class="post-template-default single single-post postid-10411 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

ইসলামে নারীর বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার

নারী-পুরুষের মানবিক প্রয়োজন পূরণে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সুখময় ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ইসলাম বিবাহবন্ধনের নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামের বিধান মতে, বিবাহ সম্পাদনে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সম্মতি আবশ্যক। কোনো সাবালক পুরুষ কিংবা নারীকে কোনো ব্যক্তি জোরপূর্বক বিবাহ দিতে পারবে না, এমনকি তার জন্মদাতা মা-বাবাও না। জোরপূর্বক বিবাহ দিলে বিবাহ শুদ্ধ হবে না। কোনো নাবালেগ ছেলে-মেয়েকে তার অভিভাবক জোরপূর্বক বিবাহ দিলেও বালেগ হওয়ার পর তাদের অপছন্দ হলে তারা ওই বিবাহ ভেঙে দিতে পারবে। অতএব, কোনো পুরুষ কোনো নারীকে এবং কোনো নারী কোনো পুরুষকে বিবাহের মাধ্যমে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। ইসলামী শরিয়ত তাদের ওপর কারো জবরদস্তি চাপিয়ে দেয় না। ইসলামে নারীকে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কেই সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেন কোনো নারীকে কোনো অসৎ পুরুষের খপ্পরে পড়ে অসহায় ও দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করতে না হয়।

যেহেতু পৃথিবী আবাদ ও সুখময় সমাজ বিনির্মাণেই বিবাহের বিধান, তাই অপ্রয়োজনে এ বন্ধন ছিন্ন করাকে ইসলাম খুবই অপছন্দ করেছে। বিনা প্রয়োজনে তালাক দেওয়া বা তালাক চাওয়া গুনাহর কাজ। তবে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে যদি বনিবনা না হয় এবং কোনোভাবেই তাদের মিল হওয়া সম্ভব না হয় অথবা জুলুম-নির্যাতন বা কোনো অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তাহলে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি রয়েছে। প্রয়োজনে ও যৌক্তিক কারণে স্বামী তালাক দিতে পারে, তদ্রূপ স্ত্রীও তালাক চাইতে পারে। তবে ইসলামী শরিয়ত মতে, তালাকের ক্ষমতা স্বামীর হাতে ন্যস্ত।

তালাকের ক্ষমতা স্বামীর হাতে ন্যস্ত হওয়ার কারণ

এখানে প্রশ্ন জাগে যে ইসলাম ধর্ম মতে, স্বামী নিজ ইচ্ছায় তালাক দিতে পারে; কিন্তু স্ত্রী তার ইচ্ছায় তালাক দিতে পারে না। তাই নারীদের ব্যাপারে বিষয়টিতে সংকীর্ণতা এসেছে। আসলে বিষয়টি সাধারণ ও স্থূল দৃষ্টিতে এমন মনে হলেও প্রকৃত অবস্থা ভিন্ন। আমরা শুরুতেই বলে এসেছি যে কোনো অসহনীয় ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি যেন না হয়, তাই শুরু থেকেই নারী-পুরুষ উভয়কেই জীবনসঙ্গী নির্বাচনে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তবে বিবাহ হয়ে যাওয়ার পর দুটি জীবন পরস্পর একাকার হয়ে যাওয়ার কারণে একটি নিয়ম ও শৃঙ্খলার খাতিরে তালাকের অধিকার শুধু স্বামীকেই দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীর হাতে এ ক্ষমতা অর্পণ না করার যৌক্তিক ও বাস্তবিক অনেক কারণ রয়েছে, যা সামান্য চিন্তা করলে এর যৌক্তিকতা বুঝে আসে। পৃথিবীর সব ক্ষেত্রেই নিয়মের খাতিরে কোনো বিষয়ের দায়িত্ব একজনের ওপর থাকে, আর অন্যরা তার সহযোগী হয়। এতে কাউকে বঞ্চিত করা উদ্দেশ্য নয় কিংবা তার অবস্থানকে খাটো করে দেখাও উদ্দেশ্য নয়; বরং শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন বিনির্মাণই মূল উদ্দেশ্য। একটি অভিন্ন কর্মক্ষেত্রে দুজন দায়িত্বশীল সমহারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় না, নচেৎ তাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। তদ্রূপ স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের শৃঙ্খলা রক্ষায় একজন প্রধান দায়িত্বশীল হবেন এবং অপরজন তার সহযোগী হবেন। এখন আমাদের দেখতে হবে, কাকে প্রধান দায়িত্বশীল বানাব আর কাকে সহযোগী বানাব? এ ক্ষেত্রে ইসলাম নারীর স্বভাবগত চঞ্চলতা ও অধৈর্যের প্রতি খেয়াল করে এবং পুরুষের দৈহিক সক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বিবেচনা করে পুরুষের ওপর তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করেছে। তবে ইসলামে দাম্পত্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে পরামর্শ করে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।

স্ত্রীর জন্য বিবাহের আগে তালাকের অধিকার সংরক্ষণ

তথাপি ইসলামে স্ত্রীকে আরেকটি অধিকার ও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো, বিবাহের সময় যেকোনো নারীই ইচ্ছা হলে স্বামীকে এ শর্ত দিতে পারে যে আমি যদিও এখন স্বেচ্ছায় আপনার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করছি, কিন্তু পরে যেকোনো সময় কারণে-অকারণে এ সম্পর্ক ছিন্ন করার অধিকার আমাকে দিতে হবে। ওই শর্তে বিবাহ সম্পাদিত হলে পৃথিবীর সব নারীই এ অধিকার প্রয়োগ করে স্বামীর ইচ্ছাবহির্ভূত হলেও তালাক গ্রহণ করে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে। (দেখুন : সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২৬২, ফাতহুল কাদির : ৩/৪২৭)

প্রশ্ন হলো, এর পরও কি স্ত্রীর জন্য ইসলামে কোনো সংকীর্ণতা রাখা হয়েছে?

বিনিময় দিয়ে তালাক গ্রহণের অধিকার

হ্যাঁ, কেউ বলতে পারেন যে ইসলামের বিধানে অজ্ঞতা বা যেকোনো কারণে যদি স্ত্রী বিবাহের আগে স্বামীর সঙ্গে ওই শর্তচুক্তি না করে থাকে, তাহলে কি তার জন্য স্বামীর ইচ্ছার বাইরে বিবাহবিচ্ছেদের আর কোনো সুযোগ নেই? তার জন্য কি সব পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে? এর জবাব হলো, ‘না।’ স্ত্রীর জন্য তার পরও বিবাহবিচ্ছেদের পথ এভাবে খোলা আছে যে সে স্বামীকে বুঝিয়ে তালাকের ওপর রাজি করাবে অথবা কোনো বিনিময়ের মাধ্যমে তালাকের সম্মতি নেবে। অর্থাৎ সে বলবে যে হয়তো তুমি আমাকে বিবাহ করতে গিয়ে মহর, অনুষ্ঠান ও অন্য খাতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তাই তুমি এ বিবাহ ভাঙতে চাচ্ছ না, আমি প্রয়োজনে তোমাকে তোমার কিছু খরচ পুষিয়ে দেব, তবু তুমি আমাকে তালাক দিয়ে দাও। এটিকে ইসলামী পরিভাষায় ‘খোলা তালাক’ বলা হয়। (দেখুন : সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২৭৩) ‘খোলা তালাকের’ বৈধতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে আমাদের কিছু ভাই সন্দেহ পোষণ করে থাকেন, সে বিষয়েও আমরা কিঞ্চিৎ আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার

এখন যদি ‘খোলা তালাকের’ ওপরও স্বামী রাজি না হয়, তাহলে কি অন্য পথ খোলা নেই? এ প্রশ্নের জবাব হলো, বরং এ ক্ষেত্রেও স্ত্রী আদালতে মামলা করে যৌক্তিক কারণ দর্শিয়ে স্বামীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিচারকের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ করাতে পারে। (শরহুস সগির, দরদির : ২/৭৪৫, কিফায়াতুল মুফতি : ৬/২৫২)

এর পরও যারা এ বিষয়ে নারীর অধিকার হরণের আপত্তি তোলেন, তারা মূলত তাদের প্রতিপালক আল্লাহর বিধান মানতেই রাজি নয়। তাই অযৌক্তিক আপত্তি তুলে হলেও তাতে সন্দেহ সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করে থাকে।

কিছু সংশয় ও তা নিরসন

কিছু অবুঝ ভাই কোরআন-হাদিস থেকে প্রমাণ করতে চান যে কোরআন-হাদিসে নারীদেরও হুবহু পুরুষের মতো তালাকের অধিকার দেওয়া হয়েছে। আসলে এটি তাদের কোরআন-হাদিসের জ্ঞানশূন্যতারই প্রমাণ বহন করে। কোরআন-হাদিসের শিক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন না করে ইংরেজি-বাংলা অনুবাদ পড়ে এবং মস্তিষ্কে পশ্চিমা চিন্তাধারা লালন করে যারা ইসলাম চর্চা করেন, ইসলামের বিধি-বিধান অনুধাবন তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।

সংশয় ১ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদের বলে দাও, ‘যদি তোমরা দুনিয়ার জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করো, তাহলে এসো, আমি তোমাদের ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা করে দিই এবং উত্তম পন্থায় তোমাদের বিদায় করে দিই।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২৮)

এ আয়াত দ্বারা সংশয়কারী ভাইয়েরা বলে থাকেন যে এখানে স্ত্রীদের স্বামীর অনিচ্ছায়ও তালাকের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, স্ত্রী ইচ্ছা করলে বিদায় গ্রহণ করে চলে যাওয়ার অধিকার তার রয়েছে।

নিরসন : এর জবাব হলো, এ আয়াত দ্বারা স্বামীর অনিচ্ছায়ও স্ত্রী তালাক দেওয়ার অধিকারী হওয়ার কোনো প্রমাণ দুরবিন দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। বরং আয়াতটি দ্বারা বিপরীতটিই বোঝা যায় যে স্বামী ইচ্ছা করলে স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের অধিকার দিতে পারবে এবং স্ত্রী স্বামীর দেওয়া ওই অধিকার প্রয়োগ করে তালাক গ্রহণ করতে পারবে। এতে স্বামীর অনিচ্ছায়ও স্ত্রীর তালাক দেওয়ার অধিকারী হওয়ার কথা কোথা থেকে পেলেন তাঁরা? নিশ্চয়ই এটা তাঁদের পূর্বকল্পিত দর্শন, যা তাঁরা আয়াত দ্বারা প্রমাণ করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছেন। কেননা কোরআনের কোনো ব্যাখ্যাকারই তাঁদের উদ্দিষ্ট ব্যাখ্যা গ্রহণ করেননি। (দেখুন : তাফসিরে ইবনে কাসির-৬/৪০৪)

সংশয় ২ : প্রসিদ্ধ নারী সাহাবি বারিরাহ ও মুগিস (রা.)-এর ঘটনা বিভিন্ন হাদিসের কিতাবে এসেছে। বারিরাহ ছিলেন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর দাসী এবং মুগিস নামক জনৈক সাহাবি ছিলেন তাঁর স্বামী। বারিরাহকে আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) মুক্ত করে দেওয়ার পর বারিরাহ তাঁর স্বামীকে ত্যাগ করেন। এতে তাঁর স্বামী তাঁর ভালোবাসায় অস্থির হয়ে অনেক কান্নাকাটি করেন। তা দেখে রাসুলুল্লাহ (সা.) বারিরাহকে বলেন, তুমি মুগিসকে গ্রহণ করে নাও। তখন বারিরাহ বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এটি কি আপনার আদেশ না পরামর্শ? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, পরামর্শ। তখন বারিরাহ বলল, তাহলে তো এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ না মানার অধিকার আমার রয়েছে, আমি মুগিসকে গ্রহণ করব না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২৮৩)

ওই হাদিসে স্বামীর প্রচণ্ড ভালোবাসা সত্ত্বেও স্ত্রী স্বেচ্ছায় তাকে ত্যাগ করার পরও রাসুলুল্লাহ (সা.) স্ত্রীকে স্বামীর কাছে যেতে বাধ্য করেননি; বরং তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন।

নিরসন : আসলে এ হাদিসে স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দেওয়ার অধিকারী হওয়ার কথা তো প্রমাণিত হয় না। বরং তাতে একটি বিধান বর্ণিত হয়েছে, তা হলো কোনো দাসীকে তার মনিব কারো সঙ্গে বিয়ে দিলে সে তার সঙ্গে থাকতে বাধ্য, তবে যখনই ওই দাসীকে আজাদ করে দেওয়া হবে, তখন সে যেহেতু একজন স্বাধীন নারী, তাই তার অধিকার রয়েছে যে সে তার মনিবের দেওয়া বিবাহকে অটুটও রাখতে পারে, আবার চাইলে ভেঙেও দিতে পারবে। (উমদাতুল কারি : ২০/২৬৬)

তাই এটি মূলত বিবাহের আগে নারীর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও প্রত্যাখ্যানের অধিকারের মতোই। কেননা বিবাহের আগে সব নারীরই সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে প্রস্তাব গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যানের। যেহেতু দাসী এত দিন তার মনিবের অধীনে থাকার কারণে তার অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায়নি, তাই আজাদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। এটিই হলো হাদিসের মর্ম। এর দ্বারা স্ত্রীর সর্বদা একচ্ছত্র অধিকার প্রমাণিত হয় না।

সংশয় ৩ : হাদিস শরিফে এসেছে, জনৈক নারী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, আমার বাবা আমাকে তার ভাতিজার সঙ্গে বিবাহ দিয়েছেন, যাতে আমার অসন্তুষ্টি রয়েছে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দিয়েছেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৮৭৩)

নিরসন : এই হাদিসে যে বিধান বর্ণনা করা হয়েছে, তা আমরা আগেই করেছি। তা হলো, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানবান নারীকে কোনো ব্যক্তি জোরপূর্বক বিবাহ দিতে পারবে না, এমনকি তার জন্মদাতা মা-বাবাও না। জোরপূর্বক বিবাহ দিলে বিবাহই শুদ্ধ হবে না। কোনো নাবালেগ ছেলে-মেয়েকে তার অভিভাবক বিবাহ দিলেও বালেগ হওয়ার পর তাদের অপছন্দ হলে তারা ওই বিবাহ ভেঙে দিতে পারবে। কিন্তু এ হাদিস দ্বারা নারীর তালাক দেওয়ার অধিকার প্রমাণিত হয় না। যদিও ইসলাম কয়েকটি উপায়ে নারীকে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার দিয়েছে। (এ বিষয়ে আলোচনা ভিন্ন শিরোনামে চলমান থাকবে, ইনশাআল্লাহ।)

লেখক : মুহাদ্দিস ও ফতোয়া গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!