Saturday, April 20
Shadow

পিজি হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. রেজাউল করিম কাজলের পরামর্শ : আল্ট্রাসনোগ্রাফি মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমায়

গর্ভবতীর গর্ভবতী আল্ট্রাসনোগ্রাফি

গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসনোগ্রাফি

গর্ভবতী মায়ের সেবা প্রদানের শক্তিশালী হাতিয়ার আল্ট্রাসনোগ্রাফি, যা মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও অপরিহার্য। দেহের প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা সম্ভব। পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল

 

শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরের ছবি পর্দায় দৃশ্যমান করার পদ্ধতির নাম আল্ট্রাসনোগ্রাফি। ১৯৫০ সালে ডা. আয়ান ডোনাল্ড এ পদ্ধতি চালু করেন। এর শব্দতরঙ্গ আমাদের শ্রবণসীমার বাইরে। এতে কোনো তেজস্ক্রিয় রশ্মি বা এক্স-রে ব্যবহার করা হয় না বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তা এক যুগান্তকারী ও নিরাপদ রোগ নির্ণায়ক পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। দেহের প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা সম্ভব।

 

গুরুত্ব

গর্ভাবস্থার শুরুতেই অর্থাৎ মাসিক বন্ধের দুই মাস বা ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো উচিত। টেস্টটিউব বেবির ক্ষেত্রে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের চার সপ্তাহ পর। আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে অনেক তথ্য জানা যায়। যেমন—

❏ জরায়ুর অভ্যন্তরে সঠিক স্থানে হৃৎস্পন্দন ও গর্ভসঞ্চার হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করে।

❏ ভ্রূণের সংখ্যা নির্ণয় করে।

❏ সঠিকভাবে প্রসবের তারিখ নির্ণয় করে। বিশেষত যাদের অনিয়মিত মাসিক হয়।

❏ এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বা অস্বাভাবিক স্থানে গর্ভসঞ্চার নির্ণয় করে, এ ধরনের গর্ভাবস্থা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।

❏ গর্ভপাতের পূর্বাভাস প্রদান করে। গর্ভথলির আকার, আয়তন ও ভ্রূণের হৃৎস্পন্দনের অসামঞ্জস্যতা নির্ণয় করে।

❏ জরায়ু বা ডিম্বাশয়ে কোনো গঠনগত ত্রুটি বা টিউমার আছে কি না তা-ও জানা যায়।

 

১১-১৪ সপ্তাহে আল্ট্রাসনোগ্রাফি

গর্ভাবস্থায় ১১-১৪ সপ্তাহের আল্ট্রাসনোগ্রাফি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় বাচ্চার আকার থাকে এক থেকে দেড় ইঞ্চির মতো। এ সময় বাচ্চার ঘাড়ের পেছনের তরলের মাত্রা, নাকের হাড়ের উপস্থিতি, প্রাথমিক রক্তবাহী নালি ‘ডাকটাস ভেনোসাস’-এর রক্ত চলাচলের গতি-প্রকৃতি দেখে বাচ্চার জেনেটিক বা ডিএনএ-ঘটিত ত্রুটি নির্ণয় করা যায়। এ জন্য একে ‘জেনেটিক আল্ট্রাসনোগ্রাফি’ বলে। এর মাধ্যমে যেসব রোগের পূর্বাভাস প্রদান করা হয় তা হলো—

❏ ক্রোমোজোম-ঘটিত ত্রুটি যেমন : ডাউন সিনড্রোম, এডওয়ার্ড সিনড্রোম, পাটাউ সিনড্রোম, ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোম, টার্নার্স সিনড্রোম ইত্যাদি।

❏ জন্মগত হার্টের ত্রুটি, মস্তিষ্কের গঠনগত ত্রুটি, হাত-পায়ের হাড়ের অসংগতি নির্ণয়।

❏ যাদের গর্ভপাতের ইতিহাস রয়েছে, এর মাধ্যমে তাদের জরায়ুমুখের শিথিলতা রয়েছে কি না তা জানা যায়। ফলে সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

❏ গর্ভাবস্থায় মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, খিঁচুনি হতে পারে কি না তারও পূর্বাভাস পাওয়া যায়।

 

১৮-২২ সপ্তাহে আল্ট্রাসনোগ্রাফি

১৮-২২ সপ্তাহের ভ্রূণটি একটি পূর্ণাঙ্গ মানবশিশুর রূপ ধারণ করে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হয়ে যায়। এ সময় আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে প্রতিটি অঙ্গের গঠনগত ত্রুটি সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় বলে একে অ্যানোম্যালি স্ক্যান বলে। এ সময়ের আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে যা যা দেখা যায়, তা হলো—

❏ বাচ্চার মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গ, যেমন : মস্তিষ্কের গঠন, চোখ, ঠোঁট, তালু, মুখমণ্ডল, পাকস্থলী, লিভার, কিডনি, হার্ট, হাত-পায়ের আঙুল ইত্যাদি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও ত্রুটি নির্ণয়।

❏ বাচ্চার নড়াচড়া, গর্ভকালের সঙ্গে বাচ্চার দৈর্ঘ্য, আকার-আয়তন, ওজন ঠিক আছে কি না।

❏ বাচ্চার চারপাশের তরল বা অ্যামোনিওটিক ফ্লুইড ঠিক আছে কি না।

❏ জরায়ুতে গর্ভফুলের অবস্থান নির্ণয়। গর্ভফুল জরায়ুমুখের কাছে অবস্থান করলে পরবর্তী সময় অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা ও গর্ভকালীন রক্তক্ষরণের পূর্বাভাস প্রদান।

❏ জরায়ুমুখের দৈর্ঘ্যে কোনো অসামঞ্জস্যতা বা শিথিলতা থাকলে অসময়ে প্রস্রব বেদনা ওঠা বা গর্ভপাতের পূর্বাভাস প্রদান।

❏ মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার গায়ে সঠিক মাত্রায় রক্ত চলাচল ঠিক আছে কি না, পরবর্তী সময় বাচ্চার পুষ্টির ঘাটতি হয়ে কম ওজনের শিশু জন্ম লাভ করতে পারে কি না তার পূর্বাভাস প্রদান করে।

 

২৮-৩২ সপ্তাহে আল্ট্রাসনোগ্রাফি

গর্ভাবস্থায় শেষের দিকে, অর্থাৎ তৃতীয় ভাগে শেষবারের মতো আল্ট্রাসনোগ্রাফির প্রয়োজন হয়। দীর্ঘ কয়েক মাস গর্ভধারণের পর বাচ্চার কী পরিণতি হতে যাচ্ছে, সুস্থ সন্তানের জন্ম দান, প্রসবকালীন জটিলতা এড়ানোর জন্য এই আল্ট্রাসনোগ্রাফি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে যা দেখা যায় তা হলো—

❏ আকার, আয়তন ও ওজনে সঠিক মাত্রায় বাচ্চা বৃদ্ধি পেয়েছে কি না। এই আল্ট্রাসনোগ্রাফিতেও যদি দেখা যায় বাচ্চার ওজন বাড়ছে না, তবে এ অবস্থাকে কম ওজনের শিশু বলা হয়। তখন নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যার ব্যবস্থা আছে—এমন হাসপাতালে এসব শিশু প্রসবের পরামর্শ দেওয়া হয়।

❏ এমন কোনো ত্রুটি, যা আগে ধরা পড়েনি, তা নির্ণয়।

❏ বাচ্চার চারপাশের তরল বা অ্যামোনিওটিক ফ্লুইড, যা বাচ্চাকে পুষ্টি জোগায় ও বিনা আঘাতে নড়াচড়ায় সহায়তা করে। আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে এই তরল পদার্থের স্বল্পতা বা আধিক্য নির্ণয় করা হয়, যা প্রসব পরিকল্পনায় ভিন্নতা আনতে পারে।

❏ জরায়ুতে বাচ্চার সঠিক, উল্টো বা আড়াআড়ি অবস্থান ইত্যাদি নির্ণয় করে, যার কারণে স্বাভাবিক প্রসবে জটিলতা হতে পারে বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তানের জন্মদানের প্রয়োজন হতে পারে।

❏ জরায়ুতে গর্ভফুলের শেষ অবস্থান নির্ণয়। যদি দেখা যায়, গর্ভফুল বা প্লাসেন্টা জরায়ুমুখকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলেছে, তাহলে ওই মায়ের কখনোই স্বাভাবিক পথে সন্তান প্রসব করানো যাবে না। তখন অবশ্যই সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করাতে হবে। এতে প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হতে পারে, এমনকি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে না পারলে মায়ের জীবন বাঁচাতে জরায়ু কেটে ফেলতেও হতে পারে।

 

বিশেষ ধরনের আল্ট্রাসনোগ্রাফি

কালার ডপলার : এর মাধ্যমে বাচ্চার রক্ত চলাচলের গতিপ্রকৃতি, মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহের তারতম্য ইত্যাদি নির্ণয় করে সঠিক ওজন বৃদ্ধি, সুস্থতা বা বিপত্সংকেত প্রদান করা যায়।

বায়োফিজিক্যাল প্রোফাইল : গর্ভাবস্থার শেষের দিকে মা অথবা বাচ্চার কোনো সমস্যা সন্দেহ হলে এই বিশেষ ধরনের আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা হয়। এর মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্ত নড়াচড়া, হৃৎস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাস, হাত-পায়ের পেশির সংকোচন-প্রসারণ, চারপাশের তরল পদার্থের মাত্রা ইত্যাদি পরীক্ষা করে বাচ্চার সুস্থতা বা বিপদ সম্পর্কে কমপক্ষে সাত দিন আগে পূর্বাভাস প্রদান করা যায়, যা দেখে প্রসব পরিকল্পনা করতে চিকিৎসকের সুবিধা হয়।

 

 

৩ডি/৪ডি আল্ট্রাসনোগ্রাফি : দক্ষ সনোলজিস্ট একটি উন্নত মেশিন দিয়ে সাধারণ দ্বিমাত্রিক আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে বাচ্চার সব ধরনের গঠনগত ত্রুটি ও সুস্থতা নির্ণয় করতে পারেন। বাচ্চার শরীরের ত্রিমাত্রিক ছবি দেখার জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ৩ডি/৪ডি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এতে মূলত বাচ্চার মুখের চলমান সুন্দর ছবি মায়েরা দেখতে পেয়ে খুশি হন। গর্ভে থাকা অবস্থায় মায়ের সঙ্গে বাচ্চার ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হয়। শুধু মুখমণ্ডলের ও হার্টের কিছু গঠনগত ত্রুটি সন্দেহ হলেই তখন ৩ডি/৪ডি আল্ট্রাসনোগ্রাফি বাড়তি তথ্য দিতে পারে। তা ছাড়া গর্ভকালীন সময়ে ৩ডি/৪ডি আল্ট্রাসনোগ্রাফি খুব একটা জরুরি নয়।

 

কতবার করানো উচিত?

 

সাধারণত গর্ভের সময় প্রায় চারবার আল্ট্রাসনোগ্রাফির প্রয়োজন হয়। তবে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশিবারও দরকার হতে পারে। গর্ভকালীন যেকোনো সমস্যা, যেমন রক্তক্ষরণ, পানি ভেঙে যাওয়া, বাচ্চার নড়াচড়া কম হওয়া, বাচ্চার ওজন বৃদ্ধি নিয়ে সন্দেহ ইত্যাদি যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাত্ক্ষণিক আল্ট্রাসনোগ্রাফিরও প্রয়োজন হতে পারে।

 

 

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

যেহেতু আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে এক্স-রে বা সিটি স্ক্যানের মতো কোনো ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহাব করা হয় না, শুধু শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করা হয়, তাই আজ পর্যন্ত এর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পাওয়া যায়নি।

আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য ভালো মানের মেশিনের প্রয়োজন। পাশাপাশি যিনি আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা করাবেন, তাঁর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাও সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে দুঃখের বিষয়, আজও আমাদের দেশের বেশির ভাগ গর্ভবতী মা গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসনোগ্রাফির মতো অত্যাধুনিক রোগ নির্ণয় পদ্ধিতর সুযোগ পাচ্ছেন না । ফলে আগে থেকে ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। সফলতা আসছে না প্রসব পরিকল্পনায়। বাড়ছে প্রসবকালীন জটিলতা, রয়ে যাচ্ছে মাতৃমৃত্যুর উচ্চ হার। প্রতিটি গর্ভবতী মাকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার সুয়োগ প্রদান করা গেলেই শুধু সুস্থ সন্তানের জন্মদান ও নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব।

 

https://www.youtube.com/watch?v=wfEPaBfx6p4

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!