অনেক দিন ধরে লোকজন বলাবলি করছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আসছে, তা একদিন সংঘাতে রূপ নেবে। আদতে সেই মুহূর্ত চলে এসেছে। এ রকমের একটি দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধের জামানায় আপনাদের স্বাগত।
আমেরিকা মনে করে চীন স্বৈরাচার দেশ; তারা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ১০ লাখ উইঘুর মুসলমানকে আটকে রেখেছে; খ্রিষ্টানদের ওপর তারা দমন-পীড়ন চালাচ্ছে; সাধারণ মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে এবং বেহিসাবিভাবে শিল্পকারখানা গড়ে তুলে পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, চীন যেসব সামরিক স্থাপনা গড়ে তুলছে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এমনভাবে আধিপত্য বিস্তার করছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে।
অন্যদিকে চীন মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। দেশটি ভয়ভীতি দেখিয়ে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশগুলোর কাছ থেকে নিঃশর্ত আনুগত্য আদায় করে এসেছে। চীন মনে করে, ট্রাম্প প্রশাসন চীনের বিরুদ্ধে যে বাণিজ্যযুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তার মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক ও আদর্শিকভাবে ওয়াশিংটন বেইজিংয়ের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে চায়।
সাদা চোখে মনে হতে পারে চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে দুই দেশের আদর্শিক ভিন্নতা। আদতে কিন্তু তা নয়, বরং এই দুই দেশের চরিত্র ক্রমাগত অভিন্ন চেহারা পাচ্ছে বলেই তারা আরও বেশি সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। যোগ্যতা ও ক্ষমতার দিক থেকে দুই দেশ যত বেশি সমান্তরাল জায়গায় আসছে, তাদের বৈরিতা তত বাড়ছে।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীন এবং আমেরিকার ভূমিকা এত দিন ‘ইন অ্যান্ড ইয়াং’-এর (দুই বস্তুর একে অপরের পরিপূরক অবস্থান বোঝাতে একটি বৃত্তের অর্ধেক কালো ও অর্ধেক সাদা দিয়ে ভরা ডায়াগ্রাম বিশেষ) মতো ছিল। দীর্ঘদিন আমেরিকা ভোক্তার ভূমিকায় আছে। চীন আছে উৎপাদনকারীর ভূমিকায়। ভোক্তা ও সরবরাহকারী এই দুই দেশের অর্থনীতির সম্মিলিত চেহারাকে অনেকে ‘চিমেরিকা’ বলে ডাকে। কিন্তু চিমেরিকা এখন আর আগের জায়গায় নেই। ক্রমেই সেই দেওয়া-নেওয়া কমে এসেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ নীতিতে বৈশ্বিক বাজারে চীনের আধিপত্য আরও বাড়ানোর কথা বলেছেন। এত দিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের প্রযুক্তিবিদেরা চীনে তাঁদের উদ্ভাবন-কৌশল রপ্তানি করেছেন। কিন্তু চিন পিং চান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তাঁর দেশ নেতৃত্ব দেবে। এর মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর চীনে একচেটিয়া বিনিয়োগ কমিয়ে আনা হবে। চীনের এই নীতির কারণে আমেরিকার টিম জিএএফএএম-এর (গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক, আমাজন, মাইক্রোসফট) ও চীনের টিম বিএটিএক্স (বাইডু, আলিবাবা, টেনসেন্ট, শাওমি) মধ্যে ইতিমধ্যেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গেছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ধরে একটি বাণিজ্য এলাকা গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পাল্টা জবাব হিসেবে চীনের প্রেসিডেন্ট সি তাঁর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ঘোষণা করেন। সেটাকে এখন মোকাবিলা করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। চীনের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে ট্রাম্প চীনের ওপর একের পর এক করের বোঝা চাপিয়ে যাচ্ছেন। তবে তাতে চীনকে মোটেও আপসকামী হতে দেখা যাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের পর এখন সবচেয়ে বেশি সামরিক ব্যয় করছে চীন। তারা প্রথমবারের মতো বিমানবাহী রণতরি তৈরি করেছে। তারা অ্যান্টি অ্যাকসেস/অ্যান্টি ডিনায়াল (এটু/এডি) ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করছে। দেশের বাইরে প্রথমবারের মতো সামরিক ঘাঁটি বানাচ্ছে জিবুতিতে। তার মানে চীন শুধু আঞ্চলিক আধিপত্যের আশা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে না। তারা বৈশ্বিক নেতৃত্ব কবজা করার চেষ্টায় আছে। এই চেষ্টার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা চীনকে দমিয়ে রাখার জন্য সব চেষ্টাই করে যাচ্ছে।
এই দুই শক্তির মধ্যে ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের যে চাপা লড়াই চলছে, তাকেই বলা হচ্ছে দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ। এই দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ এখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দুই সুপার পাওয়ার ধীরে ধীরে ক্ষমতার দিক থেকে যত বেশি সমান হতে থাকবে, সংঘাত তত বেশি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। চীনের উন্নয়নের গতি দেখে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সব দিক থেকে সমান হয়ে উঠতে তার বেশি সময় লাগবে না।