ভুল ঠিকানা দিয়ে ফেঁসে যাচ্ছেন উবার চালক
রাজধানীর শেরেবাংলানগরে কাভার্ডভ্যানের চাপায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহমিদা হক লাবণ্যর মৃত্যুর ঘটনায় ‘ উবার মটো’র চালক সুমন হোসেনকে আটক করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর নবীনগর হাউজিংয়ের ২ নম্বর সড়কের ২৫ নম্বর ভবনের ছয়তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়।
ওই বাড়ির পার্কিং থেকে জব্দ করা হয় তার মোটরসাইকেলটিও। তবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী লাল রঙের কাভার্ডভ্যানটি ঘটনার ৪৮ ঘণ্টায়ও শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। বৃহস্পতিবার দুপুরে সুমনের মোটরসাইকেলে করে খিলগাঁওয়ের উদ্দেশে যাওয়ার পথে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কাছে দুর্ঘটনার শিকার হন লাবণ্য। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রেখে ভুল ঠিকানা দিয়ে সটকে পড়েন চালক সুমন।
দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে তিনিও সামান্য আহত হয়েছিলেন। আটকের পর তাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে বেপরোয়া গাড়ির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লাবণ্যসহ সড়কে একের পর এক মৃত্যুর প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যালের সামনে ব্র্যাকসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিক্ষোভ দেখান।
দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা লাবণ্যর মৃত্যুর জন্য দায়ী ঘাতক কাভার্ডভ্যানের চালককে গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার রাতেই লাবণ্যর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। শ্যামলী জামে মসজিদের সামনে তার প্রথম জানাজা শেষে মরদেহ নেওয়া হয় সাভারের তেঁতুলঝরা এলাকায় নানাবাড়িতে।
সেখানেই দাফন করা হয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (সিএসই) তৃতীয় বর্ষের এ ছাত্রীকে। গতকাল শুক্রবার তার রুহের মাগফিরাতে সাভারের বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করা হয়। শ্যামলীতে পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন লাবণ্য। তাদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায়। দুই ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন বড়। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ মা ফারজানা হক। কাঁদতে কাঁদতে ভারী হয়ে গেছে তার চোখের পাতা। হঠাৎ কেঁদে ওঠে আবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। জ্ঞান ফিরলেই মেয়ের স্মৃতিচারণ করে আর্তনাদ করতে থাকেন- আর জ্বালাবে না আমার মেয়ে, চায়ের মধ্যে বেশি কফি মিশিয়ে আমার মা আর চা বানানোর আবদার করবে না। বুকের ধন হারানোর কথা বলতে গিয়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। চোখ থেকে গড়িয়ে নামে অশ্রুধারা, ভিজে যায় মলিন মুখখানা। আঁচলে সে ভেজা মুখ মুছতে মুছতে আবার চোখ তুলে তাকান। বললেন, ‘ও তো রাত করে পড়ত। ঘুম কাটানোর জন্য খালি চা খেতে চাইত। পড়া শেষ হলেই আমার গা ঘেঁষেই শুয়ে পড়ত। এখন কার সঙ্গে আমি ঘুমাব? ও আল্লা তুমি আমাদের এত বড় শাস্তি কেন দিলা। কেন কেড়ে নিলা আমার বুকের ধন।’ কোনো সান্ত¦নাই আর থামাতে পারছিল না নাড়িছেঁড়া ধন হারানো এ মায়ের কান্না।
পাশের একটি ঘরে আহাজারি করছিলেন লাবণ্যর ছোট ভাই ফারহানুল হক মৃদুল। বোনের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করে আনমনে বলছিলেন, ‘আমার কারণেই আপুকে মরতে হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই গাড়ি নিয়ে যেত। আমি ঘুরতে যাব বললে ওইদিন গাড়ি রেখেই মোটরসাইকেলে যাচ্ছিল। আপুকে গাড়ি দিলে তো এ ঘটনা ঘটত না। আপুকে মরতে হতো না। কেন যে ওর কাছে এমন আবদার করতে গেলাম। গাড়িটি কেন আমি রেখে দিলাম। আল্লাহ তুমি আমার আপুকে ফিরিয়ে দাও, আমি আর কখনই এ গাড়িতে উঠব না।’
কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মৃদুল। একমাত্র মেয়ের অকাল মৃত্যুতে বাগ্রুদ্ধ হয়ে পড়েছেন বাবা এমদাদুল হক। তিনি সাভারের এশিয়ান পাওয়ার ইলেকট্রনিকসের মালিক। বললেন, ‘সন্তানের লাশের ভার আর সইতে পারছি না ভাই।’ এটুকু বলেই থামেন এমদাদুল। খানিক পর নিজেই নীরবতা ভেঙে বলেনÑ ‘আমরা তো কারও ক্ষতি করিনি, তা হলে কেন এ পরিণতি ভুগতে হলো আমার মাকে। এভাবে কেন ও চলে গেল আমাকে ছেড়ে? এখন আমাকে কে শাসন করবে, কে আদর করে বলবেÑ বাবা তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো। কে খুনসুটিতে মাতিয়ে রাখবে পুরো ঘর।’ ঠোঁটজোড়া কাঁপছে এ প্রৌঢ়ের। আরও কত কথাই যেন জমা হয়ে আছে মনে, কিন্তু বলার শক্তি নেই। শুধু বললেন, ‘আমার মেয়েটার জন্য আপনারা দোয়া করবেন।’
কথা শেষ না করেই ফুঁফিয়ে কেঁদে ওঠেন এমদাদুল হক। চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি লাবণ্যর সহপাঠী ও বন্ধুরাও। এদিকে আটক উবার চালক সুমনের বরাত দিয়ে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার জানান, ঘটনার দিন সকালে কলেজ গেটে অবস্থান করছিলেন সুমন। লাবণ্যর কল পেয়ে সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে তাকে ফোন দেন সুমন।
খিলগাঁও ছায়াবীথি মসজিদের সামনে যেতে চান জানিয়ে সুমনকে শ্যামলী ৩ নম্বর রোডের ৩১ নম্বর বাসার সামনে আসতে বলেন ওই তরুণী। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কাছে এক পথচারী মোটরসাইকেলের সামনে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় সুমন ব্রেক কষেন। তখন একটি লাল রঙের কাভার্ডভ্যান পেছন থেকে ধাক্কা দিলে লাবণ্য ছিটকে পড়েন বাম পাশে, আর মোটরসাইকেল চালক পড়েন ডান পাশে।
এ সময় গাড়ির চাকা লাবণ্যর মাথার ওপর দিয়ে চলে গেলে তার মৃত্যু হয়। আহত হন সুমনও। ডিসি বিল্পব আরও জানান, ঘটনার রাতেই শেরেবাংলানগর থানায় মামলা করেছেন লাবণ্যর বাবা (মামলা নম্বর ৫০)। দুর্ঘটনার পর উবারচালক সুমন ‘পলাতক’ ছিলেন। তাকে আটক করা হয়েছে। সুমনের বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের পাশাপাশি বাইকচালক হিসেবে তার অবহেলা বা ইচ্ছাকৃত ভুল ছিল কিনা, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পুলিশি নজরদারির মধ্যে তিনি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ঘাতক কাভার্ডভ্যান। সেই গাড়ির চালক পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ সূত্র জানায়, ঘটনার পর থেকেই লাবণ্যকে বহনকারী মোটরবাইকচালক সুমনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তার মোবাইল নম্বরও ছিল বন্ধ। লাবণ্যর লাশ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রেখে সেই হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে মোটরবাইকসহ তিনি পালিয়ে যান।
পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে ‘৯৯৯’-এ ফোন করে বলা হয়, দুর্ঘটনায় আহত দুজন তাদের হাসপাতালে এসেছে। পুলিশ হাসপাতালে যাওয়ার আগেই লাবণ্যর মৃত্যু হয়। সূত্রটি আরও জানায়, হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার সময় সুমন ভুল ঠিকানা উল্লেখ করেছেন। উবারচালক হিসেবে রেজিস্ট্রেশনের সময়ও তিনি যে ঠিকানা ব্যবহার করেছেন, সেটাও সঠিক ছিল না।
পাশাপাশি মোটরবাইকটি কেনার সময় যে ঠিকানা ব্যবহার করেছেন, সেটাও সঠিক দেননি সুমন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার গভীররাতে নবীনগর হাউজিংয়ের একটি বাসা থেকে উবার বাইকচালক সুমন হোসেনকে আটক করা হয়। সেই বাসার নিচতলার গ্যারেজ থেকে উদ্ধার করা হয় মোটরবাইকটি। উবার