দেশের প্রায় ৬৩ হাজার সক্রিয় ব্যবহারকারীকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়ে হুট করে বন্ধ হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্ক ডটকম। ২৪ ঘণ্টা ধরে অনেকেই আর এতে ঢুকতে পারেননি। ফ্রিল্যান্সারদের মাঝে প্রশ্ন ওঠে, সরকার কি দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আনার এ সাইটটিকে ব্লক করে দিল? কিন্তু সরকার কেন এমনটা করবে? সরকার এ খাতটিকে এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। ইতিমধ্যে এক বিলিয়নের কাছাকাছি আয় আসছে এ খাত থেকে, যার সিংহভাগ আসছে ফ্রিল্যান্সারদের হাত ধরে। এই ফ্রিল্যান্সারদের অনেকেই আপওয়ার্কে কাজ করেন। তাঁরা একদিন সেখানে কাজ না করতে পারলে কত ক্ষতি। ক্লায়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ। দেশের দুর্নাম। অথচ কেন আপওয়ার্ক বন্ধ হয়ে গেল, তার কোনো কারণ কেউ স্বীকার করে না। এর আগে গত ডিসেম্বরে গুগলের কিছু সেবা ব্যবহারে বিঘ্নের মুখে পড়েন ব্যবহারকারীরা।
তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সহজেই অনুমান করতে পারেন, কোনো সাইট বন্ধ করতে গিয়ে দরকারি সেবাগুলো বন্ধ করে ফেলার ঘটনা ঘটে থাকে। যদি না হবে, তবে কি ভূত এসে বন্ধ করে ‘আপওয়ার্ক’ বা দরকারি সাইটগুলো? ইতিমধ্যে ফ্রিল্যান্সিং কমিউনিটিতে প্রশ্ন উঠছে, দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নাকি স্রেফ ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলো করা হয়?
দেশের অনেকেই ফ্রিল্যান্সার অনলাইন মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্কে কাজ করেন। ৮ মে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওই সাইটে ঢুকতে পারছিলেন না দেশের ফ্রিল্যান্সাররা। অনেকেই ভেবেছিলেন, আপওয়ার্কের কারিগরি ত্রুটির কারণে তা হয়েছে। কিন্তু পরে আপওয়ার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের কোনো কারিগরি সমস্যা হয়নি। এটা স্থানীয় আইএসপি সমস্যার কারণে হয়েছে। স্থানীয় নেটওয়ার্কে তাদের ওয়েবসাইটটি ব্লক করা হয়েছে। জানা যায়, আরকে rk (.) com নামে একটি অ্যাডাল্ট সাইট ব্লক করতে গিয়ে যেসব ওয়েবসাইটের অ্যাড্রেসের শেষে rk (.) com আছে, এমন সব সাইট (যেমন upwork.com, wework.com, artwork.com, network.com, ইত্যাদি) ব্লক করে ফেলা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ টেলিকম অধিদপ্তর আপওয়ার্ক বা এ ধরনের কোনো সাইট বন্ধ করা হয়নি বলে জানায়। অর্থাৎ, এ রকম সাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা স্রেফ অস্বীকার করে তারা। টেলিকম অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব রফিকুল মতিন বলেন, দেশ থেকে আপওয়ার্ক নামের কোনো সাইট বন্ধ করা হয়নি। আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিমও বলেন, কোনো সাইট বন্ধের বিষয়ে বিটিআরসি থেকে তাঁদের কিছু জানানো হয়নি। তবে সাইট বন্ধ হলো কীভাবে?
বাংলাদেশের আপওয়ার্কের ফ্রিল্যান্সাররা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁরা সমস্যায় পড়েছেন এবং সে সমস্যার কথা তাঁরা প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। এর ফলে দ্রুত তাদের সমস্যার সমাধান হয়েছে। কিন্তু সমস্যা যেভাবে সৃষ্টি হলো বা হচ্ছে, তার কোনো সমাধান হচ্ছে না। বারবার সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এটি আতঙ্কের পর্যায়ে চলে গেছে। নানা গুজব ছড়াচ্ছে। সবাই ভেবেছে, এ সাইট পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে। অথচ সরকার বিষয়টিতে বেশ আন্তরিক।
আপওয়ার্কের মার্কেটিং ডেটা অপারেশন বিভাগের প্রধান সাইদুর মামুন খানের ভাষ্য, আপওয়ার্কে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা ভালো করছেন। কিন্তু বুধবার বাংলাদেশের অনেক আইপি থেকে আপওয়ার্কসহ আরকে ডটকমের অনেক সাইটে ঢোকা যাচ্ছিল না। আপওয়ার্কের কোনো কারিগরি সমস্যা হয়নি।
আপওয়ার্ক প্রিমিয়ার ক্লাবের এক ফ্রিল্যান্সার বিষয়টি নিয়ে রসিকতা করে লিখেছেন, ‘অবৈধ গ্যাসের সংযোগ কাটতে গিয়ে গ্যাসের লাইনের পাশাপাশি পানির লাইনও কেটে দিয়েছে বাংলাদেশের অনলাইন দুদকের মহাজ্ঞানী কর্মকর্তা এবং ইঞ্জিনিয়ারগণ।’
বিষয়টি মূলত পর্নোগ্রাফি সাইটগুলোকে ইঙ্গিত করে লেখা। সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় দেশে পর্নো সাইটগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট বন্ধ করার জন্য জোর তাগিদের কথাও বলেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তবে পর্নো সাইট বন্ধ করতে গিয়ে ঘটছে দরকারি সব ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে না নিশ্চয়ই। সাধারণত এ কাজটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটের ঠিকানা, তার আইপি কিংবা ডিএনএস ব্লক করার মাধ্যমে করা হয়। আইএসপি বা ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের দিয়ে এ ধরনের কাজগুলো আগে করানো হতো। তবে সরকার এবার আর লোকাল আইএসপির ওপর নির্ভর না করে সরাসরি আইআইজির (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) মাধ্যমে এই কাজটি করছে। ফলে যেসব আইএসপি নির্দিষ্ট কোনো আইআইজি ব্যবহার করে এবং ওই আইআইজিতে যদি কোনো ওয়েবসাইট ব্লক করা থাকে, তবে সেই আইএসপির সব ব্যবহারকারী ব্লক করা কোনো ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে পারবেন না। কাজটি করতে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু আইপি বা ওয়েবসাইটও বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি অনেকে এখনো জানেনই না যে এসব সাইট বন্ধের প্রক্রিয়াতে আর কী কী সাইট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা আরেক তথ্য দিচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকারের টেলিকম অধিদপ্তর একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার আওতায় সব ইন্টারনেট গেটওয়েতে ডিপিআই (Deep Packet Inspection) ডিভাইস বসানো হয়েছে। এতে এখান থেকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রতিটি প্যাকেট তথ্য নজরদারির সুযোগ থাকে। ফলে দেশ থেকে কোনো অনৈতিক লেনদেন হচ্ছে কি না বা গোপনীয় বিষয় বাইরে যাচ্ছে কি না, তা জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এর আগে গত ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নির্দেশে ৫৪টি ওয়েবসাইট বন্ধ করার পর গুগলের কিছু সেবা ব্যবহারে বিঘ্নের মুখে পড়েন ব্যবহারকারীরা। এর মধ্যে অন্যতম হলো জি-মেইলের ফাইল ডাউনলোড ও গুগল ড্রাইভের ব্যবহার। নির্বাচন পর্যন্ত ওই সমস্যায় ভুগতে হয় দেশের জি-মেইল ব্যবহারকারী ও ফ্রিল্যান্সার গোষ্ঠীকে। এ সময় স্কাইপে বন্ধের নির্দেশও আসে।
এ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার বিশ্বে কোনো কিছু বন্ধ করে কি আটকানো যাবে? মানুষ কিন্তু বিকল্পের খোঁজ জানে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ ভিপিএনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফ্রিল্যান্সারদের অনেকেই গত বুধবারের আপওয়ার্ক বন্ধের ঘটনায় ভিপিএন ব্যবহার করে ঢুকতে পেরেছেন বলে জানান। এ ধরনের সমস্যা যাতে না হয়, কোনো দরকারি সেবায় যাতে বাধা না আসে, এমনটাই চান ফ্রিল্যান্সাররা। তাঁদের প্রত্যাশা, সরকার ফ্রিল্যান্সারদের দিকে আরও সুদৃষ্টি দেবে, তাঁদের সমস্যাগুলো সমাধানে আন্তরিক চেষ্টা করবে। দরকারি ওয়েবসাইটগুলো যাতে কোনোভাবে বন্ধ না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।