class="post-template-default single single-post postid-11757 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

চীনে আছে অদৃশ্য চোখ

চীনেযাঁরা চীনে গেছেন, তাঁরা জানেন যে আয়–উন্নতিতে চীনারা কতটা এগিয়ে। চীনে চারদিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। উঁচু উঁচু সুদৃশ্য ভবন, নান্দনিক সব সেতু আর উড়ালসড়কের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুটে বেরিয়ে আসবে—‘ওয়াও’। কিন্তু সবচেয়ে যে বিষয়টি চোখে পড়বে, তা হচ্ছে ‘নিয়ম মানা’। সবকিছুতেই চীনারা নিয়ম মানার বেলায় এগিয়ে। এমনিতেই চীনারা পরিশ্রমী, কিন্তু তাদের বর্তমান উন্নতির পেছনে নিয়ম মানার রীতিটাকেও গুরুত্ব দিতে হয়।

নিয়ম মানার কথা বলতে গেলে, শুরুতেই বলতে হবে তাদের রাস্তার কথা। চীনের সাংহাই আর শেনঝেন এই দুটি শহরের রাস্তাঘাট রীতিমতো হিংসার বিষয়। কী দারুণ চকচকে–ঝকঝকে। প্রতিটি গাড়িই লেন মেনে চলছে। কোথাও কাউকে হর্ন বাজাতে হচ্ছে না। রাস্তায় কেউ নেই, কিন্তু সবুজ বাতি জ্বলেনি বলে গাড়ি থেমে আছে। পথচারীরাও নিয়ম মেনে ফুটপাত দিয়েই হাঁটছেন। রাস্তা পার হতে হলে নির্দিষ্ট জেব্রা ক্রসিং মেনেই পার হচ্ছেন। অপেক্ষা করছেন—কখন সবুজ বাতি জ্বলবে। নিয়ম মানার এই রহস্য কী?

তা হচ্ছে, রাস্তার নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর বসানো আছে সিকিউরিটি ক্যামেরা। এ ক্যামেরা নেটওয়ার্ক একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। এই নিরাপত্তা ক্যামেরায় ধরা পড়বে—কে নিয়ম ভাঙল। তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে যাবে। তাই নিয়ম ভেঙে পার পাওয়া যাবে না। এর বাইরে ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসিয়াল রিকগনিশন বা মুখ শনাক্ত করার বিশেষ পদ্ধতি। চীনের একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জানান, তাঁদের তৈরি নিরাপত্তা প্রযুক্তি কয়েক জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে ব্যবহারকারীর মুখ শনাক্ত করা যায়। তাই রাস্তায় চলাচলকারী কোনো ব্যক্তিকে সহজে বের করা সম্ভব।

যদি রাস্তায় পাবলিক সার্ভিস বা গাড়ির কথা বলা হয়, তবে চীন অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। তাদের মেট্রোসেবার কথা তো দুনিয়ার সবার জানা। এর বাইরে সড়কে যেসব বাস চলে, সেগুলো এতটাই নতুন আর ঝকঝকে, যা রীতিমতো লোভনীয়। কোনো লক্কড়–ঝক্কড় বাস চোখে পড়বে না। গাড়ির পেছনেই জ্বলজ্বল করে গাড়ির ডিজিটাল নম্বর। ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম দিয়েই টিকিট করে ফেলা যায়। এখানে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস হিসেবে অন্য গাড়িও ভাড়া নেওয়া সহজ।

রাস্তার পাশেই আছে পরিবেশবান্ধব সাইকেল। অ্যাপ দিয়ে এসব সাইকেল ভাড়া নিয়ে অনেক দূর যেতে পারেন। আছে ব্যক্তিগত ব্যাটারিচালিত মোটরসাইকেলও। তবে কেউ রাস্তায় হুট করে নেমে আসে না। তার নির্দিষ্ট পথেই চলে।

পথচলায় চীনারা যেমন নিয়ম মানছে, তেমনি নিয়ম মানছে খাবারেও। ভেজাল খাবারকে বলতে গেলে তারা ‘না’ বলে দিয়েছে। তাই সতেজ আর অরগানিক খাবার খাওয়ায় হুটহাট করে শারীরিক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। খাবারের সময়–জ্ঞানও আছে তাদের। সকাল সকাল নাশতা করে ফেলা আর দুপুর গড়ানোর আগেই খাবার সেরে নিতে পছন্দ করে চীনারা। রাতের খাবার কোনোমতেই রাত আটটার পরে নেওয়া যাবে না।

কাজের ক্ষেত্রেও চীনারা যথেষ্ট নিয়ম মেনেই চলে। যে সময় তার কাজ শুরু করার কথা, ঠিক সে সময়েই কাজ শুরু করে আবার শেষও করে ঠিক সময়ে। সম্প্রতি সাংহাই সফরে গিয়ে চীনারা কীভাবে নিয়ম মানে, সে অভিজ্ঞতা হয়েছে।

সাংহাইয়ের রাস্তায় সম্প্রতি যাঁরা হেঁটেছেন বা গাড়িতে চড়েছেন, তাঁরা কসমোপলিটন এ শহরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাবেন। এখানকার প্রকৃতি, প্রযুক্তি, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট—সবকিছুতেই সাংহাই যেন অনন্য। চীনের সবচেয়ে বড় শহর সাংহাই শহরকে দুই ভাগে ভাগ করেছে হুয়াংপু নদী। সেই নদীর এপার-ওপার যোগাযোগ সেতু দিয়ে নয়। সুড়ঙ্গপথে চলাচল শহরের দুই অংশে। রাতের সাংহাইয়ে বড় যে বিষয়টা চোখে পড়ে তা হচ্ছে আলো আর আলো।

হুয়াংপু নদীতে ভেসে চলে নানারঙের আলোয় আলোকিত প্রমোদতরি। ভাসমান রেস্তোরাঁও কম নয়। এই নদী তো বটেই পুরো সাংহাই শহর ভালো করে দেখতে হলে ওরিয়েন্টাল পার্ল টিভি টাওয়ারের বিকল্প নেই। এই টাওয়ারের উচ্চতা ১ হাজার ৫৫৩ ফুট। এর ওপরে পর্যটকরা উঠতে পারেন টিকিট কেটে। কাচেঘেরা গোলাকার (যেটা বাইরে থেকে দেখতে মুক্তার মতো) ঘরটা থেকে পুরো সাংহাই শহরই চোখে পড়ে। এই টাওয়ারের আশপাশের এলাকায় দারুণ সব বহুতল অট্টালিকা। বেশির ভাগই কাচ আর ইস্পাতে মোড়া। রাতে সেগুলো সেজে ওঠে বর্ণিল আলোর ছটায়।

সাংহাইকে এশিয়ার নিউইয়র্ক বলে সবাই। এখানে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের দেখা মিলবে। ইংরেজি ভাষাভাষী লোকের সংখ্যাও চীনের অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে বেশি। তবে সবাই কিন্তু এখানে ইংরেজি জানে না। যাঁরা চীনা ভাষা জানেন না, তাঁদের এখানে একটু সমস্যায় পড়তে হবে। তবে মানুষগুলো হাসিখুশি আর বন্ধুবৎসল। কোনো সমস্যার কথা বললে সাহায্য করতে প্রস্তুত। চীনের অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে সাংহাইয়ে খরচ কিছুটা বেশি।

দিনের চেয়ে রাতের সাংহাই আরও অনেক সুন্দর। হুয়াংপু নদীর এক পাশে দাঁড়ালে শহরের অন্য পাশ দেখতে পাবেন। দেখা যাবে সাংহাই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, ওরিয়েন্টাল পার্ল টাওয়ার এবং সাংহাই টাওয়ার। বিকেলের পর থেকে এখানে মানুষের স্রোত নামে। আপনজনকে সঙ্গে নিয়ে নদীর স্রোতে লাল–নীল আলোর খেলায় অনেকে প্রিয়জনকে ‘ভালোবাসি’ কথাটাও বলে ফেলেন।

আধুনিকতা আর পরিমার্জিত সংস্কৃতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ চীনের এ শহর। হুয়াংপু নদীকে স্থানীয়রা ‘মা’ বলে থাকে। নদীর দুই তীরই খুব সুন্দর করে শানবাঁধানো, নেই কোনো নোংরা পানি বা পরিবেশদূষণ। বেড়ানোর জন্য নদীর দুই পাশেই আছে সুন্দর সুন্দর পার্ক। অদূরেই আকাশছোঁয়া দালান, কাচের টাওয়ার সত্যিই দেখার মতো।

সূর্যাস্তের সময় হোয়াংপু নদীর অপূর্ব দৃশ্য সবাইকে মুগ্ধ করবে। পর্যটকদের মতে, চাঁদনী রাতে হোয়াংপু নদীতে ভ্রমণের সময় এর নীরবতা ও সৌন্দর্য মনে রাখার মতো। যাঁরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে চান, তাঁরাও কিন্তু এখানে নিয়ম মানেন। চাইলেই যেকোনো জায়গায় প্রাকৃতিক কর্ম সারতে পারবেন না। নদীর পাড়েই রয়েছে পাবলিক টয়লেট।

সাংহাই দিনে-রাতে সম্পূর্ণ আলাদা শহর। সাংহাই কিন্তু রাতে ঘুমায় না। কিন্তু এখানেও নিয়ম মানতে হয়। শপিং মলগুলো রাত ১০টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। অনেক ভবনের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যাঁরা রাতর জীবন উপভোগ করতে চান, তাঁদের জন্য ‘নাইট ক্লাব’ খোলা। সে আরেক ভুবন।

তবে শহরের যেখানেই যা করেন না কেন, নিয়মের বাইরে কিন্তু আপনি কিছুই করতে পারবেন না। এখানে ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট সবই নিয়ন্ত্রিত। এখানে টিভি চ্যানেলে কী প্রচার হচ্ছে তা–ও নিয়মের মধ্যেই করা হচ্ছে। তাই চীনে গেলে যা–ই করুন না কেন, মনে রাখবেন অদৃশ্য চোখ আপনার পেছনে রয়েছে, যা আপনাকে নিয়ম মানতে বাধ্য করবেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!