কানাডা একটি উন্নত দেশ। দেশটির প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষই শিক্ষিত। বিশ্বে কোয়ালিটি এডুকেশন বললেই সবার প্রথমে আসে কানাডার নাম। দেশটিকে শিক্ষার ক্ষেত্রে সুপার পাওয়ার বলা হয়। বিশ্বে প্রায় ২৬ হাজারের বেশি ইউনিভার্সিটি আছে। বিশ্বে টপ এক হাজার ইউনিভার্সিটির মধ্যে কানাডাতে আছে ২৬টি। আজকে আমরা জানবো কানাডার শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে-
কানাডিয়ানরা জন্মগতভাবে অনেকটাই মার্জিত ও শান্তিপ্রিয়। কানাডিয়ান শিশুদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় কিন্ডারগার্টেন থেকে, যখন তাদের বয়স সাধারণত ৪-৫ বছর থাকে। আর গ্রেড-১ শুরু হয় যখন তাদের বয়স থাকে ৬ বছর, যা বাধ্যতামূলক। গ্রেড-১ পাস করার পর তারা চলে যায় গ্রেড-১২ তে, যেটা মোটামুটি ১৭ বা ১৮ বছর। যাকে বলা হয় সেকেন্ডারি স্কুল ডিপ্লোমা বা হাইস্কুল ডিপ্লোমা। আবার অনেকে গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেটও বলে থাকে।
সেকেন্ডারি স্কুল ডিপ্লোমা সফলভাবে শেষ করার পর চলে যায় পোস্ট সেকেন্ডারি এডুকেশনে। কানাডাতে ১০টি প্রভিন্স বা প্রদেশ আছে। একেক প্রদেশে একেক রকম শিক্ষা ব্যবস্থা, তবে ১৮ বছর পড়াশোনা বা হাইস্কুল ডিপ্লোমা পাস করা বাধ্যতামূলক। একজন শিক্ষার্থীকে ন্যূনতম বছরে ১৯০ দিন স্কুলে যেতে হয় এবং বিশেষ কারণবশত সর্বোচ্চ ১৪ দিন অনুপস্থিত থাকতে পারে। এর বাইরে কোন ছুটি নিতে পারে না। শিশুদের ভর্তি সেশন শুরু হয় সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসে এবং শেষ হয় জুন মাসে। তবে ব্রিটিশ কলোম্বিয়া ও আলবার্টা প্রদেশ এর ব্যতিক্রম।
কানাডার শিক্ষা পদ্ধতিকে তিন ধাপে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম ধাপ প্রাইমারি এডুকেশন, দ্বিতীয় ধাপ সেকেন্ডারি এডুকেশন ও তৃতীয় ধাপ পোস্ট সেকেন্ডারি এডুকেশন।
প্রাইমারি এডুকেশন: প্রাইমারি এডুকেশন বলতে এলিমেন্টারি স্কুলগুলোকে বোঝানো হয়েছে। যা সাধারণত শুরু হয় গ্রেড-১ থেকে গ্রেড-৮ পর্যন্ত। যাদের বয়স ৬-১৪ বছর।
সেকেন্ডারি এডুকেশন: সেকেন্ডারি এডুকেশন বলতে হাইস্কুলগুলোকে বোঝানো হয়েছে। যা সাধারণত শুরু হয় গ্রেড-৯ থেকে গ্রেড-১২ পর্যন্ত। যাদের বয়স সাধারণত ১৫-১৮ বছর পর্যন্ত। এটাকে সেকেন্ডারি বা হাইস্কুল ডিপ্লোমা বা গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেট বলা হয়। সেকেন্ডারি সার্টিফিকেট ডিপ্লোমা পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা ফ্রি করা হয়েছে।
পোস্ট সেকেন্ডারি এডুকেশন: সফলভাবে হাইস্কুল ডিপ্লোমা পাসের পরেই শুরু হয় পোস্ট সেকেন্ডারি এডুকেশন, যেটাকে আমরা উচ্চতর শিক্ষা বলে জানি। এটা হতে পারে কলেজ বা ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি, হাইয়ার ন্যাশনাল ডিপ্লোমা, ট্রেড সার্টিফিকেট ও অ্যাপ্রেন্টাইশিপ।
৯১% কানাডিয়ান যাদের বয়স ২৫-৬৪ বছর, তাদের কোন না কোন একটি কলেজ বা ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি আছে। কানাডিয়ান মেয়েরা, যাদের বয়স ২৪-৩৪ বছর তাদের কোন না কোন একটি ব্যাচেলর ডিগ্রি আছে। কানাডাতে সাক্ষরতার হার ৯৯%। যাদের বয়স ১৫ বছরের বেশি এবং যারা পড়তে ও লিখতে পারে। কানাডার যে টোটাল জিডিপি (গ্রোস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট) (১.৭৮৯ ট্রিলিয়ন ডলার) যার ৬.২% খরচ বরাদ্দ দেওয়া হয় শিক্ষা খাতে। দ্য অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) যে ৩৬টি দেশ আছে, তারমধ্যে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের জন্য কানাডা ১ম স্থান দখল করে আছে।
কানাডাতে ১৫ হাজারের বেশি স্কুল আছে। এলিমেন্টারি স্কুলের সংখ্যা ১০ হাজার ১০০। সেকেন্ডারি স্কুলের সংখ্যা ৩ হাজার ৪০০। আর এলিমেন্টারি ও সেকেন্ডারি কম্বাইন্ড স্কুলের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। প্রতিটি স্কুলে প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। বর্তমানে ৫০ লাখ শিক্ষার্থী এলিমেন্টারি ও সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াশোনা করছে। কানাডাতে বর্তমানে ৭ লাখ ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষক ও অধ্যাপক আছেন।
study-cover
কানাডাতে ১৬৩টি প্রাইভেট ও সরকারি ইউনিভার্সিটি আছে এবং ১৮৩টি সরকারি কলেজ আছে। প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী পোস্ট সেকেন্ডারি বা ইউনিভার্সিটি লেভেলে পড়াশোনা করছে। যাদের বাৎসরিক টিউশন ফি মাত্র ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার ডলার। পোস্ট সেকেন্ডারি শিক্ষার্থীদের জন্য স্টুডেন্ট লোন প্রোগ্রাম চালু আছে। প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার স্টুডেন্ট প্রতি বছর লোন নিয়ে পড়াশোনা করে থাকে। এছাড়া কানাডা সরকারের মিলেনিয়াম স্কলারশিপ ফাউন্ডেশন প্রোগ্রাম আছে, যেখানে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন বাজেট রাখা হয়েছে যা ১ লাখ মেধাবীর জন্য। এমনকি শিক্ষার্থীদের বাবা-মাদের জন্য কানাডা এডুকেশন সেভিংস গ্রান্ট প্রোগ্রাম চালু করেছে সরকার।
কানাডায় দ্য ওয়ে অব ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্ট্রাকশন হলো ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ। কানাডায় ৬৭.৬% মানুষ ইংরেজিতে কথা বলে। ১৩.৩% মানুষ ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে। ১৭.৪% মানুষ ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ দুই ভাষায়ই কথা বলে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- কানাডায় একক কোন কানাডিয়ান এডুকেশন মিনিস্টার নেই। দেশটিতে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক এডুকেশন মিনিস্টারও আছেন। দ্য কাউন্সিল অব মিনিস্টার্স, কানাডা গঠন করা হয় ১৯৬৭ সালে, যেখানে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক মিনিস্টার গঠন করা হয়।
> আরও পড়ুন- জেনে নিন পাসপোর্ট বিবর্তনের ইতিহাস
কানাডায় ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টের সংখ্যাও কম নয়। কানাডিয়ান ব্যুরো ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টের তথ্যমতে, কানাডাতে বর্তমানে ৫ লাখের কাছাকাছি ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট পড়াশোনা করছে। কানাডায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে আসে। কানাডায় ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টের ২৫% চাইনিজ। বর্তমানে কানাডায় সবচেয়ে বেশি পড়াশোনার জন্য যাচ্ছে ভিয়েতনাম (৮৯%), ভারত (৬৩%), ইরান (৪৫%) এবং বাংলাদেশ (৪১%) থেকে। সমীক্ষায় দেখা যায়, কানাডায় যারা উচ্চশিক্ষার জন্য যান, তাদের প্রায় ৫১% শিক্ষার্থী নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে থাকেন।
ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা কানাডার অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে। ইমিগ্রেশন রিফিউজি ও সিটিজেনশিপ অব কানাডার তথ্যমতে, প্রায় ১২.৮ বিলিয়ন ডলার উপার্জিত হয়ে থাকে ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন সেক্টর থেকে, যা তাদের অর্থনীতির জন্য মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।
কানাডার শিক্ষা পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হওয়ার পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। যেমন-
১. ওয়ার্ল্ড ক্লাস ল্যাঙ্গুয়েজ এডুকেশন।
২. ভলেন্টিয়ারিজম এডুকেশন পদ্ধতি।
৩. কম্পিউটার বেজড এডুকেশন।
৪. ডাইভারসিফাইড ও কম্প্রিহেনসিভ কারিকুলাম।
৫. সায়েন্টিফিক টিচিং মেথড।
৬. ওয়ার্ল্ড ক্লাস থিসিস সেন্টার ও পাবলিকেশন।
৭. কালচারাল ও ফ্রেন্ডলি এডুকেশনাল এনভায়রনমেন্ট।
৮. ইথিক্যাল ও ইন্সপিরেশনাল এডুকেশন।
৯. প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মনিটরিং।
১০. প্রায় ৫৯ বিলিয়ন ডলারের শিক্ষা বাজেট।
১১. থিউরিটিক্যাল ও প্র্যাকটিক্যাল এডুকেশন অ্যাপ্রোচ।
১২. খোলামেলা ক্যাম্পাস ও প্রকৃতি সমৃদ্ধ দূষণমুক্ত পরিবেশ।