Thursday, March 28
Shadow

নীলফামারীর মানুষের প্রিয় খাবার নাপা শাকের পেল্কা

বছর ঘুরে শীত আসে। আর এই শীতের সবজি হিসেবে নীলফামারীতে নাপা শাকের বিকল্প নেই। এই নাপা বা লাফা শাকের পেল্কা এই এলাকার মানুষের একটি ঐতিহ্যবাহি খাবার। সেই সাথে সিঁদল ভর্তা খুবই জনপ্রিয়। যা দেখলে জিভে অনেকের জল আসে।

নাপা শাক চাষ

সীমান্তবর্তী উত্তরের জেলা নীলফামারীর মানুষের সবচেয়ে মুখরোচক ও জনপ্রিয় তরকারী এক ধরনের গাছ নাপা বা লাপাশাক নামে পরিচিত। এটির বৈজ্ঞানিক নাম ম্যালোভা পারভিফ্লোরা । উদ্ভিদটির উৎপত্তি চীন দেশে হলেও উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার মহাদেশের অধিকাংশ দেশে এই উদ্ভিদটির চাষ করা হয়। স্থানীয়ভাবে নাপা, লাপা,লাফা ইত্যাদি নামেও পরিচিত।

নীলফামারী সরকারী কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. অহিদুল হক বলেন, এই শাকের ইংরেজি নাম হলো ম্যালো পাতা। এই এলাকার মানুষের প্রিয় ও সুস্বাদু একটি খাবার। এটা সহজেই আবাদ হয়। নাপা শাকের অনেক ভেজষ গুণও রয়েছে।

এ ছাড়াও বাড়ীর পাশে অল্প জমিতে শাকের বীজ ফেলে জৈব সার দিয়ে এই শাক ফলানো যায়। এতে কৃষকের তেমন বড় ধরনের খরচ হয় না। সেচ, নিড়ানী দিলেই ভাল ফলন পাওয়া যায়। উত্তরাঞ্চলের বাজরে চাহিদাও যতেষ্ট। এটি একটি শীতকালিন সবজি।

নাপা নামক উদ্ভিদটি  বাংলাদেশ  এবং ভারতে এটি শীতকালীন সবজি হিসেবে কৃষকেরা আবাদ করে থাকে এবং আর্থিকভাবে লাভবান হয়। বর্ষাকাল ব্যতিত প্রায় সারা বছর এটির চাষ করা যায়। বাংলাদেশে উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম প্রভূতি জেলার কৃষক এ ফসলের আবাদ করে থাকে ।
তবে সবচেয়ে বেশি আবাদ করা হয় নীলফামারী ও রংপুর জেলায় । কারণ এ উদ্ভিদটি  আবাদ করার জন্য শীতকালীন আবহাওয়া, কম পরিমাণ সেচ, অম্লীয়, ক্ষারীয় এমনকি নিরপেক্ষ জমিতে এর ফলন খুব ভালো হয়। এছাড়া বেলে এবং বেলে দোঁ-আশ মাটিতেও এ উদ্ভিদের চাষ করা যায়।

বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, লেবাননের মানুষ এই শাকের পাতা সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। নাপা শাকের পাতা ও ডাটি দিয়ে চা তৈরী করে পান করেন তারা। এই শাক আঠালো এক ধরনের পদার্থ বহন করে। এ জন্য বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার কাজে ব্যবহার হয়। বিশেষ করে চর্মরোগ, হাঁপানী ও ডায়াবেটিস রোগের কার্যকরী ঔষুধ।

নাপা শাক মালভা গণের মালভেসি পরিবারের একটি সপুস্পক উদ্ভিদ যার পাতা ও গাছের কচি ডগা বা পাতা সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। এই শাক লাফা শাক নামে অনেকের কাছে পরিচিত। লাফা শাক এশিয়াসহ পৃথিবীর সর্বত্রই জন্মে।

একই কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতে এটি প্রধানত শীতকালিন সবজি হিসেবে চাষ করেন কৃষকরা। এ ছাড়াও ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কুচবিহার ও আসামের গোয়াল পাড়া এলাকায় চাষ করা হয়। বিশেষ করে উত্তর বঙ্গের নীলফামারীর মানুষের মুখে মুখে এখন লাফা শাকের গল্প শোনা যায়।

তিনি বলেন, নাপা শাক এক বর্ষজীবি দ্বিবীজপত্রীক ও সপস্পুক উদ্ভিদ। এর গাছ ৩০-৩২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা বা উঁচু হয়। পাতা গোলাকার ও সবুজ, হালকা লালচে রংঙের হয়ে থাকে। এই শাক ভাজি, ঝোল ও পেল্কা বা খাটার জন্য বিখ্যাত।
আধুনিক গবেষণায় দেখা যায়, এ উদ্ভিদের বীজে বিদ্যমান পলিস্যাকারাইড রক্তের শ্বেত রক্তকণিকা গঠনে সাহায্য করে ।

শুধু তাই নয় ক্যান্সার কোষ গঠন প্রতিহত করতে এ উদ্ভিদের গূরত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । তবে নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ সার প্রয়োগ করে আবাদ করা নাপাশাক স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর । তাই জৈব সার প্রয়োগ করে এ উদ্ভিদ আবাদ করা হলে  এ ধরনের সমস্যা  দূরীভূত করা যেতে পারে। বর্তমানে এ শাক বাজারে প্রায় ১৫-২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে । আবার একর প্রতি স্বল্প খরচে, অল্প সময়ে  এ  উদ্ভিদের চাষ করা সম্ভব হওয়ায় কৃষকেরা এ উদ্ভিদ আবাদ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।

পাশাপাশি, উত্তরাঞ্চলের বতুয়া শাকও খুবই একটি জনপ্রিয় শাক। পেলকার সহযোগি উপকরন হলো বতুয়া শাক। বতুয়া ছাড়া পেল্কা মজাদার হয় না। এছাড়াও, এই অঞ্চলে পাট শাকের ভাজি, ঝোল ও খাটা খেতে খুবই মজা। অন্যদিকে, কচুর পাতা ও সজনি শাকের পাতার পেল্কা একটি ঐতিহ্যবাহী ও মজাদার খাবার হিসেবে এই জনপদের মানুষের কাছে অতি প্রিয়। কচু পাতার ভর্তা আরো মজাদার একটি ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার।

জেলা সদরের পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের দীঘলটারী গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন (৭৭) বলেন, হামরা যখন ছোট ছোট তখন দেখিছি বাবার ঘরে বাসি পেল্কা আর বাসি ভাত পেট ভরে খ্যায়া হাল ধরি যায়। পাকা এক দুপর হাল বয়া আইসে খিদায় নাগে না। এটা হামার (আমাদের) কৃষক মানুষের জন্য মজার খাবার। তিনি আরো বলেন, নাপা শাকের সাথে সিঁদলের ভর্তা হলেতো কথাই নাই। এক থালি (থালা) ভাত আর পেল্কা হলে কিছুই নাগে না।

একই গ্রামের বৃদ্ধ মো. শফিয়ার রহমান (৬৮) বলেন, এলাতো মাইনষের নানান অসুখ হয়। ডায়াবেটিস কি মুই এখনো জানো না। হামরা পেল্কা খাওয়া মানুষ হামারতো পেশার হয় না। মাইনশের বেলে  চুলকানী হয়, কই হামারতো হয় না। গোটাল শীতখান নাপা শাকের ঝোল, কাঁচা মরিচ, বাসি ভাত আর পেল্কা খাই। হামার হাঁপানী ডাইবেটিস কোনই হয় না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুবক্কর সিদ্দিক বলেন, চলতি মৌসুমে শাক-সবজির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৬৫ হেক্টর। এর মধ্যে অর্জিত হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৬০ হেক্টর। জেলায় নাপা শাকের প্রচুর আবাদ হয়। চাহিদাও রয়েছে যতেষ্ট। বাজারে বেচাকেনাও ভাল হয়। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে স্থানীয় কৃষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!