জটিল চর্মরোগ সোরিয়াসিস
এক ধরনের জটিল চর্মরোগ সোরিয়াসিস, যা কখনো সারে না। এটি ছোঁয়াচে নয়। আবার নির্মূলযোগ্য রোগ না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে জটিলতা বাড়ে। তবে নিয়মিত ও সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান
সোরিয়াসিস একেবারে নির্মূলযোগ্য রোগ নয়, তবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য
শরীরের বিভিন্ন অংশে সোরিয়াসিস নামক চর্মরোগ হতে পারে। তবে মাথা, জিহ্বা, লিঙ্গের অগ্র্রত্বক, অণ্ডকোষের থলে, পিঠের ওপরের অংশ থেকে নিচের অংশ, ঘাড়, হাতের কনুই, আঙুল, তালু, পিঠ, নখ ও তার আশপাশে; পায়ের তালু, হাঁটু, হাত-পায়ের জয়েন্টে এটি বেশি দেখা যায় এবং এসব স্থান থেকে ক্রমাগত চামড়া বা আবরণ উঠতে থাকে।
চর্মরোগ সোরিয়াসিস ধরন
সোরিয়াসিস বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন—
পেক সোরিয়াসিস : এটি লালচে প্রদাহজনিত এক ধরনের সোরিয়াসিস, যাতে সিলভার বা সাদা রঙের মতো আবরণ বা আঁশ ওঠে। সাধারণত হাতের কনুই, হাঁটু, মাথা ও পিঠের নিচের দিকে এই সোরিয়াসিস দেখা যায়। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ রোগীই পেক সোরিয়াসিসের অন্তর্ভুক্ত।
ইনভার্স সোরিয়াসিস : সাধারণত লালচে রঙের হয়, যার কোনো আবরণ থাকে না। অনেকটা মসৃণ ও চকচকে ধরনের হয়। ঘর্ষণ, চুলকানি ও ঘামের কারণে যন্ত্রণা হতে পারে। সাধারণত মোটা চামড়ার গভীর ভাঁজযুক্ত ব্যক্তিদের এই সোরিয়াসিস বেশি হয়।
ইরিথ্রোডার্মিক সোরিয়াসিস : এটিও লালচে রঙের হয়, যা দেহের পুরো স্থানজুড়ে দেখা যায়। চামড়া উঠতে থাকে, প্রচণ্ড চুলকানি হয়। এর প্রভাবে শরীরের তাপমাত্রা ওঠানামা, নিউমোনিয়া, হার্টফেলিওরসহ নানা সমস্যা হতে পারে।
গাট্টেট সোরিয়াসিস : সাধারণত শিশু বা যুবক বয়সে দেখা দেয়। এটিও লাল ছোট ছোট স্পটের মতো হয়। পেক সোরিয়াসিসের মতো এতেও আবরণ ওঠে। এ ধরনের সোরিয়াসিসে ঊর্ধ্ব শ্বাসতন্ত্রের অসুস্থতা, স্ট্রেপটোকক্কাল প্রদাহ, টনসিলে প্রদাহ ইত্যাদি কিছুদিন অনুপস্থিত থেকে আবারও ফিরে আসতে পারে বা পেক সোরিয়াসিসে রূপান্তরিত হতে পারে।
পাস্টুলার সোরিয়াসিস : এটা হলে চামড়া লাল হয়ে যায়, শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে সাদা পুঁজ বা ফোসকা তৈরি করে, আবরণ উঠতে থাকে। চারদিকে লালচে ধরনের চামড়া থাকে। তবে এটি দ্রুত ছড়ায় না এবং সহজে অন্যকে সংক্রমিতও করে না।
সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস : এটা শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট আক্রান্ত করতে পারে। হাতের আঙুলের ছোট ছোট জয়েন্ট আক্রান্ত হতে পারে এবং হাত বিকৃতও করতে পারে।
লক্ষণ
শরীরের কিছু নির্দিষ্ট জায়গা, যেমন—কনুই, হাঁটু, হাত-পায়ের তলা, মাথা, পিঠ ইত্যাদি স্থান থেকে সাপের মতো চামড়া বা খোলস উঠে যায়। মাথা থেকে খুশকির মতো উঠতে থাকে। তা ছাড়া উল্টো জায়গাগুলো, বিশেষ করে শরীরের ভাঁজের মধ্যে বেশি হয়। স্কিন বায়োপসি করে রোগটি পুরোপুরি নির্ণয় করা যায়।
কারণ
সোরিয়াসিস হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে বলে একে ‘মাল্টিফ্যাক্টরিয়ান’ বলা যেতে পারে। এর কিছু কারণের মধ্যে—
স্থূলতা : ওজন বেড়ে গেলে সোরিয়াসিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে বা এই রোগ হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
বংশগত : পরিবারের কারো সোরিয়াসিস হলে অন্যদেরও হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কারো যদি পিতা-মাতা উভয়ের হয়, তবে এই ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়।
ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস সংক্রমণ : ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকজনিত সংক্রমণের কারণে সোরিয়াসিস হতে পারে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া : কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন—উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ বিটা বকার, ব্যথার ওষুধ এনএসএআইডি (নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ড্রাগ), মানসিক রোগীর ওষুধ লিথিয়াম, মুখে খাওয়ার স্টেরয়েড ইত্যাদি ওষুধের ব্যবহার রোগকে জটিল করতে পারে বা বাড়িয়ে দিতে পারে।
মানসিক চাপ : অতিরিক্ত টেনশন দেহের ইমিউন সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ সোরিয়াসিস হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়।
পরিবেশগত : লাল মাংস, বিশেষ করে গরু ও খাসির মাংস বেশি খেলে হতে পারে।
ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান : ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রভাব পড়তে পারে সোরিয়াসিসের ক্ষেত্রে।
অতিরিক্ত কোলেস্টেরল : যদি কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে সোরিয়াসিস রোগীদের হার্টের সমস্যা বেশি হতে পারে।
এ ছাড়া ত্বকের সংক্রমণ, ক্ষত, আঘাত বা কাটা-ছেঁড়া, সানবার্ন, ভিটামিন ‘ডি’র ঘাটতি প্রভৃতি কারণে সোরিয়াসিস হতে পারে।
চিকিৎসা
সোরিয়াসিস একেবারে নির্মূলযোগ্য রোগ নয়, তবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। নিয়মিত সঠিক চিকিৎসা নিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এখন নতুন নতুন অনেক চিকিৎসা বের হয়েছে এবং এর অনেক ভালো ওষুধ আমাদের দেশেই আছে। তবে আমরা চেষ্টা করি কম মাত্রার ওষুধ দিয়ে নিয়ম-কানুন মেনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে।
সোরিয়াসিসের একটি চিকিৎসা ভিটামিন ‘ডি’। এ ছাড়া ‘ক্যালসিপটট্রিয়ল’ ব্যবহার করারও পরামর্শ দেওয়া হয়। যে কোষগুলোর কারণে সোরিয়াসিস হয়, ফটোথেরাপি সেই কোষগুলোকে কমিয়ে দেয় বলে এটা খুব কার্যকর। এর নিরাপদ ব্যবহারে শিশুদের সোরিয়াসিসও নিয়ন্ত্রণ হয়। এ ছাড়া কিছু ‘ইমিউনোসাপ্রেসিভ’ ওষুধের পাশাপাশি রয়েছে ভিটামিন ‘এ’-জাতীয় ‘রেটিনয়েড’ (ব্যবহার করার সময় গর্ভধারণ নিষিদ্ধ), ‘সাইক্লোসপোরিন’ ইত্যাদি। বায়োলজিকস ওষুধগুলো এখন ইনজেকটেবল ফর্মেও মিলছে, এগুলো অবশ্য একটু দামি।
ঝুঁকি
সোরিয়াসিস রয়েছে যাদের, কিছু রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে তাদের। যেমন—
♦ পরিবারের কারো এই রোগ হলে অন্য সদস্যদেরও হতে পারে।
♦ সোরিয়াসিস আক্রান্তদের উচ্চ রক্তচাপ, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদরোগের আশঙ্কা দ্বিগুণ হয়।
♦ কিছু চোখের সমস্যা, যেমন—চোখ ওঠা, ইউভাইটিস ইত্যাদি হতে পারে।
♦ আক্রান্তদের কিডনি রোগ, পরিপাকতন্ত্রের নানা রোগ, ক্রনস ডিজিজ হতে পারে।
♦ ৩০ শতাংশের আর্থ্রাইটিস, গাঁট রোগ বা জয়েন্টের প্রদাহ হতে পারে।
♦ সোরিয়াসিসের কারণে ‘টাইপ টু’ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
♦ সোরিয়াসিস হলে মোটা বা স্থূল হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে, তবে এর সঠিক কারণ জানা যায়নি।
♦ সোরিয়াসিস মানুষের জীবনমান প্রভাবিত করতে পারে। এটা হীনম্মন্যতা বা অবসাদগ্রস্ততা বাড়িয়ে মানুষকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে।
♦ একসময় তা সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে (এক্সফনয়েটিভি ডার্মাটাইটিস)। অনেক সময় সারা গায়ে পুঁজের মতো হতে পারে। এগুলো খুব জটিল অবস্থা। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই রোগের কোনো ওষুধ সেবন না করাই ভালো।
করণীয়
♦ টেনশনমুক্ত থাকার চেষ্টা করা। প্রয়োজনে মেডিটেশন করার অভ্যাস গড়ে তোলা। রোগকে মোকাবেলা করার মতো দৃঢ় মনোবল রাখা।
♦ অন্যান্য আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে মিলে দুঃখ-কষ্টের কথা শেয়ার করলে মনের স্ট্রেস বা চাপ কমে।
♦ স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস তৈরি করতে হবে। অতিরিক্ত ফ্যাট, চর্বিযুক্ত, উত্তেজক খাবার পরিহার করতে হবে।
♦ ধূমপান, অ্যালকোহল, ক্ষারীয় সাবান, অস্বাস্থ্যকর পোশাক ও পরিবেশ বর্জন করতে হবে।
♦ নিয়মিত গোসল, প্রতিদিন খুব ভোরে একটু নিয়ম করে হাঁটা ও ব্যায়াম করা ভালো।
♦ সোরিয়াসিস হলে অতিরিক্ত চুলকানো ঠিক নয়, এটা ত্বকের জন্য খুব ক্ষতিকর।
♦ চামড়াকে সব সময় ময়েশ্চারাইজ করে রাখার চেষ্টা করা উচিত।
♦ সকাল ৮-১০টার রোদ খুব উপকারী। তবে এই সময়ের পরের রোদ সোরিয়াসিসের জন্য ক্ষতিকর।
https://www.youtube.com/watch?v=Geg0SPadJxM