Saturday, December 21
Shadow

গল্প : বোয়াল মাছ এবং গাছ বন্ধুর গল্প

চন্দনকৃষ্ণ পাল
১.
বিলাস নদী পাহাড় থেকে নেমে একে বেঁকে প্রথমে যে গ্রামটিকে ছুঁয়েছে তার নাম হরিণাকান্দি।খুব সুন্দর এ গ্রাম।সামনে তাকালে দূরে কালচে পাহাড় । বামে তাকালে হাইল হাওরের নীল জল।আকাশ ছোঁয়া নীল জলের হাওরে কত মাছ আর জলজ প্রাণী যে আছে, তার কোন হিসেব নেই বোয়াল পরিবারের ছোট ছেলে টুনুর কাছে। টুনুদের বাস বাইক্কা বিলে।বাইক্কা বিলে মাছ ধরা নিষেধ। তাও মাঝে মাঝে মাছ চোররা হামলা করে। টুনুরা বিলের গভীরে থাকায় বেঁেচে যায়। জন্মের পর গত একবছরে বিলের সব গলি ঘুপচি বেড়ানো শেষ টুনুর । ওর ইচ্ছা একবার বিলের বাইরে কোন নদী ধরে অনেক দূর যাবে। কিন্তু সবাই ভয় দেখায়। বলে বিলের বাইরে অনেক বিপদ।সবচেয়ে বড় বিপদ মানুষ। সব ধরনের মাছই মানুষের প্রিয় খাদ্য। তাই মানুষের চোখে পড়লে আর রক্ষা নাই। দাদুর কাছে টুনু নদীর গল্প শুনেছে।দাদুই একমাত্র বোয়াল যে নদী বেড়িয়ে আবার বিলে ফিরে এসেছেন।টুনু ভাবে ও ঠিকই নদী দেখতে যাবে।এতো ভয় করলে কি স্বপ্ন পূরণ হয়?
২.
দাদুকে পটিয়ে ফেললো টুনু।দাদু কাউকে বলবেন না।কিছু টিপসও দিলেন। বললেন, ‘পানির গভীরে থাকতে হবে সব সময়।বাইক্কা বিলে একটা ঘোলা স্রোত এসে মিশেছে । ওটাই বিলাশের স্রোত । ওটা ধরে এগোলে নদীতে পৌঁছা যাবে।নদী কোথাও ছোট কোথাও বড়। কোথাও গভীর কোথাও অগভীর। নানান বিপদ ছড়িয়ে আছে পথে।সব সময় সাবধান থাকতে হবে।’
এক গভীর রাতে বেরিয়ে পড়লো টুনু।দাদুর কথা মতো বিলাসের স্রোতটাও পেয়ে গেলো সে।এরপর এগোনোর পালা।টুনু দ্রুত নদীর মোহনা ছেড়ে নদীতে এসে পড়লো।এ এক নতুন জগৎ।দুপাশে কালচে জমি আর মাঝে নদী।হঠাৎ করেই আলো ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। অর্থাৎ রাত শেষ।ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে আকাশে তাকালো টুনু।টকটকে লাল সূর্য উঠছে আকাশে।ও আবার নেমে এলো জলের নীচে। তারপর এগোতে থাকলো।সারারাত সাঁতার কেটে এখন ওর শরীরে ক্লান্তি।নদীর একপাশে নিরিবিলি একটা জায়গা দেখে থামে টুনু।উপর থেকে লম্বা লম্বা কি যেন নেমে এসেছে পানিতে।ওখানে স্থির হয়ে গা এলায় সে।লম্বা লম্বা জিনিসগুলো মুখ দিয়ে ছুঁয়ে দেখে ও।হঠাৎই চমকে ওঠে টুনু। কেউ কথা বলছে।গভীর আওয়াজ।
৩.
ঃ আমার শিকড়ে সুড়সুড়ি দেয় কে?
কোন শব্দ নেই।
ঃ কে আমার শিকড়ের নীচে?কথা বলছো না কেন?
টুনু বুঝে প্রশ্নগুলো ওকেই করা হচ্ছে।টুনু জলের উপর মাথা তুলে।
ঃ আমি টুনু।
ঃ তা সুড়সুড়ি দিচ্ছো কেন বাপু
হিজল গাছ তার বেগুনী ফুল আর সবুজ পাতা নেড়ে প্রশ্ন রাখে।
ঃ আমি বুঝিনি যে তোমার সুড়সুড়ি লাগবে। আমি তো আজই এলাম। আগে কখনো নদীতে আসিনি।
ঃ আচ্ছা । নতুন অতিথি।তা বিশ্রাম নাও।একদম ভিতরের দিকে থাকো।না হলে মানুষরা ধরে নিয়ে যাবে। পাশে মানুষের বাস।মানুষের খুব উৎপাত এখানে।সাবধানে থেকো রাতে কথা বলবো তোমার সাথে।
হিজল গাছ চুপ হয়ে যায়। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসে চমৎকার ফুলগুলি দোল খেতে থাকে।

৪.
পশ্চিম আকাশ আলো করে একসময় গ্রামের আড়ালে সূর্য ডুবে গেল।বোয়াল ছানা টুনুর ঘুম ভাঙে।ও বাইরে আসে।
ঃ কি আমার টুনু বাবুর ঘুম ভাঙলো?
ঃ হ্যাঁ।আচ্ছা আমাকে তুমি নদী আর এই গ্রামের গল্প বলো তো গাছবন্ধু।
ঃ সে তো অনেক গল্প ভাই। এটা বিলাস নদী। ত্রিপুরার পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। আর এই গ্রামের নাম হরিণাকান্দি। মানুষরা এমনিতে ভালো। কিন্তু ওরা মাছ খেতে খুব পছন্দ করে । তাই সুযোগ পেলেই মাছদের ধরে নিয়ে যায়। তাদের নানা ধরনের অস্ত্র আছে মাছ শিকার করার।আমার ডালপালাও মাঝে মাঝে কেটে নিয়ে যায়।খুব কষ্ট হয় তখন।
ঃ আচ্ছা আমি কি আর এগিয়ে যাবো?
ঃ তুমি আসলে ভুল সময়ে এসেছো। সামনে শীত। দ্রুত পানি কমে যাচ্ছে। শেষে কোথাও আটকে পড়বে। তখন মানষ ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলবে। বরং আজই তুমি ফেরার পথ ধরো। কয়েক মাস পর বর্ষা আসবে । নদীতে প্রচুর পানি থাকবে। তখন বিপদও কম থাকবে। তখন আবার এসো।
গাছ বন্ধুর কথা টুনুর মনে ধরে।
ঃ ঠিক আছে বন্ধু তোমার কথাই ঠিক।আজ আমি ফিরেই যাই।আবার তোমার সাথে দেখা হবে। ভালো থেকো।
ঃ আর শুনো, সব সময় নদীর মাঝখানে থেকো। নদীর পাশে ফাঁদ পাতা থাকে। একবার আটকা পড়লে আর বের হতে পারবে না। আর এই নাও আমার ছোট্ট উপহার। বলেই কয়েকটি বেগুনী রঙের চমৎকার ফুল টুনুর মুখের কাছে ফেলে দেয় হিজল গাছ।
খুব খুশি হয় টুনু। মুখ আর পাখনা দিয়ে অনেক মমতায় ফুলগুলো আকড়ে ধরে টুনু। পাখনা নাড়িয়ে হিজল গাছ এর কাছ থেকে বিদায় নেয় টুনু।তারপর ভাটির পথে যাত্রা শুরু করে।
৫.
কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ করে কান্নার শব্দ পায় টুনু । বা পাশে তাকিয়ে ও অবাক। একটা বাক্সের মতো ফাঁদে আটকা পড়েছে অনেক জাতের মাছ। কোন ভাবেই বের হতে পারছে না তারা। ও মনে মনে ঠিক করে ওদের সে উদ্ধার করবে। কিন্ত কিভাবে? ফাঁদটার চারপাশ ঘুরে দেখে ও। ফাঁদের এক কোণে একটা কাঠি বাঁকা হয়ে আছে।ওটাকে আর একটু বাঁকা করতে পারলে একজন একজন করে বের হয়ে যেতে পারবে। কয়েক বারের চেষ্টায় কাজটা করতে পারে টুনু। ছোট মাছরা দ্রুত বের হয়ে এসে ওর সাথে যোগ দেয়। সবার মিলিত শক্তিতে ফাঁকটা আরও একটু বড় হয়।বড় মাছরাও এবার বের হয়ে যায়।সবাই মিলে ওকে ধন্যবাদ জানায়।
গোলগাল বিশাল চাঁদটা রূপালী আলোতে ভরে দিয়েছে নদী আর নদীর পারের গ্রাম ও গাছপালা। টুনুর মনটা ভালোলাগায় ভরে ওঠে।ও হাওরের পানে দ্রুত সাঁতার কাটতে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!