রহস্যের গন্ধমাখা অদ্ভুত বই কার না ভালো লাগে। কিন্তু এমনও বই আছে যাতে কোনো রহস্য বা গোয়েন্দা গল্প না থাকলেও বইটা নিজেই এক মস্ত বড় রহস্য। এত বড় রহস্য যে দুনিয়ার বাঘা বাঘা গোয়েন্দারাও সেসব বইয়ের গোমর ফাঁস করতে পারেননি। কী এমন আছে ওই বইতে? জানাচ্ছেন নূসরাত জাহান নিশা
দ্য কোডেক্স মেনদোজা
রহস্যে ঘেরা অনেক বইয়ের নামের শুরুতেই কোডেক্স শব্দটা পাবে। এই কোডেক্স-এর মানে হলো হাতে লেখা পুঁথি। মানে বইগুলো এত পুরনো যে তখন ছাপাখানাই বের হয়নি। সালটা যেহেতু ১৫৪১, তাই ওই সময় প্রিন্টারের চিন্তা না করাই ভালো। কোডেক্স মেনদোজা হলো আজটেক সভ্যতার নাড়িনক্ষত্রের ইতিহাস। তবে সমস্যা হলো বইটা চাইলেই তুমি পড়তে পারবে না। তার আগে তোমাকে শিখতে হবে আজটেক সভ্যতার ভাষা নাহুয়াতল। বইটা যদিও স্পেনের রাজার তত্ত্বাবধানে লেখা হয়েছিল তথাপি এর অনেক সাইডনোট ও প্রতীক আঁকতে সাহায্য করেছিল আজটেকদেরই একটা অংশ, যাদের বলা হতো নাহাউস। আদিবাসী লোকগুলো বইটার আপাদমস্তকে ব্যবহার করেছে তাদের ভাষার লিখিত কিছু প্রতীক। স্পেনের সাবেক শাসক চার্লস পঞ্চমের জন্য লেখা হয়েছিল বইটা। তবে তার হাত পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই সেটা কিনে ফেলেন আন্দ্রে থেবেট। তিনি আবার নিজের কিছু লেখাও বইটাতে জুড়ে দেন। সালটা ছিল ১৫৫৩। দীর্ঘদিন বইটা ফ্রান্সেই ছিল। পরে একজন ইংরেজ কোডেক্সটাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন। ১৬৫৯ সালে বইটার ঠাঁই হয় ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের একটি লাইব্রেরিতে। প্রায় দুইশ বছরের মধ্যে ১৭২ বছর বইটা একটা শেলফেই পড়েছিল। ১৮৩১ সালে বইটার গুরুত্ব বুঝতে পেরে ভালোভাবে সংরক্ষণ করে রাখতে শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। তবে এতদিনে হারিয়ে গেছে বইটির ভাষা। তাই ওতে ঠিক কী লেখা আছে তা পড়তে পারছে না কেউ।
দ্য রিপলি স্ক্রল
এই রিপলি কিন্তু রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট-এর রিপলি নন। ১৪১৫ থেকে ১৪৯০ সাল পর্যন্ত ছিল উনার বসবাস। ইংরেজ এই লেখক ছিলেন রসায়নে সিদ্ধহস্ত। সঙ্গে রহস্য আর অতিপ্রাকৃত বিষয়আসয়ে ছিল অগাধ বিশ্বাস। দুটো মিলিয়ে লিখেছেন দুর্বোধ্য সব হেঁয়ালি আর ছবিতে ঠাসা একটা বই। ঠিক মলাট বাঁধা বইয়ের মতো নয় এটি। লিখেছেন বড় বড় কাগজে, স্ক্রলের মতো গোল করে রাখা যায় যেগুলো। কারো মতে রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোকেই ধাঁধার মতো করে তুলে ধরেছেন এই রিপলি। আবার কারো মতে এটা পরাবাস্তব জগৎ নিয়ে এক অন্যরকম সাহিত্যকর্ম, যার প্রতিটি পাতায় রয়েছে রূপকের ছড়াছড়ি। অতিপ্রাকৃত বিষয়ে যাদের অগাধ বিশ্বাস তাদের জন্য বইটা ‘মহামূল্যবান’। যদিও ঠিক কী ভেবে রিপলি সাহেব এটা লিখেছিলেন সেটা এখনো কেউ বলতে পারছে না।
দ্য রোহংক কোডেক্স
এ যাবৎকালের সবচেয়ে দুর্বোধ্য বই এটা। কারণ এর একটা শব্দ বা চিহ্নেরও পাঠোদ্ধার করা আজ অবদি সম্ভব হয়নি। কে লিখেছে জানা যায়নি সেটাও। পুঁথিটি প্রথম চোখে পড়ে ১৯০০ সালে। এরপর থেকে দুনিয়ার ভাষাতাত্ত্বিক থেকে শুরু করে তাবৎ কোড-ব্রেকাররা চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এর পাঠোদ্ধারের। কিন্তু পৃথিবীর চেনা কোনো ভাষার সঙ্গেই এর মিল পাওয়া যায়নি। এটা আদৌ কোনো ভাষা নাকি মিসরীয় হায়ারোগ্লিফসের মতো প্রতীকী ভাষা, সেটাও বের করতে পারেনি কেউ। ১৭৪৩ সালে হাঙ্গেরির রোহংক লাইব্রেরিতে প্রথম এটাকে পাওয়া যায়। পরে ১৮৩৮ সালে হাঙ্গেরির কেউ একজন এ বইটাসহ তার সমস্ত সংগ্রহ হাঙ্গেরিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সকে দান করতেই বইটা নজরে আসে সবার। ধারণা করা হয় কোনো এক হাঙ্গেরিয়ান বইটাকে প্রার্থনার বই হিসেবে নিজের কাছে রেখে এসেছিল। তবে আর যাই হোক, এটার রচনার ধরন ও ছবিগুলো দেখে মনে হবে যে এটা ঠিক হিজিবিজি নয়, কোনো না কোনো অর্থ ঠিকই আছে।
দুনিয়ার দৈত্য-দানো এক হও
নামটা খটমটে- প্রোডিজিওরাম আক অসটেনটোরাম ক্রনিকন। বাকিগুলোর মতো অতটা দুর্বোধ্য না হলেও ইতিহাসবিদ ও পড়ুয়াদের কাছে বেশ লোভনীয় একটা বই। ১৫৫৭ সালে ইংরেজিতেই বইটি লিখেছেন কনরার্ড লিকোসথেনেস নামের এক ইংরেজ। সুপ্রাচীন আমল থেকে ১৫৫৭ সাল পর্যন্ত লোকেরা যত ধরনের দৈত্য দানো ও ভয়ানক কাল্পনিক জীবজন্তুতে বিশ্বাস করতো তার একটা এনাসাইক্লোপিডিয়া এটি। এতে আছে অদ্ভুত দুই মাথাওয়ালা মানুষ, সাগরের দৈত্য, বিচিত্র সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এমনকি আকাশে ভিনগ্রহের মহাকাশযান দেখার গল্পও। জানা কথা যে বইটার ইংরেজি এখনকার মতো সহজ নয় মোটেও। এখানে এমন কিছু ইংরেজি শব্দ আছে যেগুলোর মানে বুঝতে ঘাম ঝরাতে হয়েছে গবেষকদেরও।
কোডেক্স সেরাফিনিয়ানাস
এটাও আরেকটা বই যার এক বর্ণ পাঠোদ্ধার করা যায়নি আজতক। তবে রোহংক কোডেক্সের সঙ্গে পার্থক্য হলো সেরাফিনিয়ানাস বইটার লেখক বলে দিয়েছেন এর রহস্য। বইটা লেখা হয়েছে বেশিদিন হয়নি, ১৯৭০ সালে। ইতালীয় শিল্পী ও স্থপতি লুইজি সেরাফিনি লিখেছেন এটি। কাল্পনিক জিনিসপত্র নিয়ে নিজের বানানো একটা ভাষায় এটা লিখেছেন তিনি। প্রথম দফায় ১৯৮১ সালে বইটির ৫০০০ কপি ছাপা হয়। পরে আরো পাঁচ দফায় ছাপা হয় এটি। এর পাঠোদ্ধারের জন্য হুমড়ি খেয়ে সবাই কোডব্রেকাররা। তবে ২০০৯ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক সভায় সেরাফিনি নিজেই বলেন, বইটার আসলে কোনো সরাসরি অর্থ নেই। এটাকে সত্যিকার অর্থেই হিজিবিজি বলা চলে। তবে হিজিবিজির পেছনে একটা কারণ আছে অবশ্য। সেরাফিনির মতে, এখনো পড়তে শেখেনি এমন শিশুর কাছে ছবি ও রঙের বই যেমন আকর্ষণীয়, কোডেক্স সেরাফিনিয়াসের অনর্থক শব্দ ও ছবিগুলোও বড় পাঠকদের মধ্যে সেই আকর্ষণ তৈরি করবে।
দ্য নাগ হামাদি কোডিসেস
হস্তলিখিত পুঁথির সংগ্রহকেই বলে কোডিসেস। খ্রিস্টধর্মের সবচেয়ে বড় রহস্য হয়ে আছে এটি। কারণ প্রায় ১৬০০ বছর ধরে মিসরের একটি মরুর তলায় চাপা পড়েছিল এই রচনাগুলো। উদ্ধার করা হয় ১৯৪৫ সাল। খ্রিস্টধর্মের যাবতীয় ধর্মগ্রন্থের অনেক মৌলিক ব্যাপারস্যাপার পাওয়া গেছে এতে। খ্রিস্টধর্মের শুরুর দিককার রাজনৈতিক ঘটনা, বার্তা এসবও আছে। বইটা প্রাচীন খ্রিস্টধর্মের এক মস্তবড় দলিল ও রহস্যেঘেরা। মোট ১৩টি ভলিউমে ৫২টি আলাদা রচনা নিয়ে হামাদি কোডিসেস। এতে প্রাচীন খ্রিস্টধর্মের অনেকগুলো গোষ্ঠীর কথাও বলা আছে এতে।
ভয়নিচের অদ্ভুত বই
১৫ থেকে ১৬শ সালের কোনো এক সময়ে লেখা গোপন ভাষার বইটির লেখক অজানা। অনেক হাতঘুরে শেষে ১৯১২ সালে পোল্যান্ডের সংগ্রাহক উইলফ্রিড ভয়নিচ কিনে নেন বইটি। সেই থেকেই এর নাম। হাতে লেখা বইটি যথেষ্ট পরিপাটি করে লেখা হলেও যথারীতি এর এক বর্ণও কেউ এখনো বুঝতে পারেনি। শুধু এটুকু জানা গেছে বইটা এক সময় রোম সম্রাট রুডলফ দ্বিতীয়র কাছে ছিল। কারণ বইটার একটা পৃষ্ঠায় ওই সম্রাটের ওষুধ বিশেষজ্ঞ ও রসায়নবিদদের নাম লেখা আছে।
দ্য এমারেল্ড ট্যাবলেটস
প্রাচীন মিসরীয় এই রচনাসম্ভারকে ঘিরে রহস্যের শেষ নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে সংরক্ষিত এই পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে লেখা হয়েছিল ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতকের দিকে। তবে এর মূল কৃতিত্ব দেওয়া হয় খোদ মিসরীয় জ্ঞানের দেবতা থোতকে। অবশ্য ইতিহাসবিদদের মতে এই থোত আসলে প্রাচীন মিসরের একজন যাজক-সম্রাট ছিলেন। তারই বিভিন্ন বয়ানকে পরে আরবি ভাষায় লিপিবদ্ধ করে হারমিস ট্রিসম্যাজিসটাস নামের আরেক লেখক। পরে আইজ্যাক নিউটনের মতো বিজ্ঞানীও এর কিছু অংশ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। এখন অবশ্য এর পুরো অনুবাদটাই পড়া যায় অনলাইনে। প্রাচীন মিসরের অদ্ভুত সব রসায়ন ও দর্শন নিয়ে লেখা বইটি। সৃষ্টির রহস্য, চেতনাবোধ, মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা, পৃথিবীর পেটের ভেতরকার নানান জিনিসপত্র ইত্যাকার নানান বিষয় নিয়ে হেঁয়ালি ঘরানায় লেখা এটি।