আধুনিক বিজ্ঞানের যে শাখায় আলোর সঙ্গে বস্তুকণার যান্ত্রিক বন্ধন নিয়ে গবেষণা চলে, সেটিকে বলা হচ্ছে ‘অপটোমেকানিক্স’। আর এই অপটোমেকানিক্সে সাম্প্রতিক এক আবিষ্কার বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে ভবিষ্যতে। আবিষ্কারটা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের বিজ্ঞানীরা। পরমাণুর দুটি স্তরের মাঝে তারা এমন এক ধরনের কম্পন শনাক্ত করেছেন, যেটিকে তারা নাম দিয়েছেন পরমাণুর নিঃশ্বাস। আর এই ‘নিঃশ্বাস’-এর বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে সামনের দিনগুলোতে কোয়ান্টাম ইনফরমেশন আদান-প্রদানের প্রযুক্তি তৈরি করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন গবেষকরা। নেচার ন্যানোটেকনোলজি জার্নালে প্রকাশ হয়েছে এর বৃত্তান্ত।
‘এটি নতুন ধরনের কোয়ান্টাম এফেক্ট সম্পর্কে জানিয়েছে। যার মাধ্যমে একটি ফোটন কণাকে একটি সুনির্দিষ্ট অপটিক্যাল কাঠামোর ভেতর চালানো যাবে।’ জানালেন গবেষণার দলের প্রধান মো লি।
এর আগে এই একই গবেষণা দল ‘এক্সাইটন’ নামের একটি কোয়ান্টাম-পর্যায়ের কণা আবিষ্কার করেছিলেন। ওই এক্সাইটনের ভেতর তারা কোয়ান্টাম পর্যায়ের একটি তথ্য প্রবেশ করিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন ওই তথ্য পরে আবার ফোটন (আলোর কণা) আকারে বের হয়ে যায়। এক্ষেত্রে মূলত পোলারাইজড ফোটন (নির্দিষ্ট দিকে সেট করা ফোটন করার ঘূর্ণন গতি) ব্যবহার করে গবেষকরা তৈরি করেছিলেন কোয়ান্টাম তথ্যের একক, যার আরেক নাম কিউবিট। যেটিকে বলা হয় কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের প্রাণ।
সাম্প্রতিক গবেষণায় গবেষকরা কোয়ান্টাম তথ্যবাহী সিঙ্গেল ফোটন এমিটার তৈরি করতে টাংস্টেন ও সেলেনিয়ামের তৈরি টাংস্টেন-ডাইসেলেনাইড বস্তুটির দুটি সূক্ষ্ম স্তরকে ওপর-নিচ অবস্থায় রাখেন। এরপর তাতে সুনির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের লেজার রশ্মি ফেলা হয়। তাতেই টাংস্টেন-ডাইসেলেনাইড থেকে একটি ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন হয়। তৈরি হয় একটি এক্সাইটন। ওই এক্সাইটনের এক স্তরে থাকা ইলেকট্রনটিতে থাকে নেগেটিভ চার্জ, আর বিপরীতে থাকে একটি ধণাত্মক চার্জ বিশিষ্ট সূক্ষ্ম গর্ত (হোল)। খানিক পর ইলেকট্রনটি বিপরীত শক্তি আকর্ষণে যখন আবার নিজের গর্তে তথা কক্ষপথে ফিরে যায়, তখন এক্সাইটনটি একটি কোয়ান্টাম তথ্যযুক্ত ফোটন কণা নির্গত করে। আর এ ধরনের কোয়ান্টাম তথ্যযুক্ত ফোটন কণা নির্গত করাই হলো কোয়ান্টাম এমিটারের মূল কাজ।
এ ঘটনা যখন ঘটে, তখন টাংস্টেন ডাইসেলেনাইড থেকে নির্গত আরও একটি কণা ধরা পড়েছে গবেষকদের সেন্সরে। ওটা হলো ফোনোন। এই ভরহীন কণাটি হলো পরমাণুর কম্পনের ফলে সৃষ্ট এক ধরনের শক্তি। ওটাকেই গবেষকরা পরমাণুর নিঃশ্বাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ব্যাপারটা অনেকটা আমাদের হাঁপানোর মতো। আমরা যদি আচমকা লাফ দিই বা দৌড়ানো শুরু করি, তখন আমরা যেভাবে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিই, পরমাণুর ক্ষেত্রেও দেখা গেল একই ব্যাপার ঘটছে।
‘এই যে কম্পন, এটার প্রভাব পড়ে এক্সাইটন থেকে নির্গত সেই ফোটনের ওপর। ফোটনের অপটিক্যাল কিছু বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে সেই কম্পন। এমনটা আগে কখনো কোনো পরীক্ষায় ধরা পড়েনি।’ জানালেন লি।
গবেষকরা জানালেন, তারা এখন সেই কম্পনের কণা ফোনোনটাকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না, সেটি দেখছেন। ওই দশার ওপর বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করে তারা এটি দেখতে পেয়েছেন ফোনোনগুলোর ওপর প্রযুক্ত শক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত সেই ফোটনের একটা সম্পর্ক আছে। ব্যাপারটাকে সরল করে বললে এমন হয়—হাঁপানো বা নিঃশ্বাসের গতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যক্তি কতটা পথ দৌড়ে এসেছে।
লি ও তার দল এখন একটি ওয়েভগাইড তৈরির প্রচেষ্টায় আছেন। মাইক্রোচিপের ওপর অপটিক্যাল ফাইবার বসিয়ে তারা সেই বিচ্ছুরিত তথ্যবাহী ফোটনটাকে ধরে একটা নির্দিষ্ট পথে চালনা করতে পারলেই কাজ এগিয়ে যাবে অনেকদূর। আর পুরো ব্যাপারটাকে বড় আকারে চিন্তা করলে, অর্থাৎ আরও অনেকগুলো কোয়ান্টাম এমিটার যখন একসঙ্গে কাজ করবে ও সবগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তখন কোয়ান্টাম এমিটারগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে ‘কথা বলতে’ পারবে আর তাতেই তৈরি হবে একটি শক্তিশালী কোয়ান্টাম সার্কিট।
লি জানালেন, ‘এখন লক্ষ্য হলো এমন কোয়ান্টাম এমিটার বানানো, যা একটি একাকী ফোটনকে নির্দিষ্ট অপটিক্যাল সার্কিটে চালনা করতে পারবে এবং নতুন আবিষ্কৃত ফোনোনের মাধ্যমে কোয়ান্টাম দশা পড়া যাবে ও গণনা করা যাবে এমন কিছু তৈরি করা।’