Monday, December 23
Shadow

তসলিমা নাসরিন এর স্ট্যাটাস থেকে : আমি কি সবরিমালায় ঢুকতে পারবো?

কেরালার সবরিমালা মন্দিরে, যে মেয়েদের বয়স ১০ থেকে ৫০ বছর , তারা ঢুকতে পারবে না, এই ছিল নিয়ম। দেবতা আয়াপ্পার ব্রহ্মচর্য নষ্ট হতে পারে ঋতুমতী মেয়েদের উপস্থিতিতে, এ কারণেই মেয়েদের মন্দিরে ঢোকা বারণ ছিল। কিন্তু সেদিন সুপ্রীম কোর্ট রায় দিয়েছে, সব বয়সের মেয়েরাই সবরিমালায় ঢুকতে পারবে। এই রায়ের পর চার হাজার মহিলাসহ কয়েক হাজার পুরুষ রাস্তায় মিছিল করেছে সুপ্রীম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, যে মেয়েই ঢুকতে চেয়েছে মন্দিরে, বাধা দিয়েছে আয়াপ্পা ভক্তরা। রাজনৈতিক দলগুলোও চুপ। আসলে আয়াপ্পা ভক্তরা, এমনকী মেয়েভক্তরাই যদি না চায় মেয়েরা মন্দিরে ঢুকে দেবতা আয়াপ্পার ধ্যান ভঙ্গ করুক, তবে কেন সুপ্রীম কোর্ট এমন এক রায় দেবে, যে রায় সবরিমালার ঐতিহ্যকে ভেঙ্গে চুরচুর করে! ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে জান দেবে ভক্তরা। পরিস্থিতি এখন এমন। কেরালার সরকার সুপ্রীম কোর্টকে রায় নিয়ে আবার ভেবে দেখতে অনুরোধ করেছে।

আজ সন্ধ্যেয় আমি শুধু একটি প্রশ্ন করেছি টুইটারে। স্রেফ জানার জন্য। প্রশ্নটি হলো, ‘আমি নাস্তিক মানুষ, বয়স ৫০য়ের ওপর, আমি কি সবরিমালায় ঢুকতে পারবো?’ সারা পৃথিবীতে প্রচুর গির্জা, সিনেগগ, মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা দেখেছি আমি, শিল্প এবং স্থাপত্যের প্রতি যেহেতু প্রবল আকর্ষণ আমার। দুটি মন্দির পেয়েছি, পুরীর জগন্নাথ মন্দির, আর কাঠমুন্ডুর একটি মন্দির– যেখানে হিন্দু নই বলে ঢুকতে দেয়নি আমাকে। তাছাড়া আর কোনও মন্দির কোনও অসুবিধে করেনি। কলকাতার সবচেয়ে বড় যে মন্দির, দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির, সেখানের গর্ভগৃহেও আমাকে ঢোকানো হয়েছে, কালীর শরীরের বেনারসি খুলে আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছে। একেক মন্দিরে একেক রকম নিয়ম। মসজিদগুলোও তাই, কোথাও ঢুকতে দেয়, কোথাও দেয় না। সে কারণেই জানতে চেয়েছি যে সবরিমালায় ঢোকার জন্য কি হিন্দু হতে হবে? আমাকে আবার মুসলমান ভেবে মন্দিরের দরজা যেন আরো শক্ত করে বন্ধ না করে দেয়, সেজন্য সত্য তথ্যটাই জানিয়েছি যে আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার প্রশ্নের শত শত উত্তর যা মিললো, তার সবই প্রায় অকথ্য গালি গালাজ। মসজিদে মেয়েদের ঢোকার ব্যপারে যে বাধা, গির্জা বা মন্দিরে সেই বাধা নেই বলে সবসময় ভালো বোধ করেছি। এখন শুধু একটি প্রশ্ন করাতে যে উত্তর পেয়েছি তা হলো, আমি নাস্তিক, আমি কেন মন্দিরে যেতে চাই, যেহেতু আমি আয়াপ্পা ভক্ত নেই, ভেতরে গিয়ে পুজো করবো না, সে কারণে মন্দিরের ভেতরে ঢোকার কোনও অধিকার নেই আমার। আমি কেন কাবার ভেতরে, বা কোনও মসজিদে ঢোকার চেষ্টা করি না, আমি কেন বাংলাদেশে ঢুকছি না, আমি কেন হিন্দুর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছি ইত্যাদি নানা কিছু ইনক্লুডিং গালি।
আমার সরল প্রশ্ন কেউ সরল ভাবে নেয় না। সবাই অভিসন্ধি খোঁজে। দুনিয়াটাই পালটে গেছে, সত্যিই। আমার প্রশ্নের উত্তরে ওরা বলতে পারতোঃ ‘ আমরা ৫০য়ের বেশি বয়সী মেয়েদের মন্দিরে ঢোকার অনুমতি দিই, তবে তাকে হিন্দু হতে হবে, তা না হলে চলবে না’। বলতে পারতো, ‘হ্যাঁ আমরা সুপ্রীম কোর্টের রায় মানিনা, ৫০য়ের নিচে নয়, ৫০য়ের বেশি বয়সী মেয়েরা সবাই অনুমতি পাবে, কে কোন ধর্মে বিশ্বাসী অথবা বিশ্বাসী নয়, সেটা ব্যাপার নয়।’

কী সাধারণ একটু প্রশ্নেই মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগে যায় আজকাল। মুসলমানদের যদি বলি, মুহম্মদ ৪০ বছর বয়সে মুসলমান হয়েছিলেন, বা মুহম্মদের বাপ ঠাকুর্দা কেউ মুসলমান ছিলেন না, অমনি তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগে যায়। ধার্মিক খ্রিস্টানকে যদি বলি মেরি তো ভার্জিন ছিলেন না, ভার্জিনদের তো বাচ্চা হতে পারে না, ঠিক না? অমনি তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। সত্য কথা, সরল সহজ জিজ্ঞাসা আজকাল কেউ সহ্য করতে পারছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!