Friday, May 3
Shadow

আই হসপিটালের গ্লুকোমা ও ফ্যাকো বিশেষজ্ঞ ডা. এম নজরুল ইসলামের পরামর্শ : ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি কী ও করণীয়

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি

আই হসপিটালের গ্লুকোমা ও ফ্যাকো বিশেষজ্ঞ ডা. এম নজরুল ইসলামের পরামর্শ : ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি কী ও করণীয়

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির কারণে চোখ স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে শুরুতে সঠিক চিকিৎসা নিলে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে রোগীর চোখের দৃষ্টি ভালো রাখা সম্ভব। এ ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ আই হসপিটালের গ্লুকোমা ও ফ্যাকো বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম নজরুল ইসলাম

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি

 

দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণেই বেশিরভাগ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হয়

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি কী

 

চোখের পেছনে স্নায়ু দ্বারা তৈরি পর্দা রেটিনা, যা দৃষ্টির জন্য অপরিহার্য। বস্তু থেকে আলোকরশ্মি চোখের ভেতরে ঢুকে ওই বস্তুর প্রতিবিম্ব রেটিনায় পড়ে বলেই দৃশ্যটি দেখা যায়। রেটিনা হলো চোখের সবচেয়ে সংবেদনশীল পর্দা, যাতে সামান্য সমস্যা হলেই দৃষ্টি কমে যেতে পারে।

মূলত দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণেই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হয়। রক্তশূন্যতা অথবা অক্সিজেনের অভাবে প্রদাহ তৈরি হয়ে রেটিনার সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তখন অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় রেটিনায় পানি ও তেলজাতীয় পদার্থ জমে ফুলে যায় অথবা রেটিনার বিভিন্ন স্থানে নতুন অপরিপক্ব রক্তনালির সৃষ্টি হয়। ভিট্টিয়াসে রক্তপাত হয় এবং পরবর্তী সময় রেটিনা আলাদা হয়ে সরে আসে। চোখের চাপ বেড়ে গ্লুকোমা সৃষ্টি হলে একপর্যায়ে রোগীর দৃষ্টিশক্তি কমে যায় বা দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে।

 

যাদের হতে পারে

যেকোনো ডায়াবেটিক রোগীর রক্তে শর্করার পরিমাণ যতই নিয়ন্ত্রিত থাকুক না কেন, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি থেকে তিনি মুক্ত নন। খুব ভালো নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিক রোগীরও এই সমস্যা হতে পারে। কারো ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিস থাকলে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রক্তনালির এমন পরিবর্তন হতে অন্তত ১০ বছরের মতো সময় লাগে।

তবে ইনসুলিননির্ভর ৩০ বছরের কম বয়স্ক রোগীদের ডায়াবেটিসে প্রলিফারেটিভ রেটিনোপ্যাথির হার প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। এ ছাড়া যাদের ঝুঁকি বেশি তারা হলেন—

► এক চোখে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হয়েছে এমন রোগী।

► গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয় যাদের।

► ডায়াবেটিসের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে যাদের।

► রক্তস্বল্পতা আছে যাদের।

► রক্তে কোলেস্টেরল বা চর্বির মাত্রা বেশি যাদের।

► কিডনির সমস্যা রয়েছে যাদের।

► স্থূল বা অতিরিক্ত ওজন যাদের।

► ধূমপায়ী।

 

ভয়াবহতা

ডায়াবেটিসের কারণে চোখের নানা অসুখ হয়। তবে সব অসুখের কারণে চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু পৃথিবীতে যেসব কারণে অন্ধত্ব হয়, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি তার অন্যতম কারণ। যার যত বেশিদিন ধরে ডায়াবেটিস রয়েছে, তার রেটিনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হলে চোখ আস্তে আস্তে খারাপ হতে থাকে। একপর্যায়ে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ জন্য সময়মতো সঠিক চিকিৎসা করা জরুরি।

 

লক্ষণ

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় রোগীরা তেমন কোনো অসুবিধা অনুভব করেন না। তবে আস্তে আস্তে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। যেমন—

► ফ্লোটারস (চোখের সামনে ভাসমান কিছু দেখা)।

► রেটিনা সরে আসার কারণে দৃষ্টিসীমানার যেকোনো অংশ কালো দেখা।

► আস্তে আস্তে (একসঙ্গে অথবা পর্যায়ক্রমে দুই চোখ) দৃষ্টি কমে যাওয়া।

► ভিট্টিয়াসে রক্তপাতের কারণে হঠাৎ করে এক চোখ দৃষ্টিহীন হতে পারে।

► রেটিনায় পানি জমে ফোলার কারণে দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া।

► চোখের চাপ বেড়ে গিয়ে ব্যথা অনুভব।

► আচমকা দৃষ্টিহীনতা।

 

ধরন

সিম্পল ব্যাকগ্রাউন্ড ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি : বয়স্ক ডায়াবেটিস রোগীদের ৩০ শতাংশের এ ধরনের ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির উপস্থিতি পাওয়া যায়।

ব্যাকগ্রাউন্ড ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ও ম্যাকুলার ইডিমা : এতে অনেকের রেটিনোপ্যাথির মাত্রা কম থাকলেও ম্যাকুলায় পানি জমে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে।

প্রিপলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি : রোগীর দৃষ্টি থাকে ৬/৬; কিন্তু চিকিৎসার জন্য রোগ নির্ণয় জরুরি। লেজার চিকিৎসা না করালে চোখের অবস্থা জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

নন-প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি : ডায়াবেটিসে অন্ধত্বের মূল কারণ প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। রেটিনায় অন্যান্য রেটিনোপ্যাথির কোনো কোনো চিহ্নসহ নতুন রক্তনালি তৈরিই হলো এই প্রকার রক্তনালির বৈশিষ্ট্য। ইনসুলিননির্ভর রোগীদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি।

অ্যাডভান্সড ডায়াবেটিক আই ডিজিজ : প্রলিফারেটিভ  ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির জটিলতার শেষের দিক। সম্প্রতি আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে অন্তত নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব হচ্ছে।

তবে বর্তমানে আরলি ট্রিটমেন্ট ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি স্টাডি অনুযায়ী ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিকে নিম্নরূপে ভাগ করা হয়েছে। যেমন—

নন-প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি

► মাইল্ড নন-প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি

► মডারেট নন-প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি

► সিভিয়ার নন-প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি

প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি

► নতুন রক্তনালি তৈরি এবং রেটিনার রক্তক্ষরণ

অ্যাডভান্সড ডায়াবেটিক আই ডিজিজ

► ভিট্রিয়াস হেমোরেজ

► রেটিনাল ডিটাচমেন্ট

 

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

এ রোগ শনাক্তকরণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ০.৫ শতাংশ বা ১.০ শতাংশ ট্রপিকামাইড ও ১০ শতাংশ  ফেনাইলেফ্রিন ওষুধের সাহায্যে চোখের পিউপিলকে বড় করা হয়।

ডাইরেক্ট অফথালমোসকপি : প্রাথমিক অবস্থায় রেটিনার পরীক্ষার জন্য ডাইরেক্ট অফথালমোসকপি নামক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। যেকোনো ধরনের এবং পর্যায়ের রেটিনোপ্যাথিই এই পরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়ে।

ইনডাইরেক্ট অফথালমোসকপি : এই যন্ত্র দিয়ে দুই চোখের সাহায্যে রেটিনা দেখা হয় বলে যেকোনো ক্ষত সহজে দেখতে পাওয়া যায়। +২০ এবং +৩০ ডাইঅপ্টার লেন্স ব্যবহার করে রেটিনার বেশির ভাগ অংশ দেখা যায়, রোগী এদিক-ওদিক তাকালে প্রায় পুরো অংশই দেখা যায়।

স্লিটল্যাম্প পরীক্ষা : এই যন্ত্রেও দুই চোখের রেটিনার গঠন বা কোনো ক্ষতের গভীরতা মাপা যায়। ফলে রেটিনার খুব সূক্ষ্ম কোনো ক্ষতও পরীক্ষায় ধরা পড়ে।

কালার ফান্ডাস ফটোগ্রাফি : আধুনিক ফান্ডাস ক্যামেরার সাহায্যে রেটিনার ছবি তোলা হয়। রেটিনার ছবি ডকুমেন্ট রেকর্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। চিকিৎসক ছাড়া রোগী নিজেও তাঁর চোখের রেটিনার অবস্থান দেখতে পারেন।

ফ্লুরেসিন এনজিওগ্রাফি : রেটিনার রক্তনালিতে রক্তপ্রবাহ ঠিক আছে কি না তা দেখার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়। সাধারণ ভাষায় এই পরীক্ষাকে চোখের এক্স-রে বলা হয়। রেটিনা ছাড়া চোখের স্তরের রক্তসঞ্চালন দেখতে এই পরীক্ষা করা হয়।

 

চিকিৎসা

প্রথম দিকে রোগ শনাক্ত হলে ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কোলেস্টেরল লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখলে ভালো হয়ে যায়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম দিকে ধরা পড়ে না, ফলে দরকার হয় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার।

যদিও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি একেবারে ভালো হয় না, তথাপি চিকিৎসা নিলে কর্মক্ষম দৃষ্টি দীর্ঘদিন ধরে রাখা যায়। কোন অবস্থায় রোগ ধরা পড়ছে, মূলত তার ওপরই নির্ভর করে চিকিৎসা। সাধারণত চোখের ভেতর স্টেরয়েডজাতীয় ইনজেকশন প্রয়োগ, লেজাররশ্মি এবং  ভিট্রেকটমি অপারেশন—এই তিন পদ্ধতিতে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসা করা যায়। লেজাররশ্মির চিকিৎসায় তেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, খরচও তুলনামূলক কম। আবার ইনজেকশন এভাসটিন অথবা ইনজেকশন লুসেনটিস বেশ ব্যয়বহুল। ইনফেকশন হওয়া ছাড়া এর তেমন কোনো রিস্কও নেই। চিকিৎসা করালে যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, সেখানে থামিয়ে রাখা যায়। চিকিৎসা না করালে বরং স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই রোগের উন্নত চিকিৎসা বাংলাদেশেই হচ্ছে।

 

প্রতিরোধে করণীয়

► যথাযথভাবে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করা।

► রক্তে কোলেস্টেরল বা চর্বি বেশি থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে আনা।

► বছরে অন্তত একবার চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে চোখ পরীক্ষা করা জরুরি। এতে প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে সহজে চিকিৎসা করা যায়।

► ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাথমিক কোনো লক্ষণ দেখা দিলে, এমনকি চোখের যেকোনো অসুবিধায় তত্ক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

► নিয়মিত শরীরচর্চা করা।

► ওজন বেশি হলে তা কমানোর দিকে নজর দেওয়া। প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের পরামর্শে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা।

► ধূমপান বর্জন।

 

https://www.youtube.com/watch?v=Geg0SPadJxM

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!