ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে দরকার পরিবেশ এবং জীবনযাত্রা প্রণালীর পরিবর্তন
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাবের তারতম্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্যান্সারই (৯০%) মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস এবং সামাজিক রীতি-নীতি ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাবকে প্রভাবিত করে। যেমন—জাপানে পাকস্থলী ও যকৃতের ক্যানসার বেশি হয়। কিন্তু সাদা চামড়াবিশিষ্ট আমেরিকানদের তুলনায় জাপানিদের অন্ত্র ও প্রস্টেট গ্রন্থির ক্যান্সার অনেক কম হয়। আবার এই জাপানিরাই যখন আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে, তখন তাদের পাকস্থলী ও যকৃতের ক্যান্সারের হার কমে যায়; অন্ত্র ও প্রস্টেট গ্রন্থির ক্যান্সার আগের তুলনায় বেড়ে যায়। এতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে পরিবেশ ও জীবনযাত্রা প্রণালী ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাবের অন্যতম কারণ।
ক্যান্সার ও জীবনযাত্রা প্রণালীকে খাদ্যাভ্যাস, সামাজিকতা বা সামাজিক অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গি—এই তিন ভাগে বিন্যাস করা যায়।
খাদ্যাভ্যাস
খাদ্য গ্রহণ প্রণালী এবং পুষ্টি ক্যান্সারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ জন্য কিছু করণীয় রয়েছে।
স্থূলতা পরিহার ও সঠিক ওজন বজায় রাখা : স্থূল দেহের সঙ্গে ক্যান্সারের সম্পর্ক রয়েছে। স্থূলকায় মহিলা এবং পুরুষের মধ্যে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব একই বয়সের স্বাভাবিক ওজনের মহিলা ও পুরুষের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি হয়। স্থূল বা মুটিয়ে যাওয়া মহিলাদের স্তন ও জরায়ুর ঝিল্লির ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পাশাপাশি স্থূল বা মোটা পুরুষদের প্রস্টেট গ্রন্থির ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই যথাসম্ভব স্থূলতা পরিহার করে দেহের সঠিক ওজন বজায় রাখা উচিত।
পুষ্টি, ব্যায়াম, বিশ্রাম, চিত্তবিনোদন : অতিরিক্ত পুষ্টির অভাব এবং কৃশতা দেহের প্রতিরোধব্যূহ দুর্বল করার পাশাপাশি ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় অনেকাংশে। তাই ক্যান্সার রোধে পরিমিত পুষ্টি গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, যথাসম্ভব বিশ্রাম ও চিত্তবিনোদনের যথেষ্ট প্রয়োজন।
টাটকা শাকসবজি গ্রহণ ও চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন : অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাংস গ্রহণ, সবজির প্রতি অনীহা এবং টাটকা দেশজ ফলমূল পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ না করা স্বাস্থ্যহীনতার পাশাপাশি ক্যানসার হওয়ার কারণ বলে পরিগণিত। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার বৃহদন্ত্রে পিত্তরসের অন্যতম উপাদান বাইল এসিডের সমন্বয়ে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থের উদ্ভব ঘটায় এবং মলের গতিবেগ অনেক শ্লথ করে ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থের উদ্ভব ঘটায়। এতে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ দীর্ঘ সময়ব্যাপী ঝিল্লির সংস্পর্শে থেকে ক্যান্সার সৃষ্টিতে সাহায্য করে। অপরপক্ষে শাকসবজি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থকে শোষণ করে এবং মলের গতিবেগ বাড়িয়ে দ্রুত মল নিষ্কাশনে সাহায্য করে। ফলে ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ বেশিক্ষণ অন্ত্রের ঝিল্লির সংস্পর্শে থাকতে পারে না।
ভিটামিন এবং ট্রেস এলিমেন্ট
ভিটামিন এ, সি ও ই, আয়রন, কপার, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, মলিবডেনাম দেহের জন্য বেশ দরকারি। এসব খাদ্য-উপাদান যৎসামান্য পরিমাণ গ্রহণ করলেও পুষ্টির প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটে। টাটকা শাকসবজিতে এসব উপাদান প্রচুর পরিমাণে থাকে এবং তা সহজলভ্যও বটে।
সামাজিক অভ্যাস
মুখের ও খাদ্যনালির ক্যানসার দ্রুত উত্পাদন করে ধূমপান বা মদ্যপান। শুধু ধূমপান বন্ধ করতে পারলে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ শতাংশ ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। অথচ তামাক, বিড়ি, সিগারেট, মদ, হুঁকা, জর্দা, সাদা পাতা, খইনি, গুল প্রভৃতির ব্যবহার সামাজিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মানুষ এগুলো নিজেরা ব্যবহার করার পাশাপাশি বন্ধুবান্ধব ও সহযোগীদের নিয়েও উপভোগ করে। তাই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও অল্প বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের ধূমপান ও মদ্যপানের কুফল সম্পর্কে ব্যাপক অবগত করানোর পাশাপাশি এসবের সব ধরনের বিজ্ঞাপন বন্ধ তথা নেশাজাতীয় খাবার বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে।
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
ক্যান্সার সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন দরকার। এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য ব্যাধি, যার চিকিৎসাও রয়েছে—এ বাণীটি সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। যেসব কারণে ক্যানসার হয়, তা এড়িয়ে চললে যেমন প্রতিরোধ করা যায়, তেমনি কোনো কারণে ক্যানসার হয়ে গেলে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলেও ক্যানসার নিরাময় সম্ভব।