আমাদের দেশে বিভিন্ন গৃহপালিত পাখির মধ্যে কবুতর সর্বাধিক জনপ্রিয়। কবুতরকে সহজেই পোষ মানানো যায়। কম পরিশ্রম এবং অল্প পুঁজিতে কবুতর পালন করে পরিবারের আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। তাই এখন গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে শহরের বাসা-বাড়িতে অনেকে কবুতর পালন করে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। পরিবারের গৃহকর্ত্রী ও স্কুল কলেজ যাওয়া ছেলে-মেয়েরা বাড়ির যেকোনো কোণে বা আঙিনা অথবা বাড়ির ছাদে কিংবা কার্নিশের মতো ছোট বা অল্প জায়গাতেও কবুতর পালন করে বাড়তি আয়ের সংস্থান করতে পারে। আসুন জেনে নেই কিভাবে অল্প পুঁজিতে কবুতর পালন করা যায়।
কবুতর পালনের সুবিধা:
১.কবুতর সহজে পোষ মানে, বিনিয়োগ কম, প্রতিপালন অত্যন্ত সহজ এবং সংক্ষিপ্ত প্রজননকাল হওয়ায় পালন করা সহজ।
২.কবুতরের মাংস সুস্বাদু পুষ্টিকর, সহজ পাচ্য এবং প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পুরণের উৎস। কবুতরের মাংস খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর।
৩.একজোড়া কবুতর থেকে মাসে ২ টি করে বাচ্চা পাওয়া যায় এবং ২১-২৮ দিনের মধ্যে বাচ্চা খাওয়ার উপযোগী হয়।
৪. অল্প পুঁজি এবং কম পরিশ্রমে কবুতর পালন করে অধিক লাভবান হওয়া যায়।
৫. কবুতরের খাবারের খরচ কম লাগে এবং অল্প খরচেই কবুতরের থাকার ঘর তৈরি করা যায়।
৬. কবুতরের রোগবালাই কম হয় ফলে মৃত্যু ঝুঁকি কম ও পালন সহজ।
৭. কবুতরর পালনে বেকার যুবক এবং দুস্থ মহিলাদের আয় বর্ধনের উৎস হতে পারে।
৮. কবুতরের মল জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
কবুতরের জাত:
দেশি | শোভাবর্ধনকারী | মাংস উৎপাদনকারী | রেসিং | ফ্লাইং |
১. সিরাজী | ১. ক্যারিয়ার | ১. কিং- সাদা, কালো, সিলভার, হলুদ ও নীল | ১. হর্স ম্যান | ১. হর্স ম্যান |
২. গিরিবাজ | ২. মালটেজ | ২. আমেরিকান জায়ান্ট হোমার | ২. রেসিং হামার | ২. বার্মিংহাম রোলার |
৩. জালালী | ৩.হোয়াইট ফাউন্টেল | ৩. রান্ট | ৩. কিউমুলেট | |
৪. লোটন | ৪. পোটারস | ৪. কারনিউ | ৪. ফ্লাইং টিপলার/ফ্লাইং হোমার | |
৫. বোম্বাই | ৫. নান্স | ৫. মনডেইন- সুইস, ফ্রেন্স | ৫. থাম্বলার | |
৬. বাংলা |
বাংলাদেশের দেশি এবং মাংস উৎপাদনকারী কবুতর সর্বত্র পালন হয়ে থাকে যা পরিবারের পুষ্টি সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। সৌখিন লোকেরা খেলাধুলা বা আমোদ ফুর্তির জন্যও বিভিন্ন জাতের কবুতর পালন করে থাকে। তবে বর্তমানে রেসিং, ফ্লাইং এবং শোভাবর্ধনকারী কবুতর শখের বসে বা বাণিজ্যিক ভিক্তিতে পালন করে যুগান্তকারী সাফল্য সৃষ্টি করেছে।
কবুতরের জীবনক্র:
কবুতরের জীবনকাল ১২ থেকে ১৫ বছর। পুরুষ ও স্ত্রী কবুতর জোড়া বেঁধে তাদের জীবন পরিক্রমায় সাধারণত একসাথে বাস করে। স্ত্রী কবুতর ৫ থেকে ৬ মাস বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে। ২৮ দিন পরপর ৪৮ ঘন্টার ব্যবধানে দুইটি ডিম দেয় এবং পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত দেয়া ডিমে বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতা সক্রিয় থাকে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ই তাদের ডিম পালাক্রমে তা দেয়। কবুতরের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে ১৭ থেকে ১৮ দিন সময় লাগে। ডিমে তা দেয়ার ১৫-১৬ দিনের মধ্যে স্ত্রী ও পুরুষ উভয় কবুতরেরই খাদ্য থলিতে এক ধরনের দুধ জাতীয় বস্তু তৈরি হয় যা খেয়ে বাচ্চারা ৪ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে। কবুতর তাদের বাচ্চাকে ১০ দিন পর্যন্ত ঠোঁট দিয়ে খাওয়ায় এরপর বাচ্চারা দানাদার খাদ্য খেতে আরম্ভ করে।
বাসস্থান:
কবুতরের পালনের জন্য ভালো বাসস্থান প্রয়োজন। পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে, উত্তম নিষ্কাশন এবং বাতাস চলাচল আছে এরকম উঁচু এবং বালুময় মাটিতে কবুতরের ঘর তৈরি করতে হয়। খামারির আবাসস্থল থেকে ২০০ থেকে ৩০০ ফুট দুরে ও দক্ষিণমূখী হওয়া উচিত। কবুতরের ঘরটি মাটি থেকে উচ্চতা ২০ থেকে ২৪ ফুট এবং খাচার উচ্চতা ৮ থেকে ১০ ফুট হলে ভালো হয়। একটি আদর্শ খামারের জন্য ৩০ থেকে ৪০ জোড়া কবুতর থাকা প্রয়োজন। ছোট আকারের প্রতিজোড়া কবুতরের জন্য ৩০ সে.মি., ২০ সে.মি. এবং বড় আকারের কবুতরের জন্য ৫০.x ৫৫ সে.মি. খোপের আয়তন হতে হবে। এ ছাড়া কবুতর পালন সুবিধার জন্য কবুতরের ঘর ২-৩ তলা করা যায়। কবুতরের ঘর কম খরচে সহজে স্থানান্তরযোগ্য যা কাঠ, টিন, বাঁশ, খড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা যায়। কবুতরের খামারের ভিতরে নরম, শুষ্ক খড়-কুটা রেখে দিলে তারা সুবিধা মতো ঠোঁটে করে নিয়ে নিজেরাই বাসা তৈরি করে নেয়।
কবুতরের খাবার ব্যবস্থাপনা:
কবুতরের খাবারে শ্বেতসার, চর্বি, আমিষ, খনিজ, ভিটামিন প্রভৃতি থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি কবুতর তার দেহের প্রয়োজন এবং আকার অনুযায়ী খাবার খায়। কবুতর প্রধানত মটর, গম, ভু্ট্টা, খেশারী, যব, সরিষা, চাল, ধান, কলাই ইত্যাদি শস্য দানা খেয়ে থাকে। একটি কবুতর দৈনিক প্রায় ৩০-৫০ গ্রাম পর্যন্ত খাবার খেয়ে থাকে।
পানি সরবরাহ:
প্রতিদিন কবুতরের পানির পাত্র ভালভাবে পরিষ্কার করে ৩ বার পরিষ্কার পরিচছন্ন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা উচিত। পটাশ মিশ্রিত পানি দুই সপ্তাহ পর পর সরবরাহ করলে পাকস্থলী বিভিন্ন জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে।
কবুতরের কিছু রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা নিচে দেওয়া হল:
রোগের নাম: পাসটিউরেলা মালটোসিডা।
লক্ষণ: ডাইরিয়া, জ্বর বা কোনো লক্ষণ ছাড়াই কবুতর ২৪-৪৮ ঘন্টা মধ্যে মারা যায়।
চিকিৎসা: কবুতরের এ অবস্থা দেখা দিলে এন্টিবায়োটিক সেনসিটিভিটি টেস্ট করে সঠিক এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে এবং সেই সঙ্গে ভিটামিনস ও মিনারেলস খাওয়াতে হবে।
প্রতিরোধ: কবুতরকে নিয়মিত টিকা প্রদান করতে হবে।
রোগের নাম: সালমেনেলোসিস/ প্যারাটইফোসিস।
কারণ: সালমোনেলা টাইফিমিউরিয়াম।
লক্ষণ: পাখির দুর্গন্ধযুক্ত ডায়রিয়া ও শ্লেষ্মাযুক্ত আঠালো, ফেনা দেখা দেয়। দেহ ক্রমাগত শুকিয়ে যায়। পক্ষাঘাত দেখা দেয় এবং পাখি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
চিকিৎসা: এন্টিবায়োটিক সেনসিটিভিটি টেস্ট করে সঠিক এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে এবং ভিটামিনস ও মিনারেলস খাওয়াতে হবে।
প্রতিরোধ:
১। টিকা প্রদান করতে হবে।
২। জীব নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে।
রোগের নাম: ডিফথেরো স্মল পক্স (বসন্ত রোগ)।
কারণ: বোরেলিয়া কলাম্বরি ভাইরাস।
লক্ষণ: কবুতরের পালক পড়ে যায় চোখ, ঠোঁটের চারপাশে এবং পায়ে ক্ষত বা পক্স দেখা যায়।
চিকিৎসা: অ্যান্টিবায়োটিক, এমাইনো এসিড, ভিটামিন এ এবং সি, ইমিউনো স্টিমুলেটর, টপিক্যাল আইওডিন।
প্রতিরোধ: জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে।
রোগের নাম: পরজীবী রোগ
কারণ: ট্রাইকোমোনা, এসকারিস, আইমেরিয়া, ক্যাপিলারিয়া।
লক্ষণ: পাখি দুর্বল হয়ে শুকিয়ে যায় এবং খাদ্য গ্রহণে অনীহা দেখা দেয়। ডাইরিয়া (মলে রক্ত থাকে, ককসিডিয়া), পুষ্টিহীনতা ও শেষ পরণতি মৃত্যু ঘটে।
চিকিৎসা: ভিটামিন ও মিনারেল প্রিমিক্স, কৃমিনাশক, এমাইনো এসিড।
প্রতিরোধ: রোগ প্রতিরোধে জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে।
আর্থিক লাভ:
পরিকল্পিত এবং সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনায় কবুতর পালনে নিশ্চিত সাফল্য। তাই বর্তমানে দেশের অনেকেই কবুতর পালনে নিজেকে নিয়োগ করেছে। দেশি জাতের ৩০ জোড়া কবুতরের পালনের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ৫,৪০০/- টাকা বিনিয়োগ করে এক বৎসরে প্রায় ৪,৬০০/- টাকা লাভ করা যায় কিন্তু উন্নত বা সৌখিন জাতের ৩০ জোড়া কবুতর পালনে প্রাথমিকভাবে ১,৯৫,২০০/- টাকা বিনিয়োগ করে এক বৎসরে প্রায় ১,০৫,৩০০/- টাকা লাভ করা যায়।