দেশের মাঠে ক্রিকেট উপস্থাপনা করেছেন। কিন্তু মডেল জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়ার লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে উপস্থাপনা করা। ইংল্যান্ডে চলতি বিশ্বকাপেই এল সেই সুযোগ। বিশ্বকাপের বিভিন্ন ম্যাচে তাঁকে দেখা যাচ্ছে উপস্থাপকের ভূমিকায়, নিচ্ছেন তারকা ক্রিকেটারদের সাক্ষাৎকার। মাঠ ও মাঠের বাইরের অভিজ্ঞতা লিখেছেন পিয়া।
আমার পেশাজীবন শুরু হয় ১৬ বছর বয়সে, মডেলিং দিয়ে। সঙ্গে কিছু সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় দেশে ও বিদেশে অংশ নিয়ে মুকুট অর্জন করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। তারপর কিছু নাটক আর সিনেমাতেও কাজ করলাম। হঠাৎ করেই ক্রিকেট উপস্থাপনায় আসা। জিটিভির (গাজী টিভি) আমান ভাই খুব উৎসাহ দিলেন। তাঁর ভিশনের কথা দুই বছর আগেই জানিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উপস্থাপনায় যেন বাংলাদেশের মেয়েরা আসতে পারে, সেই লক্ষ্যে কাজ করতে বলছিলেন।
ক্রিকেট নিয়ে জ্ঞান বাড়িয়ে নেওয়া যাবে কিন্তু ইতিবাচক জ্ঞান থাকতে হবে। সে জন্য ক্রিকেট নিয়ে আরও পড়াশোনার পাশাপাশি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিরিজগুলো বাংলাদেশে উপস্থাপনা করলাম। কী করিনি! রাতভর ক্রিকেট নিয়ে আড্ডা, উচ্চারণ যেন ঠিক থাকে, সে জন্য বিভিন্ন লেখা পড়ে, রেকর্ড করে আমান ভাইকে পাঠানো, তাঁর মতামত বা ফিডব্যাক নিয়ে আবার ঠিক করা। সম্মানী, সময় বা অন্য কাজ—কোনো দিকে না তাকিয়ে একনাগাড়ে কাজ করেছি দুই বছর। তখন জিটিভির সবার অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। সর্বশেষ বিপিএলে যখন ট্রল করা হয়, তখন বলেছিলাম আমাকে নিয়ে যাঁরা পেছনে কথা বলেন, তাঁরা পেছনেই থাকবেন। হঠাৎ একদিন দেখবেন, আমি আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্টে উপস্থাপনার কাজে থাকব। কিন্তু আসলে সেটা যে বিশ্বকাপ হবে এবং এত তাড়াতাড়ি হবে, তা বুঝিনি।
এবারের বিশ্বকাপে আসি। বায়োস্কোপের হয়ে জিটিভির প্রযোজনায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে উপস্থাপনার জন্য আমাকে পাঠানো হলো। ৫৫টি জামা আর ২২ জোড়া জুতা নিয়ে শুরু হলো আমার যাত্রা। বিমানবন্দরেই পেয়ে গেলাম জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার আবদুর রাজ্জাক আর জয়া আপুকে (অভিনেত্রী জয়া আহসান)। তাঁরা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে তারকা অতিথি হয়ে যাচ্ছেন। জয়া আহসানের সঙ্গে আগে চোরাবালি সিনেমায় কাজ করলেও এত গল্প হয়নি। আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্য তাঁর চেয়ে ভালো কেউ হতে পারে না। আর রাজ্জাক ভাই তো অসাধারণ ও সহজ–সরল মানুষ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগেই খবর এল, ওভাল কিনিংটন লন্ডন থেকে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড (অনুমোদনপত্র) তুলতে হবে। পরের দিন সকালে খেলা। তার আগেই আমাদের প্রি–ম্যাচ শো। তারপর আয়োজন ও আমাদের প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলছিলাম মাঠের কোন জায়গায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি হবে, তা নিয়ে। আর কোন খেলোয়াড়ের সাক্ষাৎকার নেব। পাশেই দেখলাম ওয়াসিম আকরামরা একটা রুমে যাচ্ছেন। শুনলাম সেখানে আতহার আলী খানও আছেন। সেখানে ধারাভাষ্যকারদের সভা হচ্ছে। কারণ, পরের দিনই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ।
এবার তো ওভালকে নিয়ে বলতে হয়, শুধু ওভাল নয়; বরং ওভালের আশপাশে কেনিংটনও বিশ্বকাপের সাজে সজ্জিত। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। সব শেষ করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেতে যেতে দেরি হয়ে যাবে দেখে তৈরি না হয়েই সরাসরি ছুটলাম বাকিংহাম প্যালেসের দিকে। ট্যাক্সি অনেক আগেই থামিয়ে দিল। নিরাপত্তার কারণে অনেক আগে থেকে পথ বন্ধ। কাছে গিয়ে দেখলাম জয়া আহসান আর আবদুর রাজ্জাক সকাল থেকে উপস্থিত। ঠান্ডায় সবার অবস্থা কাহিল। সবার হাতে কফির মগ। ঢুকতেই কাকে যেন দেখলাম খুব পরিচিত। ও মাই গড! ব্রেট লি। ছোটবেলাতে যখন খেলা বুঝতাম না, তখন থেকেই তাঁকে খুব ভালো লাগত। ছবি তুলতে কিন্তু ভুল করিনি। পাশেই ফারহান আক্তার, মালালা ইউসুফজাই। এ রকম আরও অনেকে। ভাবলাম, এখানে কমপক্ষে একজনের সাক্ষাৎকার নিতেই হবে। যদিও এঁরা সবাই খুব ব্যস্ত। কার নেওয়া যায়? তখনই চোখ পড়ল স্যার ভিভ রিচার্ডসের ওপর। তিনি এত বিনয়ী, অবাক না হয়ে পারলাম না। তাঁকে বললাম, আমি পিয়া, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় হবে কি না। তিনি তখনই বললেন, ‘অবশ্যই।’
ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে অনেক আলাপচারিতার মধ্যে একপর্যায়ে জানতে চাইলাম, আয়ারল্যান্ডে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনাল দেখেছেন কি না। তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘দেখেছি।’ আরও বললেন, ‘তোমরা অনেক ভালো খেলেছ এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছ। এই কথোপকথনের পর ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে প্রায় এক সপ্তাহ পরে আবার দেখা হলো। তখন বললেন, ‘মিস বাংলাদেশ কেমন আছ?’ বিদেশের মাটিতে এমন সম্মান কজনাই–বা পায়।
একটু পর বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া প্রতিটি দেশের জাতীয় সংগীত শুরু হলো। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’…যখন বাজতে শুরু করল, শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যে ছোট একটা অনুষ্ঠান হলো। এখানে বাংলাদেশ থেকে জয়া আহসান আর আবদুর রাজ্জাক মিলে ২২ রান করলেন। আর ব্রেট লি মনে হয় একটা বলকেও রক্ষা দেননি। সব শেষে জয়া আহসান আর আমি একসঙ্গে বের হলাম রাতে খাবারের জন্য। রেস্তোরাঁর নাম ছিল ‘সেক্সি ফিশ’।রাতের খাবার তাড়াতাড়ি শেষ করে হোটেলে ফিরলাম। কারণ, পরের দিন থেকে বিশ্বকাপ। ওভাল মাঠে শো করা আর প্রথম দিনেই ইংল্যান্ডের অধিনায়ক এউইন মরগানের সাক্ষাৎকার নেওয়া, ভাবা যায়! যে ম্যাচে ইংল্যান্ড দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়লাভ করে। তা–ও আবার ওভালের মাঠে দেশের পতাকা নিয়ে। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে দুই হাতে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া সব দেশের পতাকা নখে এঁকেছি।
সাকিব আল হাসানের যেদিন শেষ সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম, বলছিলাম, আপনি অনেক ওজন কমিয়েছেন। তখন সাকিব বললেন, গত পাঁচ সপ্তাহে সাত কেজি ওজন কমিয়েছেন। বললাম কীভাবে? স্বভাবসুলভভাবে বললেন, ‘কীভাবে আবার, কষ্ট করে।’ মাশরাফি আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সব ম্যাচ নিয়ে একবারে না ভেবে একটা একটা করে ম্যাচ নিয়ে ভাবতে চান। সব ভালো হলেই সেমিফাইনালে এমনিতেই যাব আমরা।
লন্ডনের খাবার আর প্রবাসী বাঙালিদের আতিথেয়তা ভালো লাগছে। বাংলাদেশের সমর্থকদের চাওয়া একটাই—বাংলাদেশের জয়। বিদেশের মাটিতে সেটার স্বাদ পেলে সত্যিই তখন সবকিছু ভালো লাগে।
জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া: অভিনেত্রী ও মডেল