পৃথিবীর সবক’টি মহাসাগরের জলস্তর ৩০ ফুটেরও বেশি উঠে এসেছিল। ভূপৃষ্ঠের প্রায় পুরোটাই চলে গিয়েছিল জলের তলায়। অ্যান্টার্কটিকার বরফের বিশাল বিশাল চাঙর গলে যাওয়ায়।
খুব একটা দূর অতীতের ঘটনা নয়। মাত্র সওয়া এক লক্ষ বছর আগেকার কথা। ঠিক তেমনটাই ঘটতে চলেছে আবার। কুমেরুর বরফের চাঙরগুলি খুব দ্রুত গলে যাচ্ছে বলে। আর এ বার সেই মহাসাগরগুলির জলস্তর উঠে আসবে কম করে ৭০/৮০ ফুট! মানে, প্রায় ৬/৭ তলা বাড়ির সমান!
ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্লাইমেট সায়েন্স বিভাগের হালের একটি গবেষণায় মিলেছে সেই ভয়াবহ ভবিষ্যতের অশনি সংকেত।
বরফের অত্যন্ত পুরু ও বিশাল বিশাল চাঙর ভাঙছে অ্যান্টার্কটিকায়। ছবি- রয়টার্স
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট সায়েন্স বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর আন্দ্রেজ কার্লসনের নেতৃত্বে সেই গবেষকদলে রয়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরও দুই অধ্যাপক। দু’জনেই অনাবাসী ভারতীয়। এক জন আদতে দক্ষিণ ভারতী। সিদ্ধার্থ রঙ্গনাথন। অন্য জন বাঙালি, দেবযানী দত্ত ভট্টাচার্য। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ। গবেষণাপত্রটি এই ডিসেম্বরেই পড়া হয়েছে ওয়াশিংটনে আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের (এজিইউ) বৈঠকে।
সেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু দেড় দশক আগেই
গবেষকদের অন্যতম সিদ্ধার্থ রঙ্গনাথন ও দেবযানী দত্ত ভট্টাচার্য ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বস্টন থেকে জানিয়েছেন, ‘‘আমরা খুব দূর ভবিষ্যতের কথা বলিনি। কারণ, অ্যান্টার্কটিকার বরফের বিশাল বিশাল চাঙরগুলি যে সেই ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকেই এগিয়ে চলেছে, তার আভাস মিলতে শুরু করেছে দেড়/দু’দশক আগে থেকেই। সওয়া এক লক্ষ বছর আগে কুমেরুর বরফের চাঙর খুব দ্রুত হারে গলে গিয়েছিল সূর্যের বায়ুমণ্ডল (করোনা) থেকে বেরিয়ে আসা ভয়ঙ্কর সৌরঝড়, সৌরবায়ু আর করোনাল মাস ইজেকশানের মতো ঘটনার জন্য। যা পৃথিবীকে এতটাই তাতিয়ে তুলেছিল যে অত দ্রুত হারে বাধ্য হয়েছিল অ্যান্টার্কটিকার বরফের অত্যন্ত পুরু ও বিশাল চাঙরগুলি।’’
৫০ বছরে সেই আশঙ্কা বাড়বে ৭০ শতাংশ
গবেষকরা দেখেছেন, গত দেড় থেকে দু’দশক ধরে যে গতিতে গলে গিয়ে পাতলা হয়ে গিয়েছে সেখানকার বরফের অত্যন্ত পুরু ও বিশাল চাঙরগুলি, তাতে কুমেরুর পশ্চিম প্রান্তের বরফের চাঙরগুলি (ওয়েস্ট অ্যান্টার্কটিকা আইস শিট) আরও দ্রুত ও আরও বেশি পরিমাণে গলে যাবে। এমনকি, আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে সেই আশঙ্কা বেড়ে যাবে আরও ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ।
সিদ্ধার্থ ও দেবযানীর কথায়, ‘‘এর মানে, অ্যান্টার্কটিকার বরফের পুরু ও বিশাল বিশাল চাঙরগুলি গলতে তখন যতটা সময় নিয়েছিল, এ বার তার চেয়ে অনেক কম সময় নেবে। অন্তত ৪৫/৪৭ শতাংশ কম।’’
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি)-র গাঁধীনগর শাখার আর্থ অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক বিক্রান্ত জৈন বলছেন, ‘‘খুবই উদ্বেগজনক ছবি তুলে ধরলেও, এই গবেষণা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সদর্থকও। উষ্ণায়ন আমাদের সভ্যতার বিপদকে কতটা বাড়িয়ে তুলেছে গত দু’দশকে আর তা কতটা বাড়িয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত, এই গবেষণা যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ-সহ তার পূর্বাভাস দিয়েছে।’’
শতাব্দীতে ১০ ফুট করে উঠবে মহাসাগরের জলস্তর!
গবেষণা এও বলছে, প্রতি শতাব্দীতে ৮ থেকে ১০ ফুট করে উঠছে ও উঠবে মহাসাগরগুলির জলস্তর। তার মানে, আরও ৮০ ফুট উঠতে আরও ৮ শতাব্দী লাগার কথা। যার অর্থ, ২৮০০ সালের মধ্যেই সেই মহাপ্লাবন হবে পৃথিবীতে। আর সেই ‘হিমশৈলে’র চূড়াটা দেখা যাবে আর ৫০০ বছরের (২৫০০ সাল) মধ্যেই।
দেড় লক্ষ বছর আগে কেন অত দ্রুত গলেছিল অ্যান্টার্কটিকার বরফের চাঙর?
দেবযানী ও সিদ্ধার্থ বলছেন, ‘‘মূলত, দু’টি কারণে। দেড় লক্ষ বছর আগে পৃথিবী তার কক্ষপথ বদলিয়ে হঠাৎই খুব কাছে চলে গিয়েছিল সূর্যের। যে পথে নিজের চার পাশে লাট্টুর মতো পাক খাচ্ছে আমাদের গ্রহ, তাও বদলে গিয়েছিল। ফলে, সূর্যের করোনা থেকে বেরিয়ে আসা সৌরঝড়, সৌরবায়ু ও করোনাল মাস ইজেকশান (সিএমই)-এর মতো ঘটনায় খুব দ্রুত গলে গিয়েছিল অ্যান্টার্কটিকার বরফের অত্যন্ত পুরু ও বিশাল বিশাল চাঙরগুলি।’’
কুমেরুতে গত ২৫ বছরে গলেছে ৩ লক্ষ কোটি টন বরফ!
গাঁধীনগর আইআইটি-র অধ্যাপক বিক্রান্ত জৈন জানিয়েছেন, গত ২৫ বছরে অ্যান্টার্কটিকায় ৩ লক্ষ কোটি টনেরও বেশি বরফ গলে গিয়েছে। হালের গবেষণা দেখাল, সেই বরফ গলে যাওয়ার হার বেড়ে গত দেড় দশকে ৩ গুণ হয়েছে। তার ফলে, দেড় লক্ষ বছর আগেকার সময় থেকে এখনও পর্যন্ত বাড়তি ২ কোয়াড্রিলন (এক-এর পর ১৫টি শূন্য বসালে যে সংখ্যা হয়, তাকে বলে এক কোয়াড্রিলন) গ্যালন জল পৃথিবীর মহাসাগরগুলিতে ঢুকেছে। যার জেরে আরও ফুলে-ফেঁপে উঠেছে মহাসাগরগুলি।