ভিন্নমত প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় অনেক দিন ধরেই নজর রাখা হয়েছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদের ওপর। ‘শিবিরপন্থী’ হিসেবে শনাক্ত করে তাঁকে ‘ট্রিটমেন্ট দিতে’ (নির্যাতন চালাতে) বলেছিলেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহতাসিম ফুয়াদ। গত রবিবার রাতে নিজ কক্ষে ঘুমন্ত আবরারকে ডেকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান ছাত্রলীগকর্মী ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মুনতাসির আল জেমি এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এহতেশামুল রাব্বি তানিম। আবরারের ওপর দফায় দফায় নির্যাতনের নেতৃত্ব দেন তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার।
আবরার হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তারকৃত ১৩ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে (বহিষ্কৃত) জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। হত্যাকাণ্ডের পর অভিযুক্তরা প্রমাণ গায়েবের চেষ্টা করেছেন বলেও আলামত পাওয়া গেছে।
পুলিশ ও সহপাঠীরা জানিয়েছেন, আবরারের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁর মৃতদেহ ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে ২০১১ নম্বর কক্ষটি পরিষ্কার করা হয়। ওই কক্ষ থেকে নির্যাতনের আলামত সরিয়ে আবরারের কক্ষ থেকে তাঁর নতুন পোশাক আনা হয়। হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি বলে চালাতে প্রথমে আবরারকে শিবিরের নেতা বলে প্রচার করা হয়। একপর্যায়ে কৌশল পাল্টে আবরার মাদক কারবারি বলেও গুজব ছড়ানো হয়। আবরারের কক্ষে মাদকদ্রব্য রাখার চেষ্টা পাহারা দিয়ে রুখে দিয়েছেন বলে দাবি করেন কয়েকজন সহপাঠী। এ ছাড়া ঘটনার পরে পুলিশকে শেরেবাংলা হল থেকে আলামত সংগ্রহে বাধা দেওয়া হয়।
এদিকে প্রথম দফায় ১০ জনের পর বুয়েটের তিন শিক্ষার্থীর পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বুধবার ঢাকা মহানগর হাকিম তোফাজ্জাল হোসেন তাঁদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ওই তিন শিক্ষার্থী হলেন শামসুল আরেফিন রাফাত (২১), মনিরুজ্জামান মনির (২১) ও আকাশ (২১)।
অন্যদিকে গতকাল ধানমণ্ডি এলাকা থেকে শাখাওয়াত ইকবাল অভি নামে আবরারের এক সহপাঠীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্যাতনে হত্যার পর ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। এ কারণে প্রথমে পুলিশকে সেখানে ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। কিছু আলামত সরিয়েও ফেলা হয়। তবে পরবর্তী তদন্তকালে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজসহ বেশ কিছু আলামত জব্দ করা গেছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট ও বুয়েটের একাধিক সূত্র জানায়, বেশ কিছুদিন ধরেই আবরারের ফেসবুকে নজরদারি করছিলেন বুয়েট ছাত্রলীগের কিছু নেতা। তাঁরা আবরারকে কট্টর শিবির বলে সন্দেহ করেন। এ ছাড়া ভিন্ন মতাদর্শীদের কক্ষে ডেকে নিয়ে হুমকি ও নির্যাতন চালাতেন তাঁরা। ৩ অক্টোবর একটি ফেসবুক পোস্টের কারণে আবরারকে ২০১১ নম্বর রুমে ডেকে সতর্ক করেছিলেন ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক এবং পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা। হত্যাকাণ্ডের দিন রাসেল ও ফুয়াদ আবরারকে মারধর করার কথা বলেন। এটাকে তাঁদের ভাষায় ‘ট্রিটমেন্ট দিতে’ বলা হয়। তবে হত্যা-নির্যাতনের সময় প্রকাশিত সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে অমিত, রাসেল ও ফুয়াদকে প্রথমে দেখা যায়নি।
সূত্র জানায়, ডিবির জিজ্ঞাসাবাদের সময়ও আসামিরা একে অন্যকে দোষ দিচ্ছেন। তাঁরা বেদম মারা ঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ বলছেন, আগের মতোই নির্যাতন চালাবেন ভেবেছিলেন তাঁরা। আবরার মারা যাবে, সেটা ভাবেননি।
জানতে চাইলে চকবাজার থানার ওসি সোহরাব হোসেন বলেন, ‘ভোররাতে আমাদের (পুলিশকে) খবর দিয়েও তারা আর হলে ঢুকতে দেয়নি। তারা বলছিল, ‘শিবির ধরা পড়েছে, তাকে নিয়ে যান’। কিন্তু পুলিশ গেলে তাদের হলে ঢুকতে দেয়নি। তারা লাশ অনেকক্ষণ আটকে রেখেছিল। পরে শিক্ষকরা আসার পর আমরা লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠাই।’
প্রসঙ্গত, গত রবিবার রাতে মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় তাঁর বাবা বরকত উল্লাহ সোমবার রাতে ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেন।