মেড ইন চায়না : তোংফেং-৫ আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র - Mati News
Friday, December 5

মেড ইন চায়না : তোংফেং-৫ আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র

চীনে মানবসভ্যতার অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল হাজার বছর আগে—যখন প্রথমবার মানুষের হাতে এল বারুদ, আর সেই বারুদ থেকেই তৈরি হলো পৃথিবীর প্রথম রকেটচালিত অস্ত্র। আগুনের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে দূরপাল্লার আঘাত হানার এই ক্ষমতাই পরবর্তীতে বদলে দিল যুদ্ধনীতি, সামরিক কৌশল এবং আন্তর্জাতিক শক্তির সমীকরণ। সেই প্রাচীন উদ্ভাবনের ধারাবাহিকতা ধরে চীন ধীরে ধীরে গড়ে তোলে আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ভিত্তি, যা আজ পৌঁছেছে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত পর্যায়ে। সেই প্রাচীন অগ্নিবাণ থেকে শুরু করে আজকের তোংফেং সিরিজ—এ এক দীর্ঘ বিবর্তনের গল্প। প্রযুক্তি, গণিত, নকশা, মহাকাশ গবেষণা এবং কৌশলগত নিরাপত্তা—সব মিলিয়ে বহু দশকের বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা। এই যাত্রার সর্বশেষ ও সবচেয়ে শক্তিশালী সংযোজন হলো তোংফেং ৫সি ডিএফ-৫সি, যা এখন পৃথিবীর যে কোনো বিন্দুকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে সক্ষম।

চীন বহু দশক ধরে কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন করে আসছে। ১৯৬০–এর দশকের শেষভাগে যখন বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপে উত্তাল, তখনই বেইজিং বুঝেছিল—একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়া নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা সম্ভব নয়। সেই সময়েই শুরু হয় তোংফেং সিরিজের যাত্রা।

তোংফেং ৫ ক্ষেপণাস্ত্রের মূল নকশা তৈরি করেন চীনের খ্যাতনামা অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার থু শৌ। চীনের মহাকাশজয়ের অন্যতম সারথী লং মার্চ ২ রকেটও তৈরি হয়েছে প্রয়াত এ বিজ্ঞানীর হাত ধরে। তার নেতৃত্বে চায়না অ্যাকাডেমি অব লঞ্চ টেকনোলজি’র অধীনে নকশা করা হয়। লি শু’য়ে ছিলেন এর ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার।

থু শৌ ও লি শুয়ে—দুই বিজ্ঞানী মিলে তোংফেং মিসাইলটি তৈরি করেন চীনের ফ্যাক্টরি ২১১-এ, যেটি ক্যাপিটাল অ্যাস্ট্রোনটিকস কোম্পানি বা ক্যাপিটাল মেশিন ফ্যাক্টরি নামেও পরিচিত।

তোংফেং-৫ প্রথম পরীক্ষামূলক ফ্লাইট পরিচালনা করে ১৯৭১ সালে। ১৯৮০ সালের মে মাসে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে চূড়ান্ত পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। ১৯৮১ সালে দুটি সাইলো-ভিত্তিক মিসাইলকে ‘ট্রায়াল অপারেশনাল ডিপ্লয়মেন্টে’ রাখা হয়। ১০ হাজার থেকে ১৩ হাজার কিলোমিটার পাল্লার ছিল এই মিসাইল।

১৯৮৬ সাল থেকে চীন ডিএফ-৫এ তৈরির কাজ শুরু করে। এতে মিসাইলের পাল্লা বেড়ে ১৫ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত। এতে যোগ করা হয় আরও উন্নত নির্দেশনা-ব্যবস্থা। এই আপগ্রেডের ফলে মিসাইলটির থ্রো-ওয়েট সাত হাজার কেজি থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার ২০০ কেজিতে উন্নীত করা হয়।

তোংফেং-৫ এর দৈর্ঘ্য ৩২.৬ মিটার, ওজন এক লাখ ৮৩ হাজার কেজি ও রেঞ্জ ১৩,০০০ থেকে ১৬,০০০ কিলোমিটার।

১৯৭১ সালে প্রথম পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ সম্পন্ন হয়, এবং দশ বছর পর এটি বাস্তব অপারেশনাল ব্যবস্থায় যুক্ত হয়। একে পূর্ণ শক্তিতে প্রস্তুত করতে বেশ সময় লাগত, কারণ এটি ছিল তরল জ্বালানিচালিত। জ্বালানি ভরতে সময় লাগত ৩০–৬০ মিনিট।

এরপর আসে ডিএফ-৫এ, যার রেঞ্জ বেড়ে যায় ১৫ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি, এবং নেভিগেশন নির্ভুলতা উন্নত হয়।

চীন যখন তার ডিএফ-৫বি–এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত স্পেসিফিকেশন প্রকাশ করলো, তখন তা ছিল নজিরবিহীন।
ওটা একটি সিঙ্গেল ৩–৪ মেগাটন ক্ষমতার পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম—যা কিনা হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমার প্রায় ২০০ গুণ বেশি শক্তিশালী। ১২ হাজার কিলোমিটার রেঞ্জের ডিএফ-৫বি নিশ্চিত করে চীনের কার্যকর প্রতিরোধ ক্ষমতার বিস্তার ছড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত।

২০২৫ সালের চীনের ভিক্টরি ডে প্যারেডে প্রথমবারের মতো বিশ্বের সামনে অবমুক্ত হয় তোংফেং ৫সি বা ডিএফ-৫সি। এই ক্ষেপণাস্ত্রকে চীনের সামরিক বিশেষজ্ঞরা বর্ণনা করেছেন “বিশ্বব্যাপী আঘাত হানতে সক্ষম কৌশলগত সুপার অস্ত্র” হিসেবে।

এই ডিএফ-৫সির আছে ছয়টি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

তোংফেং ৫সিকে তিনটি পৃথক পরিবহন যানে করে বহন করা হয়। নতুন নকশা ও প্রযুক্তির কারণে আগের ডিএফ-৫ সিরিজের তুলনায় এটাকে অনেক দ্রুত উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত করা যায়। প্রতিক্রিয়ার সময় কম—অর্থাৎ হুমকি এলে দ্রুত পাল্টা জবাবের ব্যবস্থা দিচ্ছে এটি।

এটি এমন একটি ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল যা পৃথিবীর যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম। এর রেঞ্জ ছাড়িয়ে গেছে ২০ হাজার কিলোমিটার।

এই ক্ষেপণাস্ত্র পৃথিবীর বুকে তীব্র গতি নিয়ে ছুটে চলে ‘মাখ দশেরও’ বেশি গতিতে। যা কিনা শব্দের চেয়ে ১০ গুণ বেশি বা ঘণ্টায় ১২ হাজার ৩৪৫ কিলোমিটার।

ডিএফ-৫সির সবচেয়ে  আকর্ষণীয় ক্ষমতাগুলোর একটি হলো এতে আছে মাল্টিপল ইনডিপেনডেন্টলি টার্গেটেবল রিএন্ট্রি ভেহিক্যলস বা এমআইআরভি প্রযুক্তি। অর্থাৎ একটি ক্ষেপণাস্ত্রে যদি ১২টি পৃথক ওয়ারহেড সংযুক্ত করা যায়, তবে সেটা ১২টি ভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। এমনকি শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে পারে এর ভেতর থাকা ডিকয় বা ভুয়া ওয়ারহেড। যা কিনা শত্রুপক্ষের প্রযুক্তি প্রতিরক্ষামূলক রাডারগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

ডিএফ-৫সি মিসাইলে আছে ইনর্শিয়াল গাইডেন্স, স্টারলাইট নেভিগেশন, চীনের নিজস্ব বেইতৌ স্যাটেলাইট সিস্টেম। এতে ২০ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যেও আঘাত হানতে পারে মধ্য-স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মতো নির্ভুলতায়।

এ ছাড়া তোংফেং সিরিজের বিশেষায়িত মিসাইলগুলোর মধ্যে আছে মাঝারি পাল্লার ডিএফ-১৭ হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক মিসাইল, ডিএফ ২৬ডি মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল, ডিএফ-৬১, ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ডিএফ ৩১ বিজে। এসবের পাশাপাশি চীনের প্রতিরক্ষা বহর সমৃদ্ধ করেছে হাইপারসনিক জাহাজ বিধ্বংসী ওয়াইজে সিরিজের বেশ কটি ক্ষেপণাস্ত্র।

চীনের কৌশলগত পরমাণু নীতি সবসময়ই প্রতিরক্ষামূলক। চীন ঘোষণা করেছে—

  • তারা প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না।
  • কোনো অ-পারমাণবিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কখনও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না।
  • চীন পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করতে চায় না এবং চীন তার নিজের পারমাণবিক শক্তিকে ন্যূনতম পর্যায়ে রাখবে।

ডিএফ-৫সি এর প্রদর্শন তাই কোনো যুদ্ধোন্মাদ বার্তা নয়—বরং প্রতিরোধ, স্থিতিশীলতা এবং সমান ক্ষমতার ঘোষণা।

তোংফেং মানে হলো পুবের হাওয়া। এটি শুধু একটি ক্ষেপণাস্ত্র নয়—এ এক প্রতিরোধের প্রতীক, শক্তির ভাষা, ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন। এটি স্মরণ করিয়ে দেয়—শান্তি কখনও দুর্বলতার দান নয়; শান্তি আসে শক্তির ছায়ায়, দায়িত্ববোধের প্রাচীরে। তাই চীন বলছে—‘যুদ্ধ চাই না। কিন্তু যুদ্ধ আমাদের দিকে এলে, পুবের হাওয়া জেগে উঠবে আগুনের মতো।’

সূত্র: সিএমজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *