চীনা তরুণদের আবিষ্কার: পরিবেশবান্ধব শৌচাগার ও স্কোলিওডিটেক্ট - Mati News
Friday, December 5

চীনা তরুণদের আবিষ্কার: পরিবেশবান্ধব শৌচাগার ও স্কোলিওডিটেক্ট

চীনের তরুণ উদ্ভাবকেরা শুধু প্রযুক্তি নয়—হৃদয় আর মানবিকতার মিশেলে গড়ে তুলছেন আনকোরা এক ভবিষ্যৎ।

প্রথমেই আসা যাক চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণের তৈরি ‍উদ্ভাবনী এক শৌচাগারের প্রসঙ্গে। যার নাম পিউরেকো। সাশ্রয়ী  এই টয়লেটটি অতিশীতল ও খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা—এমনকি যেখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থারও দরকার নেই, সেখানেও ব্যবহার করা যাবে পিউরেকো।

এর বড় বৈশিষ্ট্যটি হলো এতে ফ্ল্যাশ করতে কোনো পানি লাগবে না, সৌরশক্তি ও বাতাসের শক্তি ব্যবহার করে এটি বর্জ্য আলাদা করে, সেইসঙ্গে এর ভেতর আলো আর তাপ আসবে উপরে লাগানো সোলার প্যানেল থেকে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের পাশাপাশি এতে দূর করবে দুর্গন্ধ। আবার মানব বর্জ্য থেকে সারও বানাবে এই টয়লেট। অর্থাৎ, পানি বা বিদ্যুৎ ছাড়াই একটি স্যানিটেশন ব্যবস্থা এই পিউরেকো।

কেন এ ধরনের শৌচাগার তৈরির চিন্তা এলো পিউরেকো দলের সদস্য লিয়াং চি ও তার সহকর্মীদের মাথায়?

তারা জানালেন, বিশ্বে এখনো প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি মানুষের নিরাপদ শৌচাগার নেই। ৪০ কোটিরও বেশি মানুষ খোলা স্থানে মলত্যাগ করে, যার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে প্রতিদিন ৫ বছরের নিচে ৮০০ শিশু মারা যায়। আবার চীনের গ্রামীণ এলাকাগুলোর ২৫ শতাংশ স্থানে এখনও রয়ে গেছে অস্বাস্থ্যকর টয়লেটের ব্যবহার। বিশেষ করে যেখানে পানি কম আর শীত বেশি।

এই বাস্তবতা থেকেই সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দলটি গত ১০ বছরে ঘুরেছে ২০টি প্রদেশের ৬৪টি গ্রামে।

তাদের আবিষ্কারে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯ হাজার পরিবার উপকৃত হয়েছে।

পিউরেকো একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব তেমনি এর ব্যবহারও সহজ। এতে মল ও মূত্রের জন্য আলাদা চেম্বার আছে। মলের সঙ্গে মেশানো হয় ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়া ও প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া। এরপর বিশেষ ব্যবস্থায় সূর্যের তাপ ভেতরে পাঠিয়ে বর্জ্যগুলো শুকানো হয়। আবার আলাদা করে রাখা মূত্র থেকেও তৈরি হয় জৈব সার, যা সরাসরি চলে যায় বাগানে।

লিয়াং চি বললেন, প্রচলিত টয়লেটের চেয়ে এটি সাশ্রয়ী। পরিষ্কারে কম শ্রম দিতে হয়।

তিনি আরও জানালেন, পিউরেকো শৌচাগার যদি তিন সদস্যের কোনো পরিবার ব্যবহার করে, তবে প্রতি দুই বছরে একবার এটি পরিষ্কার করলেই হবে। এতে রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কমে আসবে।

এ শৌচাগারে যে সার তৈরি হবে, সেটা মাটির হারানো জৈব উপাদান ও গুণাবলী ফিরিয়ে আনতে পারবে। এমনকি যেসব স্থানে তুষারপাত হয়, সেখানেও এই টয়লেটের মূত্র জমাট বেঁধে যাবে না। কারণ এতে থাকছে বিশেষ ধরনের নমনীয় ব্যাগের ব্যবহার।

এই শৌচাগারের কাঠামো তৈরিতে ট্র্যাপিজয়েড আকারের ব্যাকপ্লেট ব্যবহার করা হয়েছে। যা সমতল দেয়াল বা কোণে সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করা যায়। তাই স্থানের সর্বোচ্চ ব্যবহারও হয় এতে।

একটি সোলার পাখা এবং গোলাকার ভেন্টিলেটর ক্রমাগত দুর্গন্ধ দূর করার কাজ করে থাকে। এতে রয়েছে ফুটরেস্ট, যা শিশু ও বয়স্কদের জন্য নিরাপদ ব্যবহারে সহায়তা করে।

এতে থাকা ইপিপি ফোমের আসন শীতকালে আরাম দেবে। অন্যদিকে এর ঢাকনাটি এমনভাবে তৈরি যে ব্যবহার পর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবেই ওটা নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যাবে।

এ শৌচাগারে তৈরি বর্জ্যের সঙ্গে চাইলে আরেকটি ডুয়েল-চেম্বার বিনও যুক্ত করা যায়। ওই বিনে রান্নাঘর ও বাগানের উদ্ভিজ্জ বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে উন্নত ও নিরাপদ সার উৎপাদনের গতি বাড়ানো যায়।

অন্যদিকে ডাইসন পুরস্কারে জাতীয় পর্যায়ে চূড়ান্ত ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রথম ২০ জনের মধ্যে আছে শাংহাই চিয়াওথোং বিশ্ববিদ্যালয়ের লু হানওয়েন ও সোং সিনইউয়ান। তাদের তৈরি স্কোলিওডিটেক্ট হলো এক ধরনের পরিধানযোগ্য সেন্সর, যা হাঁটার ভঙ্গি থেকে মেরুদণ্ডের বাঁক মাপতে পারে।

ডিজাইন স্কুলের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী লু  জানালেন, ‘ডিভাইসটি পরার পর রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত সময় লাগে মাত্র তিন মিনিট। এ কাজের জন্য এক্সরে বা বড় মেশিনের দরকার হয় না। রোগীকেও হাসপাতালে যেতে হবে না।’

বিশ্বজুড়ে কিশোর বয়সী শিশুদের মধ্যে অ্যাডোলেসেন্ট ইডিওপ্যাথিক স্কোলিওসিস বা মেরুদণ্ডের বাঁকজনিত সমস্যা দেখা দেয় প্রায় ১-৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর ক্ষেত্রে।  সমস্যাটি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত না হলে মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়ার মাত্রা বাড়তে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে সার্জারির দরকার হয়। এখনকার শনাক্তকরণ পদ্ধতিগুলো সবসময় সঠিক ফল দেয় না। এগুলো বহনযোগ্যও নয়।

সাধারণ পর্যবেক্ষণে প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভুল ফল পাওয়া যায় এবং এটি সম্পূর্ণই নির্ভর করে পরীক্ষকের দক্ষতার ওপর। অন্যদিকে উন্নত হাসপাতালগুলোর ভারী ও ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করতে গেলে প্রায় ৭ ডিগ্রি পর্যন্ত ত্রুটি থেকে যায়।

এই সমস্যার সমাধান হিসেবে এসেছে স্কোলিওডিটেক্ট। হাঁটার ভঙ্গি বিশ্লেষণ করে মেরুদণ্ডের বক্রতা পরিমাপ করতে সক্ষম এটি। গবেষণা বলছে, মেরুদণ্ড বেঁকে গেলে শরীরের হাঁটার ছন্দে সূক্ষ্ম অসমতা তৈরি হয়—যা চোখে ধরা পড়ে না। তবে এই প্রযুক্তি সেটাই ধরতে পারে।

এতে রয়েছে একাধিক আইএমইউ সেন্সর যা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরানো হয়। কিশোর-কিশোরী স্বাভাবিকভাবে কয়েক মিনিট হাঁটলে সেন্সরগুলো ১০০ হার্টজ গতিতে শরীরের নড়াচড়া ও ভারসাম্যের তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর এআই অ্যালগরিদম সেই ডেটা বিশ্লেষণ করে মেরুদণ্ডের বাঁক কত ডিগ্রি তা নির্ণয় করে। এতে রয়েছে তিনটি প্রযুক্তি—মাসকুলোস্কেলেটাল সিম্যুলেশন, ডেটা-ড্রিভেন কার্ভ প্রেডিকশন এবং ক্লাউড-ভিত্তিক লার্নিং।

তিন ধাপে দুই শতাধিক কিশোর-কিশোরীর ওপর ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা শেষে নিশ্চিত করা হয়েছে যে এই প্রযুক্তিতে গড় ত্রুটি মাত্র ৩ ডিগ্রি, যা প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ উন্নত।

স্কোলিওডিটেক্ট বহনযোগ্য এবং ব্যবহার সহজ। স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক অথবা স্বাস্থ্য ক্যাম্পে সহজেই ব্যবহার করা যায়। পরীক্ষা করতে ৩ মিনিটের কম সময় লাগে, বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন হয় না, এবং সবচেয়ে বড় সুবিধা হলোেএতে কোনো রেডিয়েশনেরও বালাই নেই।

এবারের আয়োজনে চীনে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে চায়না ফার্মাসিউটিক্যাল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি শিক্ষার্থী ছে পেইহংয়ের তৈরি এআই-চালিত থ্রিডি ওষুধ উৎপাদন ব্যবস্থা।

এই সিস্টেমে ছোট পরিসরের ওয়ার্কশপেই ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ তৈরি করা যায়—বিশেষ করে দূরবর্তী বা ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের রোগীদের জন্য এটি হতে পারে আদর্শ সমাধান।

ডাইসনের ইলেকট্রনিক বিভাগের প্রধান হু হংফেই ছিলেন এ আয়োজনের বিচারক। তার মতে, এই তরুণরা শুধু প্রকৌশল বিদ্যাতেই শিক্ষিত নয়, তারা সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে তারা দেখিয়েছে যে, সত্যিকারের উদ্ভাবন মানে বাস্তব সমস্যা খুঁজে বের করা ও তা সমাধানের সাহস রাখা।

সূত্র: সিএমজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *