class="post-template-default single single-post postid-1829 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

প্রবাস : শেকড়ে ফেরা যখন কেবলই কাঁদায়

বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, তিনি বেঁচে না থাকলেও আমি এ বাড়িতে আসব। হাজারো ব্যস্ততা পেছনে ঠেলে হলেও আসব। গিয়েছি। কিন্তু আগের মতো উচ্ছ্বাস নেই, আনন্দ নেই। পুরোটা পথ অনুভূতিহীন এক প্রাণ নিয়ে গিয়েছি যদিও, রাতে ঘুমোতে গিয়ে আবিষ্কার করি, আসলে বাবার বাড়ি, বাবার বাড়িই। যেখানে গেলে কোনো দায়িত্ব কিংবা ভাবনা থাকে না। কেমন যেন এক শান্তি শান্তি ভাব লেগে থাকে মন, প্রাণ ও শরীরে। নিশ্চিন্ত এক জীবন। বাবা-মার শূন্যতা ছিল যদিও, কিন্তু সেখানকার প্রতিটি ইট-পাথর, আসবাবপত্রে বাবা-মার ছোঁয়াতো লেগে আছে।

গ্রামে দাদার বাড়ি গিয়ে মনটা বিষণ্ন হলো কিঞ্চিৎ। আমাদের ছোটবেলায় সেই আশির দশকের শুরুর দিকে শখ করে একতলা বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন বাবা। অথচ অযত্নে, অবহেলায় সবকিছু কেমন ভগ্নপ্রায়! বাড়ির পেছনে বিশাল বাগান। নারকেল, সুপারি ও আমসহ কতরকম গাছ সেখানে! নিজ হাতে কত যত্ন করেই না লাগিয়েছিলেন। গাছগুলো একইভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কাকার ঘরে গিয়ে বসি। বাবার একমাত্র ছোট ভাই। সেই আগের মতোই স্নেহ, মায়া আর গভীর মমতায় কাছে ডেকে বসান। এটা-সেটা খেতে দেন। বাবা-কাকার মাঝে চিরকালই মতবিরোধ ছিল। কখনো খুব ভাব, কখনো মুখ দেখাদেখি বন্ধ। দুই ভাইয়ের মাঝে সম্পর্ক যা-ই থাকুক না কেন, আমরা কখনোই কাকার আদর ভালোবাসা থেকে বিন্দুমাত্র বঞ্চিত হইনি। কাকিমা দুপুরের খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বলেন, তোর বাবা-মা নেই তো কী হয়েছে, আমরা আছি না? আসলে রক্ত সম্পর্কগুলো মনে হয় এমনই। যুগ যুগ পর দেখা হলেও সেই নির্ভরতার হাত মাথার ওপর ছায়া দেবেই। আগলে রাখবেই। দুপুরের পর আমরা তিন ভাইবোন দিঘির জলের পাশে বসি ক্ষণিক। যে দিঘিতে বাবা-চাচারা ধুপধাপ ঝাঁপিয়ে পড়তেন, ডুবতেন, আবার ভেসে উঠতেন। সাঁতরে এপার-ওপার যেতেন।

ওখান থেকে কবরস্থান বেশ কাছাকাছি দূরত্বে। চারদিকে ইটের দেয়াল তোলা। পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকালে বাবা গ্রামে ও শহরে ইটের দালান তৈরি করে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করেছিলেন। জীবনের শেষ সময়ে যখন প্যরালাইজড শরীর নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গ্রামে যেতেন, আমি কপট রাগ করতাম। ফোন করে বলতাম, কেন অসুস্থ শরীর নিয়ে এত খাটাখাটুনি করছেন! মানুষ কী তাঁর শেষ সময়টুকুর আভাস আগেভাগে বুঝতে পারে? কিংবা জীবনের শেষ সময়ে মানুষ কী তাঁর শৈশব, কৈশোরের স্থানে ফিরে যেতে চায়? নইলে বাবা কেন তখন অসুস্থ শরীর নিয়ে এত ঘন ঘন গ্রামে যেতেন! বলতেন, কবরস্থানের চারপাশটায় ওয়াল তুলে দিই, গরু-ছাগল যেন ঢুকতে না পারে। মরলে তো আমাকে এখানেই মাটি দেবে। আমি হাসতাম। ভাবতাম মৃত্যুর পর নিজের মৃতদেহ নিয়ে কেউ ভাবে নাকি! আমার বাবা ভাবতেন। আমাদের পুরো গ্রামের কবরস্থানের চারপাশে ওয়াল তুলেছেন গবাদিপশু যেন অবাধে সেখানে বিচরণ করতে না পারে, অপরিষ্কার করতে না পারে। যে বাবা জীবনভর পরিচ্ছন্ন থেকেছেন, পরিকল্পনার মাঝে সামনে এগিয়েছেন। সেই বাবা-মা এখন নিজেদের প্রস্তুত করে রাখা কবরে ঘুমিয়ে আছেন।

আমরা তিন ভাইবোন বাবা-মার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকটা সময়। এই যে আমি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে দূর পরবাস থেকে এসেছি, সঙ্গে আমার ভাইবোনেরা ঢাকা থেকে এসেছে, বেঁচে থাকলে কতই না খুশি হতেন তাঁরা। তাঁদের আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত হাসিমাখা মুখ যেন জ্বলজ্বল করছিল চোখের সামনে। এমন নানান টুকরো টুকরো বিষয় মনে পড়ছিল। আমি বাবা-মার সমাধিফলকে হাত ছোঁয়াই। আমার মনে হচ্ছিল, আমি বাবা-মাকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অঝোরে কাঁদি। আমার ভাইবোনও অশ্রুজলে ভাসে। আমরা কেউই কাউকে সান্ত্বনা দিইনি। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম মনে নেই। অদূরেই, পাশ দিয়ে বহমান স্রোতস্বিনী নদীর ধারে অপেক্ষমাণ গাড়িটি দাঁড়িয়েছিল। হাতের তালুতে চোখ মুছে গাড়ির দিকে ফিরছিলাম। অবচেতন মনে, মনে হলো যেন দুটি মানুষ করুণ চোখে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে তীব্র আকুতিতে বলছেন—‘চইলা যাইতাছস? আরও কিছুক্ষণ থাক না রে, মা।’ আমি এক পা, দুই পা করে গাড়ির দিকে যেতে থাকি।

প্রতিবার আমার বিদায়বেলায় বাবা এমন করে বলতেন, আর কয়টাদিন থাক্ না রে মা। আমি খুব ধীরে আবারও বাবা-মার কবরের পাশে এসে দাঁড়াই। বুকফাটা আর্তনাদে অঝোরে কাঁদি, নিঃশব্দে। মৃত বাবা-মার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এমন হৃদয় বিদীর্ণ করা হাহাকার সেখানে ঘুমিয়ে থাকা আমার সকল পূর্ব পুরুষেরা শুনতে পেয়েছেন কিনা জানি না। তবে আকাশের ওই পাড়ে যে স্রষ্টা থাকেন, তিনি নিশ্চয়ই শুনবেন, হয়তো মুখ তুলে তাকাবেন পৃথিবীর দিকে, বাবা-মার কবরের পাশে বুকচেরা দীর্ঘশ্বাসে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের তিন ভাইবোনের দিকে।

রিমি রুম্মান: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!