্ধ হয়ে মরবে। এ কারণে মাঝে মাঝে ছাড় দিচ্ছে। প্রায় আধঘণ্টা পর কাজ শেষ করে পাশের একটা টিউবঅয়েলে গেলো হাত-পা ধুতে।
২১
আবার পদ্মলতা গ্রামেই ফিরে এসেছে তৈয়ব। দ্বিগুণ দামে কিনেছে নিজের বাড়িটা। কেন একাজ করলো জানে না তৈয়বের স্ত্রী মণি বেগম। তবে বাড়িটা তার ভালোই লেগেছে। নিজের হাতে ঘষে মেজে সিমেন্টের হাউসটাকে পরিষ্কার করে তাতে মাছের পোনা ছেড়েছে। উঠোনের চারপাশে সারি সারি গাঁদা আর গন্ধরাজ লাগিয়েছে। চৈত্র্যের রাতে গন্ধে রীতিমতো মাথা ধরে যায়।
পূর্ণিমার হিসাব রাখা বন্ধ করে দিয়েছে তৈয়ব আখন্দ। আজকাল চোখেও কম দেখে। চোখে কম দেখলেও চাঁদের আলো বুঝতে পারে। সেই আলো নিয়েই কথা বলছিল মিনুর সঙ্গে।
কেউ দেখলে বলবে সেবিড় বিড় করছে। তৈয়ব জানে মিনু সরাসরি তার কাছে না থাকলেও মগজের ভেতরে আছে। মগজের ভেতর মিনুকে সে সযত্নে রেখেছে। বয়স বাড়তে দেয়নি।
‘বুঝলি মা, এই যে চাঁদের আলোর একটা ব্যাপার আছে। আমরা কী বলি, আমরা বলি এটা সূর্যের আলোর প্রতিফলন, ধার করা আলো। এ সব বাজে কথা।’
‘কেন বাজে কথা বাবা?’
‘কারণ চাঁদের আলোর আলাদা একটা ব্যাপার আছে। তা না হলে দুনিয়ায় এত এত কবি-সাহিত্যিকের জন্ম হতো না। তারা চাঁদ নিয়ে এতো আদিখ্যেতাও করতেন না। সব কিছুর ব্যাখ্যা করতে গিয়েই ঝামেলা পাকাই আমরা। জ্যোৎস্নার কোনও ব্যাখ্যা নেই রে মা।’
‘জ্যোৎস্না কী বাবা? জোনাকি পোকা?’
‘নারে মা। জ্যোৎস্নার কোনও মানে নাই। তুই যা ভাববি জ্যোৎস্না মানে সেটাই। জ্যোৎস্না মানে মৃত্যু, মানে অনন্ত।’
‘বাবা এতো কঠিন কথা বলো কেন? কঠিন কথা বলে পাগলেরা। তুমি তো পাগল না।’
তৈয়বের চিন্তার সুতো কেটে গেলো একটা বিশেষ গন্ধে। বিদেশি পারফিউম। বড় করে শ্বাস নিল। পারফিউমের জাত তার চেনা। কোন দেশের সেটাও জানে। তার ইন্দ্রিয় এখনও প্রতারণা শুরু করেনি। এতোক্ষণ বিড় বিড় করে কথা বললেও এবার জোর গলায় বলল, ‘মিনু এসেছিস? মুড়ি খাবি?’
বাড়িভর্তি অতিথি। রেবেকা, রেবেকার বিদেশি স্বামী, মণি বেগমেরও বাপের বাড়ির লোকজন এসেছে তৈয়বের আগের পরিবারের লোকজন দেখতে। আত্মীয়-স্বজনে ভরে গেছে উঠোন। তাদের হই হুল্লোড় তৈয়বের কানে যাওয়ার কথা নয়। কারণ তৈয়ব বসে আছে ডোবার পাশের একটা মাচায়। তার পাশে বসে আছে মিনু।মিনু শাড়ি পরেছে। খোঁপায় একটা গন্ধরাজ ফুলও গেঁথেছে।
বাবার কথা পত্রিকায় পড়েছে অনেকে। বাবার আসল নাম তৈয়ব আখন্দ হলেও এটা অনেকে জানে না। সবাই ডাকে তৈয়ব হোমস।
‘একটা কথা বলতো বাবা। এই যে এতোদিন তুমি আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছো, আমি কি তোমাকে ক্ষমা করেছি?’
‘অকূল পাথারে ফেললিরে মা। এটা বোঝার ক্ষমতা তো আমার নেই।তবে আমাকে ক্ষমা করার দরকার কী। আমি চিরকাল তোর অপরাধী বাবা।’
তৈয়ব আখন্দ ঝাপসা চোখে মিনুর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে, কখন তার মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘অকূল পাথার কী বাবা?’