Monday, December 23
Shadow

রেললাইনের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েন সুমন জাহিদ

ট্রেন আসার শব্দ শুনে রেললাইনের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলেন সুমন জাহিদ। ঘটনাস্থলে থাকা এক শিশু ও এক নারী তাঁকে সরতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি সরেননি। একপর্যায়ে শিশুটি তাঁর পা ধরে টানলে তিনি লাথি মেরে শিশুটিকে সরিয়ে দেন। এরপরই দ্রুত গতির ট্রেনটি তাঁকে দ্বিখণ্ডিত করে চলে যায়।

শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের ছেলে ব্যাংক কর্মকর্তা সুমন জাহিদের দ্বিখণ্ডিত লাশ গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বাগিচা-সংলগ্ন রেললাইন থেকে উদ্ধার করা হয়। তাঁর মৃত্যুর ঘটনার এমনটাই বর্ণনা দিচ্ছে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক শিশু। নাদিয়া আক্তার নামের শিশুটি খিলগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এক ভাই এক বোনের মধ্যে সে ছোট। তার মা নুরুন্নাহার বেগমের চায়ের দোকানটি ঠিক ঘটনাস্থলেই।

লাশ উদ্ধারের পর সুমনের স্বজনেরা এটিকে পরিকল্পিত হত্যা বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পলাতক দুই যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার পর থেকে তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল বলে জানান স্বজনেরা। পুলিশও বিষয়টি জানত। তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছিল। পুলিশ তাঁকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করার পরামর্শও দিয়েছিল।

বৃহস্পতিবার ঘটনার সময় নাদিয়াদের চায়ের দোকান বন্ধ ছিল। সে আরও তিনটি শিশুর সঙ্গে সেখানে খেলছিল। তাদের বাসাটিও ঘটনাস্থল থেকে ১৫-২০ কদম দূরে। আজ শুক্রবার দুপুরে সেখানে গেলে সুমন জাহিদের মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা দেয় নাদিয়া। এ প্রতিবেদক যখন ঘটনাস্থলে যান, তখন বাজার থেকে চাল-ডাল, সেমাই কিনে মায়ের সঙ্গে ফিরছিল সে।

নাদিয়া জানায়, বৃহস্পতিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা করে দোকানের সামনে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলছিল সে। তখন একটি লোককে (সুমন জাহিদ) সেখানে ঘোরাঘুরি করতে দেখে। কিছুক্ষণ পর তিনি এসে দোকানে তার পাশে বসেন। নাদিয়া বলছিল, ‘আমি কেমন আছি তা জানতে চান লোকটা। বলি, ভালো আছি।’

কিছুক্ষণ পর আরেক নারী এসে সেখানে বসেন। তিনিও নাদিয়াকে নানা প্রশ্ন করেন। একটু পরেই ট্রেন আসার শব্দ শোনা যায়। নাদিয়া বলে, ট্রেনের শব্দ শুনে সুমন চায়ের দোকানের পাটাতনের ওপর থেকে মাটিতে বসে পড়েন। নাদিয়া তখন তাঁকে সেখান থেকে উঠতে বলে। ঘটনাস্থলে থাকা নারীও সুমনকে উঠতে বলে রেললাইন পার হয়ে চলে যান।

নাদিয়া বলে, নারীটি যাওয়ার পরপর সুমন তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘সত্যি ট্রেন আসতেছে?’ নাদিয়া তাঁকে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ সত্যি ট্রেন আসতেছে।’ নাদিয়ার মুখে পরবর্তী ঘটনার বর্ণনা, ‘তখন উনি (সুমন) ওখানে শুয়ে পড়েন। আমি বলি শুয়ে পড়ছেন কেন, ওঠেন। আমি পা ধরে টান দিই। তিনি তখন আমারে লাথি মেরে ফেলে দেন সেখান থেকে। ততক্ষণে ট্রেন আইসা গেছে। আমি উইঠা দাঁড়ায় চোখ বন্ধ কইরা ফেলি। চোখ খুইলা দেখি তাঁর মাথাটা রেললাইনের মাঝে পইড়া আছে। আমি দৌড়ায়া আম্মুর কাছে গিয়ে বলি। আম্মু আইসা কাপড় দিয়ে লাশ ঢাইকা দেয়।’

নাদিয়ার মা নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ১৫-২০ দিন ধরে তিনি ওই ব্যক্তিকে (সুমন) এই জায়গা দিয়ে চলাফেরা করতে দেখেছেন। যেই ফতুয়া ওনার গায়ে ছিল, সেই ফতুয়া গায়ে দিয়েই তিনি চলাফেরা করতেন। আরও মানুষও তাঁকে দেখেছে। যেই জায়গা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেখান দিয়ে তিনি রেললাইনের এপার থেকে ওপারে যেতেন, আবার ওপার থেকে এপারে আসতেন।

নুরুন্নাহার বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে বাজার থেকে মাছ কিনে ফেরার সময় তিনি সুমনকে তাঁর দোকানে বসে থাকতে দেখেন। তখন তিনি সুমনের কাছে জানতে চান, ‘বসে আছেন কেন?’ তাঁর জবাব ছিল, ‘ভালো লাগছে না তো, এ জন্য বসে আছি।’ এরপর নুরুন্নাহার বাসার দিকে চলে যান। হাত থেকে মাছের ব্যাগটি রাখতে না রাখতেই নাদিয়া কাঁদতে কাঁদতে এসে তাকে বলে, ‘আম্মাগো আম্মাগো, আমার পাশে যে লোকটা বইসা ছিল, সে আত্মহত্যা করছে।’ তারা তখন দৌড়ে ঘটনাস্থলের দিকে যান।

সুমন জাহিদের মৃত্যুর ঘটনায় কমলাপুর রেলওয়ে থানা-পুলিশ একটি অপমৃত্যু মামলা করেছে। থানা-পুলিশ ছাড়াও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এবং গোয়েন্দা বিভাগও ঘটনার তদন্ত করছে। কমলাপুর রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, নাদিয়া, তার মা এবং আশপাশের আরও লোকজনের জবানবন্দি তাঁরা নিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা এখনই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চান না। ঘটনার সবদিক তাঁরা খতিয়ে দেখছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে ইয়াসিন বলেন, সুমন জাহিদ ছিলেন ফারমার্স ব্যাংকের শান্তিনগর ব্রাঞ্চের সেকেন্ড অফিসার। সেখানে নিজের আত্মীয়স্বজনের কিছু টাকা তিনি বিনিয়োগ করছিলেন। পাঁচ মাস আগে ব্রাঞ্চটি বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর চাকরিও নেই। এ বিষয়গুলোর কোনো প্রভাব আছে কি না, তা–ও তারা খতিয়ে দেখছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!