Monday, December 23
Shadow

প্রবাসীর চিঠি : রাতের মরুভূমি নদীর মতো

মরুভূমিএমন একটি সময় ছিল-প্রতিদিন অন্তত একবার নদীর কাছে না গেলে দিনটি অসম্পূর্ণ থেকে যেত আমাদের। প্রিয় আলম, তোর মনে পড়ে-তখন স্কুল শেষ করে কেবল কলেজে যাচ্ছি আমরা। মনটা ছিল আকাশের মতো। ভাবতাম পৃথিবীটা আমার।

ভালোবাসা শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেছি। চোখের সমানে যা কিছু আছে সবই রংচঙে, অন্য রকম। বুকের ভেতর কোটি স্বপ্ন-বিপ্লব ঘটিয়ে বদলে দেবে গোটা পৃথিবী। কার্ল মার্ক্স, চে গুয়েভারা, হো চি মিন, মাও সেতুং, ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস আর লেনিন নিয়ে চলত তর্ক। আবার কেউ বলত-ইসলামের খলিফাদের কথা। হজরত ওমর কী করে দেশ চালাতেন। কতটা সাধারণ জীবন ছিল তাদের।

কথায় কথায় আমাদের রাত পার হতো গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ইবসেন, গ্যোটে, রবীন্দ্রনাথ, ম্যাক্সিম গোর্কি, জন মিলটন, নজরুল; কে কত জীবন ঘনিষ্ঠ লেখা লিখতে পেরেছেন।

বন্ধু, বর্ষাটা অন্য রকম কাটত আমাদের তাই না? সন্ধ্যার কিছু আগে নৌকা নিয়ে ভাসতে শুরু করতাম আড়িয়ল খাঁ নদীতে। আকাশে চাঁদ থাকত কোনো দিন। আবার কোনো কোনো দিন চাঁদ আর মেঘের খেলা চলত। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টিতে ভিজতাম আমরা। গলা ছেড়ে গান গাইতাম। তোদের কী মনে পড়ে না? সেই সব দিনের কথা।

আমাদের আড্ডার সময়টা কখনোই ভালো চোখে দেখত না আব্বা। শুধু আব্বা কেন, কেউ ভালো চোখে দেখেননি কোনো দিন। অথচ ওটাই ছিল আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়!

অনেক দূরে আছি, আমার প্রিয় শহর আর প্রিয় নদী থেকে। জানিস মধ্যরাতে কে যেন বুকের ভেতর হাঁটে। ট্রেনের মতো গড়গড় করে কী যেন বয়ে যায়। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই প্রিয় শহর, আর একটি নদী।

সজল গাইত নজরুল গীতি—‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো/ তবু আমারে দেবো না ভুলিতে…।’ শামিম গাইত—‘ও প্রাণ সজনী কাটে না দিন রজনী…।’ আমার প্রিয় নজরুল গীতি ছিল—মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে বিদায় সন্ধ্যাবেলা/ আমি দাঁড়ায়ে রহিনু এপাড়ে তুমি ওপাড়ে ভাসালে ভেলা…মনে পড়ে…’

কত দ্রুত বদলে গেল সব! হঠাৎ করেই মারা গেল এনায়েত। ক্যানসারের সঙ্গে বহুদিন যুদ্ধ করে বিদায় নিয়েছে ইমদাদুল।

নাইম কী এখনো চিৎকার করে আবৃত্তি করে জীবন দাসের কবিতা—আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি! আবার বছর কুড়ি পরে…।’

বিপ্লব এখন অনেক ব্যস্ত একজন মানুষ। জনপ্রতিনিধি। কাউন্সিলর। তোর হাতেও সময় থাকে না এখন আর। ব্যাংকারদের খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। এত দূরের দেশে এসেও আমার হাতেই কেবল অফুরন্ত সময়। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে এত ভালো লাগে কেন? দূরে আছি বলেই কী?

এখনো কী নদীর পাড়ের আড্ডা চলে তোদের? গলা ছেড়ে গান গায় শামিম? ইউরোপে গিয়ে শিপু, শাহাদত আর মতিন কেমন আছে? ওদের কী কোনো খবর জানিস?

তোদের কারও সঙ্গে কী সাগরের যোগাযোগ আছে? আকাশ সমান অভিমান নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেল। আর হয়তো ফিরবে না কোনো দিন। হয়তো আবার ফিরবে, জন্মভূমি ছেড়ে থাকার চেয়ে বড় কষ্ট আর কিছুতেই নেই। শুনেছি সাগর এখন বিখ্যাত কবিদের একজন। ভালো কবিতা লেখে।

সবার কথা খুব মনে পড়ে। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে নদীটাকে। নদীর সঙ্গেও যে প্রেম হতে পারে, নদীর কথা ভেবেও যে চোখে জল আসে, দেশে থাকলে হয়তো বোঝা হতো না কোনো দিন।

বর্ষা এলে এখনো কী নৌকা ভাসে নদীতে? কত দিনের স্মৃতি, কত কথা, কত গান, কবিতা—শুধু আমি পড়ে রইলাম অনেক দূরে। জানিস রাতের মরুভূমি একেবারেই নদীর মতো দেখতে। আজকাল চোখে এতজল আসে কেন, কে জানে।

বন্ধু, যে নক্ষত্ররা ঝরে পড়ে উল্কা হয় তাদের একা থাকার বেদনা কেউ বুঝবে না কোনো দিন।

আচ্ছা, এখনো কী দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যাস তোরা? ইউনিভার্সেল টকিজে নাইট শো। সবাই বলত—বাদামতলা। আসল নামটা কেউ কোনো দিন বলল না।

কালার হোটেলটা কী এখনো আছে সিনেমা হলের সামনে? তোদের মনে আছে-নাইটা শো দেখে বেরিয়ে পেটে ভরে রুটি আর মাংস খেতাম। তারপর সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাড়ির দিকে হাঁটতাম।

তোরা সবাই কেমন আছিস? আমার কথা কী ভুলে গেছিস, নাকি মনে পড়ে? চিঠি লিখতে বসে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। স্মৃতি এত কষ্ট দেয় কেন বলতে পারিস?

সে কেমন আছে? তোদের সঙ্গে কী দেখা হয় তার? শুনেছি তার বিয়ে হয়ে গেছে। কত দিন দেখা হয়নি সেই মুখ।

আর লিখতে পারব না। চোখের জলে হয়তো চিঠি ভিজবে এখন! ভালো থাকিস।

তোর বন্ধু,
সাইফুল
২০৮, আল নাহ্দা স্ট্রিট
রাবুয়া, রিয়াদ, সৌদি আরব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!