class="post-template-default single single-post postid-53236 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

মেড ইন চায়না : সয়াবিন তেলের ইতিহাস

সকালের নাস্তার ডিম থেকে শুরু করে দুপুরের খাবারে একখানা কুড়মুড়ে ভাজা মাছ, বিকেল হতেই একটুখানি সিঙ্গাড়া বা আলুর চপের মতো মুখরোচক একটা কিছু তো চাই। আবার রাত হলে দামি রেস্তোরাঁর ফ্রায়েড চিকেন বলুন বা নিজের বাসায় বানানো নিতান্তই আলু ভাজা, খাবারটা দামি হোক কিংবা সস্তা, একটা বস্তু কিন্তু সবকিছুতেই হাজির। ওটা ছাড়া এসব খাবারের কথা ভাবাই যাবে না। বলছিলাম, ভোজ্য তেলের কথা। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে নামটা হলো সয়াবিন তেল। আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে বিশ্বে প্রথম সয়াবিন তেল দিয়ে রান্না হয়েছিল চীনে। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের রান্নাঘরে স্থায়ী আসন তৈরি করে নেওয়া সয়াবিন তেল পুরোপুরি মেড ইন চায়না।

কৃষিজাত পণ্য হিসেবে সয়াবিনের ব্যবহার হাজার পাঁচেক বছর আগে হলেও তিন হাজার বছর আগে চীনের শাং রাজবংশের শেষের দিকে আবির্ভাব ঘটে সয়াবিন তেলের। ওই সময়কার চীনা ক্লাসিক কবিতা সংকলন শি চিন-এও দেখা যায় সয়াবিন তেলের কথা।

তেল আবিষ্কারেরও প্রায় হাজার বছর আগে সয়াবিনকে খাবার হিসেবে খেত চীনারা। ওই সময় চীনের পাঁচটি শস্যকে মহাপবিত্র হিসবে গণ্য করা হতো। চাল ও শস্যদানাসহ সেই তালিকায় সয়াবিনকে বলা হতো ‘হলুদ বিস্ময়’।

খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে, সয়াবিন মধ্য ও দক্ষিণ চীন এবং কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। সপ্তম শতাব্দীতে, সয়াবিন জাপানে এবং তারপরে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নেপাল ও উত্তর ভারতে চলে যায়।

ওই সময় সব দেশেই সয়াবিন ছিল বেশ দামি একটি উপাদান। নানা ধরনের খাবারের উৎস ছিল এটি। ঐতিহ্যবাহী এশিয়ান রন্ধনপ্রণালীতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সয়া খাবার ছিল মিসো, টেম্পে ও টোফু।

চলুন জেনে নিই সয়াবিন তেলের কিছু ঐতিহাসিক তথ্য

  • খাদ্য হিসেবে সয়াবিন তেলের প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ষোড়শ শতকের দিকে চীনের বহুমাত্রিক প্রতিভাদর লি শি চেনের লেখা বিশালাকার একটি গ্রন্থে। সেখানে একটি অনুচ্ছেদ ছিল সয়াবিন ও এর তেলের ব্যবহার নিয়ে। সেখানে এও লেখা আছে, ত্বকের ঘা কিংবা মাথার টাক দূর করতে প্লাস্টারের মতো করে প্রয়োগ করা যেতে পারে সয়াবিন তেল।
  • চীনে ব্যাপক হারে ব্যবহারের হাজার বছর পর ১০০ খ্রিষ্টাব্দে এসে সয়াবিন তেলের সন্ধান পায় জাপানিরা। এরপর ধীরে ধীরে এশিয়ার আরও কিছু দেশের রান্নাঘরে জায়গা করে নেয় সয়াবিন তেল।
  • এরও প্রায় হাজার বছর পর চীনের সয়াবিন বীজের কথা আমেরিকা ও ইউরোপকে জানায় ব্রিটিশ উপনিবেশের এক কর্মকর্তা স্যামুয়েল বাওয়েন। তাকে চীনের ক্যান্টনে পাঠানো হয়েছিল গোপন এক মিশন নিয়ে। ওই সময় সয়াবিন তেলের প্রক্রিয়া ও ব্যবহার সংক্রান্ত তথ্য চুরি করেন স্যামুয়েল। ধরা পড়লে নিশ্চিত কারাবরণ করতে হতো তাকে। কারণ ওই সময় সয়াবিন ও এর বীজ ছিল সংরক্ষিত একটি কৃষিপণ্য। স্যামুয়েল জর্জিয়ায় ফিরে এসে প্রশাসনের কাছ থেকে সয়াবিন চাষের জন্য জমি চেয়ে নেন।
  • ১৮৫১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ও আরও কিছু রাজ্যের কৃষকদের মধ্যে সয়াবিনের বীজ বিতরণ করা হয়। প্রশান্ত মহাসাগরে একটি জাপানি মাছ ধরার নৌকায় আটকে পড়া কিছু কর্মীর কাছ থেকেও পাওয়া গিয়েছিল এই বীজ।
  • ফ্রান্সে প্রথম সয়াবিন রোপণ করা হয়েছিল ১৭৪০ সালে। পরে ১৭৯০ সালে এর চাষ শুরু হয় ইংল্যান্ডে।
  • আমেরিকান সয়াবিন ইংল্যান্ডে রপ্তানির জন্য সয়া সস এবং সয়া নুডলস তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। আমেরিকায় সয়াবিন জনপ্রিয় করার পেছনে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের ভূমিকাও ছিল। ১৭৭০ সালে উত্তর আমেরিকার এক উদ্ভিদবিদ বন্ধু লন্ডন থেকে তার কাছে বীজ পাঠালে তিনি এর গুণগানের প্রচার করতে শুরু করেন।
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, সয়াবিন তেলকে বিবেচনা করা হতো সস্তা ও উচ্চ মানের প্রোটিন হিসেবে।

এবার জেনে নেওয়া যাক সয়াবিন তেলের স্বাস্থ্যগুণের কথা

  • উচ্চতাপে রান্নার জন্য সয়াবিন তেল নিরাপদ। কারণ এই তেলের স্মোক পয়েন্ট বা তাপের সীমা অন্য তেলগুলোর চেয়ে বেশি। তাই ২৩০ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপে এই তেলে রান্না করলেও ক্ষতিকর কোনো উপাদান তৈরি হয় না।
  • সয়াবিন তেলে আছে উপকারী চর্বি, যা পরিমিত মাত্রায় গ্রহণ করলে হৃৎপিণ্ডের উপকারে আসে।
  • এক টেবিল চামচ সয়াবিন তেলে আছে ২০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে। এই ভিটামিন আমাদের হাড় মজবুত রাখতে সাহায্য করে।
  • সয়াবিন তেলে আছে উপকারী ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। হৃদরোগ, ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসের মতো মারাত্মক সব রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে এটি।
  • ত্বকের জন্য নানা ধরনের সিরাম, জেল বা লোশনেও ব্যবহার করা হয় সয়াবিন তেল। এই তেলে থাকা ভিটামিন ই আমাদের ত্বকে পুষ্টি যোগায়।
  • শুধু শরীরের স্বাস্থ্য নয়, সয়াবিন চাষ করলে মাটির স্বাস্থ্যও বাড়ে। সয়াবিন গাছ বাতাস থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন শোষণ করে সেটাকে মাটিতে স্থানান্তর করতে পারে। এতে মাটি আরও উর্বর হয়।
  •  

সয়াবিন তেলের বাণিজ্য নিয়ে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি

বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক পণ্যগুলোর মধ্যে সয়াবিন নিঃসন্দেহে একটি বড় স্থান দখল করে আছে। শুধু বাংলাদেশেই এখন বছরে প্রায় ১০ লাখ টন সয়াবিন তেলের চাহিদা রয়েছে। এর বেশিরভাগই করতে হয় আমদানি।

আবার চীনে সয়াবিনকে ঘিরে নানা জনপ্রিয় খাবার আছে বলে তেলবীজটিকে দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য বিবেচনা করা হয়। এখানে এ বীজ ও তেলের চাহিদা এত বেশি যে দেশে উৎপাদন করে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তাই চীন বিপুল পরিমাণে সয়াবিন তেল আমদানি করে থাকে। বিশেষ করে ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকেই চীনে বেশিরভাগ সয়াবিন রপ্তানি হয়। সেই হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সয়াবিন ভোক্তার দেশ হলো চীন। গত বছর শুধু ‍যুক্তরাষ্ট্র থেকেই চীন আমদানি করেছে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টন সয়াবিন।

তবে গত বছর থেকেই চীন সয়াবিন চাষের জন্য জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৭০ হাজার হেক্টরে। এতে করে ওই বছর সয়াবিন উৎপাদন হয়েছিল ২ কোটি ৮ লাখ ৪০ হাজার টন।

হেইলংচিয়াংকে বলা হয় চীনের শস্যভাণ্ডার। সেই হেইলংচিয়াং একাডেমি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস এই বছর বাজারে একটি নতুন পরিবর্তিত জিনের সয়াবিনের জাত প্রবর্তন করবে৷ একাডেমির সহযোগী গবেষক রেন হংলেই বলেন, নতুন এ জাতে প্রতি হেক্টরে সার ৪ হাজার কেজি ফলন পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি এই বীজের প্রোটিনের পরিমাণ আগের চেয়ে ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন এ জাত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ফলন হবে দ্বিগুণ।

সূত্র: সিএমজি (চায়না মিডিয়া গ্রুপ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!