ঘণ্টাখানেক হলো বিছানায় বসে আছে বীনা। অস্বস্তি লাগলেও কাউকে ডাকতে পারছে না। লোকটারও দেখা নেই। বসতে বলে চলে গেছে। টেবিলে একটা মদের বোতল রাখা। তাতে অবশ্য মদ না, পানি। পাশে কোনো গ্লাস নেই। যাওয়ার সময় লোকটা বলে গেছে, চাইলে খেতে পারো। বীনার প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছে। কিন্তু মদের বোতল থেকে পানি গিলতে ভয় পাচ্ছে। যদি কিছু মেশানো থাকে। দেখতে যত ভদ্র, তত রিস্ক বেশি। তা ছাড়া বীনা কিছু মানুষের কথা জানে। পতিতাদের ধরে নিয়ে খুন করে। লোকটার কথাবার্তা কেমন যেন। সুবিধার মনে হয়নি। অসুবিধার মনে হওয়ারও বিশেষ কারণ নেই। সাধাসিধা দেখতে। চশমা-পাঞ্জাবি পরা। ভদ্রলোক বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। বিশাল বড়লোক। বাড়িটাও বিশাল। বীনার একবার মনে হলো লোকটা তাকে বসতে বলে হয়তো তার কথা ভুলে গেছে।
অন্যদিনের মতো মুখে কড়া মেকআপ নেই বীনার। ক্লায়েন্টের ইচ্ছা, তাই মেকআপ ছাড়াই এসেছে। রুমে একটা আয়না আছে। বীনা দেখল নিজেকে। আসল চেহারা দেখতে কেমন যেন লজ্জা করছে। চেহারার বর্ণনায় কত জন কত কিছু বলে। বীনার মনে হয় ওসবের কোনোটাই তার সঙ্গে যায় না। না সুন্দরী, না বদখত। মেকআপ না দিলেও চোখে মোটা করে কাজল পরেছে। চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব এসেছে। কিন্তু বীনা জানে চেহারায় মায়া এনে বিশেষ কোনো লাভ নেই। কাস্টমাররা এসব মায়া টায়ার ধার ধারে না। সবার ঘটনা এক। কাজ শেষে টাকা দিয়ে কোনো রকম ভাগাতে পারলে বাঁচে। ওই সময়টা উপভোগ করে বীনা। তার আগ পর্যন্ত তার অস্বস্তি কাটে না।
বসে বসে রুম দেখা ছাড়া কাজ নেই। ফোন হাতে নিল। লোকটার নাম্বার নেই। কাউকে ফোন করারও ইচ্ছে নেই। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না বীনার। দুপুর তিনটার মতো বাজে। এখানে আসার আগে খেয়ে নিয়েছিল। একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে বেশ হতো। শুয়ে পড়বে নাকি? তুলতুলে বিছানা আর বালিশের দিকে তাকাতেই মনে পড়ে গেল পঞ্চাশ হাজার টাকা কম না! পঞ্চাশ হাজার! নিজের মনেই বিড়বিড় করলো বীনা। এমনিতে দুই-তিন হাজারের বেশি সে পায় না। কিন্তু লোকটা দর কষাকষিতে না গিয়ে শুরুতেই পঞ্চাশ বলে দিয়েছে। এখানে বীনা পাবে বিশ হাজার। বাকিটা দালালের কমিশন। তাকে আবার নানান পার্টিকে খুশি রাখতে হয়। আসলে পুরোটাই নিজে খাবে রানা। বীনার দালাল। নকল নাম। এ লাইনে কারো নাম প্রিন্স, কারো সম্রাট এমন হয়। রানা নামটাও এমন। বীনার নামও বীনা না। নাম জিনিসটা নিয়ে প্রথম প্রথম একটু খুঁতখুঁত লাগলেও এখন লাগে না। তার কাছে বীনা যা জরিনাও তা। তবে কিছু কিছু কাস্টমারের কাছে নাম একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। গত সপ্তাহে এক কাস্টমার আসে। শুরুতেই লাগল বীনার নাম নিয়ে।
‘তোমার নাম কী?’
‘কারিনা।’
‘ধুর পুরানা নায়িকা। নতুন কারো নাম বলো।’
‘নতুন নায়িকাদের নাম জানি না। আমি নিজেও পুরান। বয়স ছত্রিশ।’
‘তুমি আলিয়া ভাটরে চিনো না?’
‘না।’
‘তারপরও বলো।’
‘কী বলবো?’
‘তোমার নাম কী?’
‘আমার নাম কুসুম।’
‘ধুর! তুমি ধরতে পারতেছো না বিষয়টা! আমি তোমার নাম জিগাইসি।’
‘তামশা করেন? করতে পারেন। এইটা তো তামশা করনের জায়গা। তবে এই তামশা করলে দুইশ টেকা বখশিস দিতে হইবো।’
বীনাকে অবাক করে লোকটা চকচকে পাঁচশ টাকার নোট বের করে দিল।
‘জ্বি, আপনার সঙ্গে মিছা কতা কইসি। আমার নাম আলিয়া।’
এরপর লোকটা যা করা সব চোখ বুঁজে করলো। একটা বার তাকাল না। মুখ দিয়ে শুধু কয়েকবার বিড়বিড় করে নামটা বলল। বীনা বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছিল কিছুটা। তার কাছে বিষয়টা নতুন নয়। বীনার কাছে মনে হয় তার সঙ্গে সময় কাটাতে আসা প্রতিটি লোকই বিচিত্র। তবে আজকের এই লোক কোন দিক দিয়ে কী ঘটাবে, তা এখনো আঁচ করতে পারছে না বীনা।
‘একি! ঘুমিয়ে পড়লে! ওহ হো। ওকে ঘুমাও।’
‘জ্বি না, উঠেছি! সন্ধ্যা হয়ে গেল কখন!’
বীনা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে জানে। অনেক কষ্ট হয়ে শিখতে। তবে বাড়তি টাকার জন্য সে চাইনিজ ভাষাও শিখতে রাজি।
‘ঘুমালে আরেকটু ঘুমাও। বিশেষ তাড়া নেই।’
‘কিছু করবেন না?’
লোকটা উত্তর না দিয়ে অন্য দিকে তাকাল। লজ্জা পেয়েছে বলে মনে হলো না। আবার এমনও মনে হচ্ছে না যে ভাবনার জগতে হারিয়ে গেছে। সম্ভবত এ প্রশ্ন শুনেও সে অভ্যস্ত।
বীনার নিজের এখন বিরক্ত লাগছে। নরম বিছানা পেয়ে ঘুমের লোভ সামলাতে পারেনি। রাতের মধ্যে নিজের ডেরায় ফেরার কথা। অবশ্য সেটার বিশেষ তাগাদা নেই। তার অ্যাপার্টমেন্টে যেকোনো সময় ঢোকা যায়। দারওয়ানকে হাত করা আছে। অবশ্য রানা আজ আর ফোন দেবে না। আজ যা কামিয়েছে তাতে এক সপ্তাহ চলে যাবে তার।
‘তুমি এদিকে আসো। বাড়িতে ঘুরে বেড়াও। কোনো সমস্যা নেই। চাকরবাকরদের তোমার কথা বলা আছে। কেউ কিছু বলবে না। যা খেতে ইচ্ছে করবে বলবে। এনে দেবে।’
বীনা চোখ ডলে নিল। অনেক চেষ্টা করেও হাইটা চাপা দিতে পারলো না। বুঝতে পারল অবাক হওয়ার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে। আবার মনে হলো, সে অবাক হয়নি কারণ সে ধরতে পেরেছে লোকটার কোনো বদ মতলব আছে। বদ মতলব ছাড়া তার মতো মেয়েকে এত যতœ করার কথা না। নারী পাচারকারী না তো? রানা অবশ্য ঠিকানা জানে। পুলিশে খবর দিতে পারবে। রানাকে টাকা দিয়ে হাত করে ফেলে?
‘দেখুন, আমাকে চালান করার চিন্তা করে থাকলে বাদ দেন। আমি আউটকলে গেলে আমার এক বোনকে ঠিকানা দিয়ে যাই। ঘুমানোর আগেই তাকে ফোন করে ঠিকানা দিয়েছি। রাতের মধ্যে আমি বাসায় না ফিরলে ও থানায় ফোন দেবে।’
‘হাহাহা।’ লোকটা হাসতে গিয়েও আবার থেমে গেল। ‘তোমার বুদ্ধিটা ভালোই। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।’
‘আমাকে আপনার পছন্দ হলো কেন?’
লোকটা ভ্রƒ কুঁচকে তাকাল। বীনা বুঝতে পারল প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি।
‘তোমার ইচ্ছে হলে তুমি এখুনি চলে যেতে পারো।’
‘আপনার টাকা? কমিশনের টাকা আমি ফেরত দিতে পারবো না।’
লোকটা কিছু বলল না। কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘অথবা আমি তোমাকে আরো দশ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিতে পারি, যদি রাতটা থাকো। বোনকে বলে দাও সকালের মধ্যে না ফিরলে যেন পুলিশে ফোন দেয়।’
‘আর বিশ হাজার দেবেন।’
‘ওকে। দেব।’
হাসল লোকটা। হাসিটা দেখেই বীনার খারাপ লাগল। এমন নির্দোষ হাসি সে আগে দেখেনি। নাহ, লোকটার কাছ থেকে এভাবে বেশি টাকা নিতে খারাপ লাগছে। কিন্তু সে নেবে। ফেরত দেবে না। মনের খুঁতখুঁতে ভাব এখনো কাটেনি, আপাতত এটাই বড় কথা।
‘এদিকে এসো।’
ধক করে উঠল বুক। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে। মেরে টেরে ফেলবে না তো?
বীনা উঠে দাঁড়াল। জামা কাপড় ঠিকঠাক করে নিল। অন্য কাস্টমারদের মতো লোকটা তার বুকের দিকে তাকিয়ে নেই। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। লোকটার চোখের ভাষাও পড়া যাচ্ছে না। কী মুশকিল।
বেরিয়ে গেল লোকটা। বীনাও তাড়াহুড়ো করে ফলো করলো। এ বাড়িতে ঢোকার পরই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে বীনা। মনে হবে যেন অনেকগুলো ছোট ছোট বাড়ি মিলে একটা বাড়ি। মাঝে একটা হাঁটাচলার মতো রাস্তা। ভেতরে সিঁড়ি আছে দোতলায় ওঠার। বড় বড় ঝাড়বাতিতে ভরা। আলোর অভাব নেই। তবু বীনার মনে হচ্ছে সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তাদের পাশ কাটিয়ে দুজন কাজের লোক গেল। রান্না বান্না করছিল ওরা। বীনার দিকে ফিরেও তাকায়নি। বাড়ির পেছনের দিকে বাগান। সেখানে একটা বড় কাচে ঘেরা ড্রয়িং রুমের মতো। বাগানের চারপাশে উঁচু পাঁচিল। বাইরে থেকে কিছু দেখা যাওয়ার কথা নয়। ড্রয়িং রুমের মতো খোলা জায়গাটির মাঝে একটা সাদা চাদর দেওয়া তোষকের মতো রাখা। চারপাশে বালিশ ছড়ানো। আগের দিনের জমিদাররা এ ধরনের তোষকে শুয়ে হুক্কা টানতো আর বাইজিদের নাচ দেখতো। বীনা নাচটাচ জানে না।
‘ওখানে বসো।’
আচমকা কেমন যেন যন্ত্রের মতো শোনাল লোকটার কণ্ঠ। বীনাও বুঝতে পারলো খেলা শুরু হয়ে গেছে। এখন উল্টোপাল্টা করা যাবে না। বিশে বিশে মোট চল্লিশ হাজার। এখন নাচতে বললে নাচবেও। নরম গদিটাতে বসতেই গা এলিয়ে গেল। মনে হলো আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুমানো চলবে না।
লোকটা দেয়ালের কিছু সুইচ টিপলো। রুমের আলো বদলে যেতে লাগল। হালকা মিউজিকও কানে এলো। বীনার শীত শীত করছে। এসি বন্ধ করতে বলবে কিনা ভাবছে। রুমটার দুই দিকে কাচ। এক পাশ অন্ধকার। অন্ধকার দেয়াল কোনো আলো আসছে না। দেয়াল আছে কিনা সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। বীনা তাকিয়ে আছে সেদিকে। লোকটাকে দেখল। সেও অন্ধকার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন লজ্জামাখা মায়াময় দৃষ্টি। বীনা আচমকা আঁতকে উঠল। সামলেও নিলো সঙ্গে সঙ্গে। ধরতে পেরেছে বিষয়টা। ওই অন্ধকার অংশে কেউ একজন আছে। কেউ একজন তাদের দেখছে। তার জন্যই এত আয়োজন। বীনা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবল। চিন্তাভাবনা আপাতত চল্লিশ হাজার টাকার মধ্যে আটকে রাখল। তবু চোখ বারবার অন্ধকার অংশটাতেই যেতে চায়। আলোর প্রতিফলনে এক ঝলক টের পেয়েছে। বোঝা যায় এক ধরনের কালো কাচে ঢাকা ওপাশের দেয়াল। গাড়িতে দেখা যায় এমন কাচ। ভেতর থেকে দেখা যাবে, বাইরে থেকে নয়।
কে হতে পারে আড়ালের মানুষটা? লোকটাকে জিজ্ঞেস করবে নাকি? নাহ, তাতে পুরোটাই ভেস্তে যেতে পারে। অল্প কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বীনাকে সোজা ঘর থেকে বের করে দিতে পারে। বীনা খুব সাবধান হয়ে গেল।
লোকটা আর আটদশটা ক্লায়েন্টের মতো যে হবে না সেটা জানা কথা। বীনাকে স্পর্শ করার ভঙ্গি দেখে এটা বোঝা যায় যে এর আগেও অন্য কোনো মেয়ে এই রুমে এসেছিল। লোকটার অনভ্যস্ত হাত খানিকক্ষণ বীনার শরীর ঘুরে বেড়াল। কিছু খুঁজে পেয়েও পেল না। তাড়াহুড়ো নেই। হুট করে ঝাঁপিয়েও পড়ছে না। বীনা লোকটার মুখের দিকে তাকাল। এখন পর্যন্ত নাম জানা হয়নি লোকটার। নাম বাবদ বিশেষ আগ্রহ নেই যদিও। তবে বীনা এক ধরনের মায়া অনুভব করছে। সাধাসিধে লোকটা তার প্রেমিক হলে মন্দ হতো না। লোকটার ইচ্ছে নেই শারীরিক মিলনের। শুধু বীনা নয়, এটা যে কোনো মেয়েই বুঝতে পারবে। কিন্তু বীনার মতো লোকটাও এখন তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের ঊর্ধ্বে। বীনার চাই টাকা আর লোকটা আটকে আছে অন্য কোনো কারণে। ইশারা বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে কাপড় ছাড়তে শুরু করলো বীনা। আচমকা কলিং বেলের মৃদু টুংটাং শব্দ। লোকটা সচকিত। থামতে ইশারা করলো বীনাকে। অর্ধেক পথে ঝুলছে টপটা। মুখে কিছু বলল না লোকটা। চোখের ভাষা পড়েই যা কিছু বুঝে নিতে হচ্ছে। বীনাকে আরেকটু পর কাপড় ছাড়তে বলছে লোকটা। অন্যসময়কার জন্য এটাও স্বাভাবিক বলে মেনে নিত বীনা। কিন্তু ওই বেল বাজাল কে? কেন বাজাল। কাচের আড়ালে থেকে অদৃশ্য কারো নির্দেশ? যা মানতেই হবে লোকটাকে? যা খুশি হোক। চল্লিশ হাজার অনেক টাকা।
ধীরে ধীরে নগ্ন হলো দুজন। লোকটাকে দেখাচ্ছে পাথরের একটা মূর্তির মতো। নরম পাথরের মূর্তি। মূর্তির চোখে ভালবাসা উপচে পড়ছে। সেই উপচেপড়া ভালোবাসার কাছে ধীরে ধীরে নতি স্বীকার করতে শুরু করলো দেয়ালের পেন্ডুলাম ঘড়িটা।
দুজনেই যখন সময়জ্ঞান পুরোপুরি হারিয়ে ফেলল তখন শরীর কথা বলতে শুরু করলো নিজের ভাষায়। বীনার সমস্যা হলো না নিজেকে স্রোতে ভাসিয়ে দিতে। আনাড়ি লোকটাও নিজেকে হুটহাট সামলে নিতে শিখেছে। মাঝে মাঝে বীনাকে এমনভাবে আদর করতে শুরু করে দিল, যেন বীনা তার নেহায়েত অপরিচিত নয়। এমন প্রেমময় সাড়া পেয়ে অভ্যস্ত নয় বীনা। লোকটাকে কয়েকবার বাধ্য হয়েই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল ও। পরেই বুঝতে পারলো অভিনয় করতে হলে পুরোটাই করতে হবে। এর মাঝে কানে দুয়েকবার বেল বাজার শব্দ কানে এলেও সেটা নিয়ে আর ভাবলো না। কেউ দেখলে দেখুক। অদৃশ্য কারো নির্দেশ মানতে বাধ্য নয় সে। উল্টো বাড়তি পুলক অনুভব করার একটা সুযোগ পেয়ে গেছে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে থাকে বীনা। কাচের দেয়ালের আড়ালে যেন একজন নয়, হাজার হাজার দর্শক। কামোত্তেজনায় চোখ বুঁজে আসছে বারবার। চূড়ান্ত পর্যায়ের আগমুহূর্তে বীনাকে প্রচ-রকম জড়িয়ে ধরল লোকটা। বীনাও। এরপর যথারীতি বীনার কানে ফিসফিস করে উচ্চারিত হলো একটা নাম- রাবেয়া! আমার রেবু!
বীনারও কী হলো আচমকা। ছাড়তে চাইল না লোকটাকে। যেন তার অধিকার। কিন্তু সেও জানে নিয়মানুযায়ী এখন ঝটপট মাথা নিচু করে কাপড় পরবে ও অস্বস্তিকর একটা চেহারা নিয়ে ইতিউতি তাকাবে। হয়তো বা পানি খেতে চাইবে। বীনার তাড়া নেই। আজ আর বাসায় ফিরবে না ও।
‘তোমাকে গেস্ট রুমে নিয়ে যাবে একজন। রাতের খাবারও পৌঁছে দেবে ও।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘তুমি যাও, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। সকালে পেমেন্ট পাঠিয়ে দেব। চলে যেও।’
‘জ্বি।’
থামল লোকটা। মনে হলো আরো কিছু বলতে চায়। তবে বলল না। কাপড় পরে নিল। এরপর অন্ধকার সেই কাচের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আড়চোখে দেখল বীনা। লোকটা শুধু দাঁড়িয়েই আছে। কোনো কথা বলছে না। ইশারাও না।
‘তুমি চলে যাও।’
আদেশের মতো শোনাল এবারের কথাটা।
‘যাচ্ছি।’
উঠে দাঁড়াল বীনা। বলে দিতে হলো না বাকিটা। সে জানে কাচের আড়ালে কী আছে, কে আছে।
বীনা চলে যেতেই খুলে গেল সাইডিং কাচের একটি পাশ। ড্রয়িং রুমে বেরিয়ে এলো ওপাশের ঝলমলে আলো। কালো কাচের ওপাশে হুইলচেয়ারে আলুথালু বেশে বসে থাকা রমনীর চোখেমুখে হাসি। ঢুলুঢুলু চোখ। হাতে থাকা মদের গ্লাসে চুমুক দিল আরেকবার।
‘আজ তো বেশ দেখালে, আমারও একদম হয়ে এসেছিল।’
লোকটা কিছু বলল না।
‘বেশ রিয়েলিস্টিক ছিল। প্রেমে পড়ে যাওনি তো আবার?’
‘তুমি চাও সেটা?’
‘ওহ! মাই ডিয়ার হাজবেন্ড। ডোন্ট বি সো রুড। ইউ লাভ মি সো মাচ। বাট ইউ নো… আমি তো আর…।’
‘হয়েছে, চলো এবার। ডিনার খাবে। গ্লাসটা দাও।’
‘আর মাত্র দু পেগ।’
‘যথেষ্ট হয়েছে, দাও।’
‘বাস্টার্ড! হুইস্কিতে আর কী হবে! আমি তো তোমাতেই এডিকটেড। ইউ আর মাই কোকেইন। কামন.. গিভ মি আ কিস। দ্যাটস অ্যান অর্ডার ফ্রম ইওর বিলাভেড রাবেয়া দ্য রেবু।’
হুইলচেয়ারে বসা মেয়েটার গালে আলতো করে চুমু খেল লোকটা।
‘ওহ সো কিউট! মাই বেইবি!’
লোকটা মাথা নিচু করে আছে। এখনো চোখাচোখি হয়নি রাবেয়ার সঙ্গে। এ সময়টা ধাতস্থ হতে সময় লাগে তার।
হুইলচেয়ার ঠেলে রাবেয়াকে বেডরুম পর্যন্ত এনেছে। এরপর রুটিনমাফিক ঢুকে পড়েছে শাওয়ার নিতে। বেরিয়ে এসে রাবেয়াকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। বসিয়ে দিল খাবারের টেবিলে। টেবিল ভর্তি খাবার। রাবেয়ার পছন্দের রান্না সব। স্বামীর দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে কৌতুকের ছলে তাকাল রাবেয়া। এর মানেও জানা। নিজের হাতে খাবে না। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে স্ত্রীকে খাইয়ে দিল লোকটা। খেয়ে নিলো নিজেও।
‘এবার আমার সঙ্গে শোবে চলো। নাকি আবার ওই প্রসটার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে? সত্যি করে বল!’
‘ইচ্ছে করছে। যাব?’ কৌতুক করার চেষ্টা করলো লোকটাও। সুবিধা করতে পারল না।
‘নটি বয়। নো নো! এখন তুমি আমার। এখন আমার সঙ্গে ঘুমুবে। আমি যেভাবে চাইব সেভাবে ঘুমুবে।’
‘আমি সবসময়ই তোমার রাবেয়া!’
গলার স্বর কড়া করতে গিয়েও পারল না লোকটা। কখনই পারে না। রাবেয়াকে সে ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে। রাবেয়ার ইচ্ছেটা যতই বিকৃত দেখাক, লোকটা তার নিজের প্রেমের কাছে নিজেই বন্দি। যতই ভালো পারফরমার হোক না কেন, রাবেয়াই তার একমাত্র দর্শক। দর্শককে তৃপ্ত করতেই তো শিল্পীর যত চেষ্টা।