Tuesday, March 19
Shadow

রোমান্টিক হরর গল্প : দম্পতি

\

 

ধ্রুব নীল

‘আমার মনে হয় তোর ভাবী মানুষ না।’
‘অ্যাঁ!’
ঝেড়েকেশে সরাসরি কথাটা না বললেও হতো। কিন্তু সজল ভ‚মিকা করতে পারে না। কথা পেটে থাকলে চিনচিনে একটা ব্যথা করে তার।
‘তা হলে ভাবী কি অমানুষ? মানে তোর ওপর নিদারুণ…।’
‘আরে না! রেনুর মতো মানুষ হয় নাকি! ইয়ে মানে, ও অনেক ভালো। কদিন আগে আমার সামান্য জ্বর হয়েছিল, তাতেই পানিটানি ঢেলে একাকার অবস্থা। হে হে হে।’
‘অ্যাঁ!’
বার বার অ্যাঁ অ্যাঁ করা লোকটা হলো সজল সরকারের ভার্সিটি লাইফের বন্ধু ইন্দ্রজিত। ওর কাছেই মাঝে মাঝে পেটের কথা উগড়ে আসে সজল। আজও সন্ধ্যায় দুজনের আড্ডা চলছে শ্যামলী পার্কে।
‘তা হলে?’
‘বলছিলাম ও মানুষ না। অন্য কিছু। মানে.. ওই যে অশরীরী…।’ ধন্ধে পড়ে গেল সজল। তার স্ত্রী রেনু বাতাসে উড়ে বেড়ায় না। শরীরটা একটু রোগাপাতলা। তবে শক্তি আছে বেশ। পাড়ায় মারকুটে হিসেবে ভালো খ্যাতিও আছে। একবার তো দুই ছিনতাইকারীকে জুডোর প্যাঁচে খোড়া বানিয়ে দিয়েছিল। তাকে অশরীরী বলাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না।
‘আবার ওই দিন যেভাবে আমার দিকে তেড়ে এলো না..।’ থেমে গেল সজল।
ইন্দ্রজিত বলল, ‘ভাবী পরিটরি টাইপের কিছু?’
‘হতে পারে।’
‘বিয়ের দুই বছর হয়ে গেল। এতদিন টের পাসনি?’
‘টের পেলে তোকে অবশ্যই বলতাম। আমার পেটে কথা থাকে না।’
‘কবে! কিভাবে?’
‘আগে কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছিল। পাত্তা দেইনি। যেমন মৌসুম ছাড়াই কোথা থেকে পাকা আম নিয়ে হাজির। বলল কে যেন বিক্রি করেছে। কিন্তু গতকালের কথা ধর, গতকাল তাকে ফোন করে বললাম, আমার জাফরানি মালাই মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে। ও যেন অফিস থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসে। ও বলল ও অফিসে যায়নি। ছুটি কাটাচ্ছে। আমি বললাম, তা হলে আমিই না হয় নিয়ে আসব। কিন্তু বাসায় গিয়ে দেখি মিষ্টি হাজির।’
‘এ আর এমন কী।’
‘ঘটনা হলো আমি তাকে ফোন দিয়েছিলাম দুপুর বারোটায়। ও আমাকে বলল দুপুরে খেয়েদেয়ে বের হবে মিষ্টি কিনতে।’
‘এতে কী প্রমাণ হয়?’
‘মিষ্টির প্যাকেটে লেখা রসকদম্ব কোম্পানির নাম। আমার বাসা আদাবরে। আর রসকদম্বের দোকান ঝিগাতলায়। ছয় কিলোমিটার দূরে।’
পারলে কাগজকলম নিয়ে বসে ইন্দ্রজিত। ঘটনাটা মাথায় লিখতে তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তাই থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে গভীরভাবে শোনার চেষ্টা করছে।
‘এখন অংক মিলিয়ে দেখ। গতকাল দুপুরের পর থেকে এলাকায় হয়েছিল গণ্ডগোল। গাড়ি-রিকশা কিছুই চলেনি।’
‘তা হলে হেঁটে গেছে।’
‘রেনু আমাকে ইনবক্সে জানতে চেয়েছিল কী রান্না করবে। সেটা পৌনে দুটোর ঘটনা। তার মানে বের হতে নিশ্চয়ই দুটো দশ-পনের বা আড়াইটা বাজার কথা। আর যদি রিকশা নিয়েও যায়, আসা-যাওয়ায় ঘণ্টাখানেক যাবে। মানে কিছুতেই সাড়ে তিনটা বা চারটার আগে মিষ্টির প্যাকেট হাতে তার বাসায় ফেরার কথা না।’
‘তুই কী করলি?
‘আমার কলেজের ক্লাস নেওয়া শেষ হয়ে গেল আড়াইটার দিকে। ভাবলাম বসে থেকে কী হবে। মোটরসাইকেল নিয়ে এক টানে গেলাম বাসায়। বাজে তিনটা। চাবি দিয়ে দরজা খুলতে যাব, দেখি..।’
‘বলিস কী! তিনটা বাজেই মিষ্টি হাজির! তা ফ্রিজে কি এখনো আছে দুয়েকটা? গেলে পাওয়া যাবে?’
সজলের কড়া দৃষ্টি দেখে সিরিয়াস হলো ইন্দ্র।
‘তুই বল, এটা কিভাবে সম্ভব!’
‘ভাবীকে সরাসরি জিজ্ঞেস কর। মামলা চুকে যাক। নাকি কোনো হোম ডেলিভারি অ্যাপ…।’
‘আমি ওটাও চেক করেছি। ওর ফোনে তেমন কোনো অ্যাপ পাইনি।’
‘তাহলে সরাসরি জিজ্ঞেস কর।’
‘কী বলবো? অ্যাই শুনছো তুমি কি পরী? মানে অশরীরি কিছু? এরপর কী হবে ভেবে দেখ! ও যদি সত্যি পরীটরি হয়, তবে ভীষণ কষ্ট পায়? দেখা যাবে আমাকে ছেড়ে… নাহ, কিছুতেই বলতে পারব না। এখন কী হবে! আমার পেটের ব্যথাটা আরো বাড়বে! কারণ পেটে কথা থাকলে গ্যাস্ট্রিক জাতীয় একটা ব্যথা হয়। এই ব্যথা খুব ভয়াবহ। আগে থেকেই আছে।’
‘তুই ভয় পাচ্ছিস না তো? মানে ওই টাইপের ভয়? ভ‚তপ্রেত জাতীয়।’
‘মানুষ হোক যাই হোক, ওর মতো বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমাকে খুব ভালোবাসে। ওকে ভয় পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
‘হুমম। কিন্তু রাতে ভয় টয় করবে না তোর?’
‘ওকে ভয় করবে কেন! আরে ওর ভয়ে আমার বাসায় চোরটোরই আসে না! ও যা কুংফু কারাতে জানে। কিন্তু সমস্যা একটাই। সেটা হলো আমার পেটে। মানে পেটে কথা আটকে রাখলেই সত্যিই ব্যথা করে। অনেক দিন ধরে একটা পুরনো ব্যথা এমনিতেই আছে। একেবারে আলসার টাইপের ব্যথা।’

আড্ডা শেষে কাঁচাবাজারে একপাক ঘুরে বাসায় ফিরে এলো সজল। ঢুকতেই রেনুর ভার ভার চেহারা দেখে মিইয়ে গেল।
‘মালাই মিষ্টি তো দেখছি ছুঁয়েও দেখছো না। ঘটনা কী!’
‘দুটো তো খেলাম।’
‘অন্য সময় হলে তো প্যাকেট সাবাড় করে ফেলতে। নাকি বিনুর বিয়েতে যেতে বলেছি দেখে এমন করছো।’
‘আরে এর সঙ্গে বিয়ের দাওয়াতের কী সম্পর্ক। ও তোমার এত দিনের বান্ধবী। ওর বিয়েতে তো যাবই। তা অনেকদিন তোমার মামাকে আসতে দেখি না। একদিন বলো ঘুরে যাক।’
‘এর মধ্যে আবার মামার কথা টেনে আনলে কেন? মামা বেড়াতে যেতে চায় না কোথাও। একা মানুষ একা থাকতে চায়।’
‘উনি বিয়ে করলেন না কেন?’
‘এই নাও ফোন। ফোন করে জিজ্ঞেস করো, মামা আপনি বিয়ে করেননি কেন!’
ছোট ঝগড়াটা বড় ঝগড়ার দিকে মোড় নেওয়ার আগেই সজল ভেতরের রুমে চলে গেল। অন্যসময় হলে তাল মেলানো যেত। এখন নেমেছে গোয়েন্দার ভ‚মিকায়। সূক্ষ¥ দৃষ্টি রাখতে হবে রেনুর কাজেকর্মে। মামার প্রসঙ্গ টেনেছে ইচ্ছে করে। রেনু মানুষ না হলে তার মামাও মানুষ হবার কথা না।
এদিকে পেটের ব্যথাটা বেড়েছে। কথা আটকে রাখার ব্যথা। বাজারের প্রায় সব ধরনের গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট খেয়ে দেখেছে সজল। কাজ হয় না।
‘আচ্ছা তোমার এক চাচির কথা বলতে প্রায়ই। কী যেন নাম।’
‘আমার মামা-চাচাদের পেছনে লাগলে কেন বলতো? উনারা চোর-ডাকাত না! একটু চুপচাপ আর নিরিবিলি থাকতে চান তারা। কী চাও তুমি তাদের কাছে? যৌতুক লাগবে?’
‘হে হে হে। এক ঘড়া স্বর্ণ পেলে মন্দ হতো না। এনে দিতে পারবে নাকি!’ কৌতুক করে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করল সজল।
‘ঘড়া জিনিসটা আবার কী?’
জানে না সজল। ডিকশনারি দেখে জেনে নিল অর্থটা। ঘড়া মানে পিতলের কলসি। জিনপরীরা মানুষকে ঘড়ায় করে স্বর্ণ দেয় শুনেছে। যদিও এটা সে বিশ্বাস করে না। কিন্তু সেটা বলতে গেল না রেনুকে। তার আগেই চিতই পিঠা আর চা হাজির। আনন্দে চোখে পানি আসার দশা সজলের। এমন স্ত্রীকে সে কিনা…।
‘তুমি মানুষ না! বুঝলে!’
‘কী বললে!’
‘মানে তুমি মহারানী। না না মহারানীও না। তুমি হলে সুলতানা রাজিয়া।’
‘ও আবার কে! হু ইজ সুলতানা!’
সজল হাসতে হাসতে কামড় বসাল পিঠায়।
‘সুলতানা রাজিয়া হলো ভারতবর্ষের প্রথম নারী…।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই বদলে গেল দৃশ্যপট। শুরু হলো দমকা হাওয়া। সঙ্গে বজ্রপাত।
ব্যালকনিতে চলে গেল রেনু। ঠাÐা বাতাস। জানালার পর্দায় উথাল পাথাল চলছে। ঝড়টা এসেই গেল।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে চায়ের কাপ হাতে বসে আছে সজল। কাছেপিঠে ঘন ঘন বাজ পড়ছে। প্রতিবার বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে দেখতে পাচ্ছে রেনুর খোলা চুল পতপত করে উড়ছে। বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে সে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে দেখছে দানব মেঘের হুড়োহুড়ি।
সজলের ভয় লাগছে না। বরং ইচ্ছে করছে রেনুর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু বজ্রপাতকে ভয় পায় বলে ইচ্ছেটা দমিয়ে রেখেছে।
‘মিষ্টিগুলো খেলে মরবে না বুঝলে!’ রেনুর কথায় অভিমান উপচে পড়ছে। সজল ভাবল, এখুনি গিয়ে কপাকপ সব মিষ্টি খেয়ে ফেলে। বেচারি এত কষ্ট করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু পিঠা খেয়ে তার পেট ভরে গেছে।
‘মিষ্টি নিয়ে আমার সমস্যা নেই। কোনো কিছু নিয়েই সমস্যা নেই। তুমি যথেষ্ট মিষ্টি। তুমি চা বানালে চিনিও লাগে না।’
রোমান্টিক কথা কিভাবে বলতে সেটা সজল জানে না। এখন তার কথা শুনে মনে হলো সে তার ক্লাসে পদার্থবিজ্ঞানের লেকচার দিচ্ছে।
‘তোমার কী মনে আছে বিয়ের প্রথম দিককার কথা?’
খানিকটা কোমল হলো রেনুর গলা।
‘কোন কথা?’
‘আমি তোমাকে বললাম আমার খুব বকুল ফুলের মালা পরতে ইচ্ছে করছে। আর তুমি চট করে বের হয়ে গেলে।’
‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ! বকুল ফুল। মনে পড়েছে। সেদিনের ঘটনা। আহা, দেখতে দেখতে দুই বছর।’
‘তখন আমার চাকরি ছিল বিরামপুরে। তোমার ঢাকায়। আমার ডরমেটরিতে মিনি সংসার। মফস্বল এলাকা। চারদিক সুনসান। অনেক গাছপালা।’
‘হুম। বৃষ্টিও হচ্ছিল।’
‘আমি খিচুড়ি রান্না করছি, আর তুমি চট করে বের হয়ে গেলে। দশ মিনিটের মধ্যে একগাদা বকুল ফুল নিয়ে হাজির হলে।’
‘হ্যাঁ.. মালা তো পাব না। তাই শুধু ফুল এনেছিলাম।’
‘কিন্তু সজল, বিরামপুরের ওই এলাকার দুই মাইলের মধ্যে একটাও বকুল গাছ ছিল না।’
বিদ্যুৎ চলে এলো। আলোয় আলোয় ভরে গেল সব রুম। ঝড় থেমে যাচ্ছে। রেনুর চুল উড়ছে না। কপালে লেপ্টে আছে। সজল চুপ করে তাকিয়ে আছে রেনুর দিকে। রেনু আড়চোখে সজলকে দেখে একটুখানি হাসল। সজল টের পেল তার পেটের ব্যথাটা পুরোপুরি গায়েব।

[লেখাটি ভালো লাগলে আমাদের লেখকদের জন্য নামমাত্র সম্মানি  পাঠাতে পারেন নগদ-এ নম্বর 01407-885500]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!