কিডনি আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমাদের শরীরের তলপেটের বিপরীত দিকে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে মুষ্টি আকৃতির দুটি কিডনি থাকে। কিডনি, হার্ট, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, লিভার প্রভৃতি অঙ্গের কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। কিডনির সব চেয়ে ক্ষুদ্র অংশ হল নেফ্রোন। প্রতিটি কিডনিতে প্রায় ১০ লাখ নেফ্রোন থাকে যার প্রতিটিই রক্ত পরিশোধনের ক্ষুদ্র ছাঁকুনি হিসেবে কাজ করে। শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় পদার্থ বের করে দেয়া, রক্ত পরিশোধন, পানি ও খনিজ লবণের ভারসাম্য রক্ষা, হরমোন উৎপাদন, এসিড এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি কিডনির প্রধান কাজ। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, কিডনির সর্বোচ্চ শতকরা ৯০ ভাগ সঠিকভাবে কাজ না করলেও একজন মানুষ তেমন বড় কোনো সমস্যা ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে; তবে এ সংখ্যা সবার ক্ষেত্রে একই রকম নাও হতে পারে। চলুন দেখি সচরাচর কী কী কিডনি রোগ আমাদের শরীরে বাসা বাঁধতে পারে-
পায়েলো নেফ্রাইটিস : ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে কিডনির পেলভিসে সংক্রমণ হলে তাকে পায়েলো নেফ্রাইটিস বলে। এ রোগের প্রধান উপসর্গ জ্বর এবং শরীরের পশ্চাৎ অংশে তীব্র ব্যথা।
গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস : শরীরের প্রচলিত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোনো কারণে অতিক্রিয়াশীল হয়ে কিডনিকে আক্রমণ করলে তাকে গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস বলে। প্রস্রাবে রক্ত ও আমিষ নিঃসরণ এ রোগের প্রধান লক্ষণ।
কিডনিতে পাথর : মূত্রে উপস্থিত খনিজপদার্থগুলো ক্রিস্টাল তৈরি করে আকৃতিতে বৃদ্ধি পেয়ে প্রস্রাবের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করলে তাকে কিডনিতে পাথর বলে। অনেক ছোট ক্রিস্টাল এমনিতেই বের হয়ে যায় তবে আকৃতি বড় হয়ে গেলে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কষ্টকর প্রস্রাব, প্রস্রাবে জ্বালা-পোড়া, প্রস্রাবে রক্ত প্রভৃতি এ রোগের লক্ষণ।
নেফ্রোটিক সিনড্রোম : কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়ার কারণে প্রস্রাবে অতিরিক্ত আমিষ নিঃসরণ হলে তাকে নেফ্রোটিক সিনড্রোম বলে। পায়ে পানি জমে ফুলে উঠা এ রোগের প্রধান লক্ষণ।
পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিস : এটি সাধারণত বংশগত সমস্যা। এখানে কিডনিতে বড় সিস্ট তৈরি হওয়ার কারণে কিডনি তার স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে পারে না।
আকস্মিক কিডনি সমস্যা : পানিশূন্যতা, কিডনিতে রক্তপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা, মূত্রনালির সমস্যা প্রভৃতি কারণে কিডনি হঠাৎ বিকল হয়ে যেতে পারে যাকে আকস্মিক কিডনি সমস্যা বলে। অনেক ক্ষেত্রে আপনা আপনিই এ সমস্যা ভালো হয়ে যায়।
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি সমস্যা : ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ বা অন্য কোনো কারণে আস্তে আস্তে কিডনির নির্দিষ্ট অংশ বিকল হয়ে যাওয়াকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি সমস্যা বলে।
কিডনি রোগের সর্বশেষ অবস্থা : দীর্ঘস্থায়ী কিডনি সমস্যা অনবরত থাকার কারণে একসময় পুরো কিডনি তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে যাকে কিডনি রোগের সর্বশেষ অবস্থা (End Stage Renal Disease) বলে। এ অবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালাইসিস করার প্রয়োজন হয়।
ডায়াবেটিস নেফ্রোপ্যাথি : রক্তের উচ্চমাত্রার শর্করা কিডনির স্বাভাবিক ছাঁকন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার দিকে ধাবিত হয় একে ডায়াবেটিস নেফ্রোপ্যাথি বলে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত।
উচ্চরক্তচাপজনিত নেফ্রোপ্যাথি : অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ কিডনির স্বাভাবিক কাজকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। ফলশ্রুতিতে ধীর ধীরে কিডনি বিকল হয়ে যায়। তাই উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে নির্দিষ্ট বিরতিতে কিডনির সর্বশেষ অবস্থা পরীক্ষা করা উচিত।
কিডনির ক্যান্সার : ধূমপান, রাসায়নিক বিক্রিয়া কিংবা বংশগত কারণে কিডনিতে ক্যান্সার হতে পার। সাধারণত মহিলাদের তুলনায় পুরুষের কিডনি ক্যান্সার বেশি হয়ে থাকে।
ইন্টারইস্টিসিয়াল নেফ্রাইটিস : কিডনির অভ্যন্তরে অবস্থিত সংযোজক কলাগুলোতে প্রদাহের কারণে কিডনির স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি হয় যাকে ইন্টারইস্টিসিয়াল নেফ্রাইটিস বলে। অ্যালার্জিক বিক্রিয়া ও অনেক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে এ রোগ হয়ে থাকে।
কিডনি রোগের লক্ষণ
* অতিদ্রুত হাঁপিয়ে যাওয়া
* কোনো কাজে মনোনিবেশ করতে না পারা
* অরুচি
* ঘুমের সমস্যা
* রাতে বেশি বেশি প্রস্রাব ও মাংসপেশিতে টান লাগা
* মুখ ও অস্থির সংযোগ স্থল ফুলে যাওয়া
* অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ
* শরীরে পানি আসা প্রভৃতি।
কিডনি রোগ নির্ণয় পরীক্ষা : মূত্র/রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, ইউরিটেরোস্কোপি, বায়োপসি প্রভৃতি পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনি রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেশন রেট কিডনির সামগ্রিক কার্যকারিতা পরিমাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা যার সাধারণ মান ৯০ থেকে ১২০মিলি/মিনিট/১.৭৩মিটার২ বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে এ মান কিছুটা কমতে পারে। ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স কিডনির স্বাভাবিকতা পরিমাপের আরেকটি পরীক্ষা যার সাধারণ মান পুরুষের ক্ষেত্রে ৯৭ থেকে ১৩৭ মিলি/মি এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪৪ থেকে ১২৮ মিলি/মি। রক্তে উপস্থিত ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ কিডনি রোগ নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয় যার প্রচলিত মান পুরুষের ক্ষেত্রে ০.৭ থেকে ১.৩ মিগ্রা/ডেসি লিটার এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে : ০.৬ থেকে ১.১ মিগ্রা/ডেসি লিটার।
কিডনি রোগের চিকিৎসা
অ্যান্টিবায়োটিক : ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে ব্যাকটেরিয়ার ধরন নির্ণয়ে রক্ত/প্রস্রাব কালচার করার প্রয়োজন হয়।
নেফ্রোস্টোমি : এ বিশেষ পদ্ধতিতে চামড়ার নিচ দিয়ে একটি ক্যাথেটার কিডনিতে পৌঁছানো হয় যার মাধ্যমে বিকল্প পথে প্রস্রাব বের হয়ে আসতে পারে।
লিথোট্রিপসি : উচ্চপ্রযুক্তির আল্ট্রাসনিক শক ব্যবহার করে কিডনির পাথরকে ছোট করে বিশেষ ব্যবস্থায় বের করে আনার চিকিৎসা পদ্ধতিকে লিথোট্রিপসি বলে।
নেফ্রেকটোমি : শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনি অপসারণকে নেফ্রেকটোমি বলে। কিডনিতে ক্যান্সার/টিউমার হলে বা কোনো কিডনি পুরোপুরি বিকল হয়ে সমস্যার সৃষ্টি করলে নেফ্রেকটোমি করা হয়ে থাকে।
ডায়ালাইসিস : কৃত্রিম যন্ত্রের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় পরপর রক্ত পরিশোধন ব্যবস্থার নাম ডায়ালাইসিস। ডায়ালাইসিস বিভিন্ন রকমের হতে পারে যেমন- হেমোডায়ালাইসিস, পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস প্রভৃতি। এটি বেশ ব্যয় বহুল চিকিৎসা পদ্ধতি।
কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট : অকেজো কিডনি পরিবর্তন করে কোনো দাতার কিডনি সংযোজনকে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট বলে। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ব্যয় বহুল এবং এটি করার পর বাকি জীবন নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ খেয়ে যেতে হয়।
কি কারণে কিডনি রোগ হয় : কিডনি রোগের জন্য সুনির্দিষ্ট কারণ বলা বেশ কঠিন। তবে নিুোক্ত কারণে কিডনি রোগ হওয়ার আশংকা অনেক বেশি
* বারবার মূত্রনালির সংক্রমণ
* কিডনিতে প্রদাহ
* জন্মগত সমস্যা
* বিভিন্ন ধরনের ওষুধের/কেমিক্যালের পার্শপ্রতিক্রিয়া
* শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী ব্যবস্থায় সমস্যা
* অনিয়ন্ত্রিত/অকর্মণ্য জীবনযাপন
* ধূমপান/এলকোহল সেবন
* ডায়াবেটিস
* উচ্চরক্তচাপ প্রভৃতি।
কিডনি রোগ থেকে বাঁচার উপায়
* রক্তচাপ/ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা
* নিয়ম মেনে ব্যায়াম করা
* দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব আটকিয়ে না রাখা
* পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা
* ধূমপান/এলকোহল বর্জন করা
* স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া
* ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন না করা
* নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা
কোথায় কিডনি রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায় : বাংলাদেশের বড় বড় সব হাসপাতালে কিডনি রোগের চিকিৎসার সুযোগ আছে। এর বাইরে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলোজি এবং মিরপুরে ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল নামে কিডনি চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। আধুনিক মানের বেসরকারি হাসপাতালেও কিডনি চিকিৎসার অত্যাধুনিক ব্যবস্থা আছে যাদের অনেকেরই কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা আছে।
বিশ্বে প্রতি ১০ জনে অন্তত একজন কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত। বাংলাদেশে এ চিত্র আরও ভয়াবহ। এখানে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ (প্রতি সাতজনে একজন) কিডনি বা এর সঙ্গে সম্পর্কিত অসুখে আক্রান্ত এবং বছরে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ এ সংক্রান্ত রোগে মারা যায়। প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নতুন রোগী কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে কিন্তু সেই তুলনায় বাড়ছে না কিডনি চিকিৎসার আধুনিক সুবিধা। তাই সংশ্লিষ্ট সবার দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
লেখক :মো. আবু জাফর সাদেক, ফার্মাসিস্ট ও জ্যেষ্ঠ অতিরিক্ত ব্যবস্থাপক, রেনাটা লিমিটেড-প্রধান কার্যালয়, ঢাকা, বাংলাদেশ