চীনের উন্নয়ন কৌশলের অন্যতম স্তম্ভ গ্রামীণ পুনরুজ্জীবন। চূড়ান্ত দারিদ্র্য নির্মূলের পর দেশটি এখন এই কৌশল বাস্তবায়নে মনোযোগী। তবে এটি শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়; বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপাদানের একটি জটিল সংমিশ্রণ। তাই এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ককে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো জরুরি।
চীনের এই গ্রামীণ উন্নয়নের কেন্দ্রে আছে একটি পরিশীলিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মডেল। এই গতিশীল ব্যবস্থাকে বলা হচ্ছে ‘সরকার-প্লাস-বাজার’। এ ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকার ও বাজার বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

স্থানীয় সরকারের অগ্রগতি সাধারণত জিডিপি, কর আদায় এবং বিদেশি বিনিয়োগ সূচকের ওপর নির্ভর করে। অন্যদিকে ব্যবসাগুলো এগিয়ে যায় বাজার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। এই দুই শক্তির সমন্বয়ে স্থানীয় অর্থনীতির বিকাশ ঘটে এবং গ্রামীণ পুনরুজ্জীবন সম্ভব হয়।
স্থানীয় সরকারের ভূমিকা
উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রায় চীনের স্থানীয় সরকারগুলোর অন্যতম কাজ হলো জাতীয় নীতি এবং স্থানীয় বাস্তবতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনাগুলোকে বাস্তবায়নযোগ্য কৌশলে রূপান্তর করতেও প্রশাসনিক এ অংশ বিশেষ ভূমিকা রাখে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনের কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চিত করেছে, স্থানীয় কর্মকর্তারা সরাসরি গ্রামীণ উন্নয়নে সক্রিয়ভাবেই অংশ নিয়েছেন।
স্থানীয় সরকারগুলো তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চাহিদার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট নীতি প্রয়োগ করে। এক্ষেত্রে একটি বহুমাত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে কাজ করে তারা।
আবার কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়, যাতে গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনের নকশা কেবল পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবেও প্রতিফলিত যায়। এভাবে, নীতিগুলো প্রকৃত অর্থনৈতিক সুযোগে রূপান্তরিত হয় এবং স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ঘটে।
স্থানীয় শিল্পের বিকাশ
গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি হলো বিশেষায়িত স্থানীয় শিল্পের উন্নয়ন। এর উজ্জ্বল উদাহরণ হলো হুবেই প্রদেশের ছিয়ানচিয়াং শহরের ক্রেফিশ শিল্প এবং শায়ানসি প্রদেশের লুওছুয়ানের আপেল শিল্প। এই শিল্পগুলোর সাফল্যের মূল চাবিকাঠি স্থানীয় সরকারের সঠিক দিকনির্দেশনা, সমন্বয় ও সহায়তা।
এ ছাড়াও, স্থানীয় শিল্পগুলোর সফলতা সরাসরি স্থানীয় কর্মকর্তাদের ক্যারিয়ারের উন্নতির সঙ্গে জড়িত। ফলে সরকার এই শিল্পগুলোর বিকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
ফুচিয়ানের শাসিয়ান কাউন্টির স্থানীয় খাবার শিল্পও এর একটি উদাহরণ। সরকারি সহায়তায় ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি একটি জাতীয় ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। এতে প্রমাণ হয়, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মডেলের যথাযথ প্রয়োগই স্থানীয় অর্থনীতিকে টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারে।
গ্রামীণ ই-কমার্স ও প্রযুক্তি
সমগ্র চীনের গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ই-কমার্সের বিকাশ। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল পেমেন্ট এবং উন্নত লজিস্টিক ব্যবস্থার মাধ্যমে চীনের গ্রামীণ এলাকাগুলো এখন বৈশ্বিক বাজারে সঙ্গে সংযুক্ত।
এই রূপান্তর শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে সম্ভব হয়নি, বরং স্থানীয় সরকার কর্মকর্তারা সরকারের নীতি ও বাজারের সুযোগের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছেন।
এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছে তিনটি মূল প্রবণতা—
সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখছে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম। এতে কৃষকরা কাস্টমাইজড উৎপাদনে অংশ নিতে পারছেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সহায়তায় তুলনামূলক কম বিনিয়োগে ব্যবসা শুরু করতে পারছেন, এবং স্থানীয় সরকার অর্থায়ন, জমি ও দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে এই খাতকে উন্নত করছে।
কোম্পানি-কৃষক সহযোগিতা
চীনের গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মডেল হলো ‘কোম্পানি-কৃষক’ সহযোগিতা। এই মডেল কৃষকদের নতুন প্রযুক্তি ও আর্থিক সংস্থানের সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং কোম্পানিগুলোকে কাঁচামালের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করে।
কিছু ক্ষেত্রে, মডেলটি স্থানীয় সরকার ও গ্রাম সমবায়কে অন্তর্ভুক্ত করে একটি বিস্তৃত ‘সরকার-কোম্পানি-গ্রাম’ মডেল গড়ে তুলেছে, যা কৃষকদের আয় বৃদ্ধি ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই প্রবৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করছে।
গ্রামীণ সিইও
গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনের আকর্ষণীয় দিকগুলোর একটি হলো ‘গ্রামীণ সিইও’দের উত্থান। শহর থেকে ফেরত আসা ব্যক্তি বা সাবেক চাকরিজীবীরা এই ভূমিকায় নামছেন। তারা ‘সরকার-প্লাস-বাজার’ মডেলের জটিলতা মোকাবিলা করে একে বাস্তব রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
(চায়না ডেইলিতে প্রকাশিত পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়াংহুয়া স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক এবং চীনের গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের ১৪তম জাতীয় কমিটির সদস্য চৌ লি’আনের মন্তব্য প্রতিবেদন অবলম্বনে)
সূত্র: সিএমজি বাংলা