রোমান্টিক উপন্যাস: ছায়া এসে পড়ে পর্ব-৭
রোমান্টিক থ্রিলার ঘরানার বইটি মধ্যবয়সী পুরুষ তৈয়ব আখন্দকে ঘিরে। জীবন সংসারের প্রতি খানিকটা উন্নাসিক কিন্তু বুদ্ধিমান এ মানুষটা পালিয়ে বেড়াতে চায়। কিন্তু আচমকা টাঙন নদী ঘেঁষা গ্রাম পদ্মলতায় এসে সে আটকা পড়ে চাঁদের আলোয় ঝুলতে থাকা একটা লাশ আর লাবনীর জালে। তৈয়ব নিজেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। চলতে থাকে জড়িয়ে পড়া ও ছাড়িয়ে আনার মাঝে এক সমঝোতা।
রোমান্টিক প্রেমের গল্প ও একই সঙ্গে থ্রিলার স্বাদের উপন্যাস ছায়া এসে পড়ে । লেখক ধ্রুব নীল
কুরিয়ারে হার্ড কপি পেতে এই পেইজে অর্ডার করুন
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -১ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -২ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৩ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৪ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৫ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৬ এর লিংক
৭
পরদিন ভোরেই মাছের আড়তে গেল তৈয়ব। কয়েক গ্রাম মিলে একটা বাজার। বড়সড় না। মাছ কেনা উদ্দেশ্য নয়।একটা কিছু খুঁজতে গেছে সে। অবশ্য লোভে পড়ে এক হাজার টাকা দিয়ে একটা বড়সড় রুই কিনে ফেলল। কেনার সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপ হয়ে গেলো। এত বড় জ্যান্ত রুই, মিনু সেটা দেখছে না।
বরফকলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। উদোম গায়ে বরফ ভাঙছে এক কিশোর।
‘জ্যাঁতা মাছে বরফ দিবেন ক্যালা?’
‘দিয়া দাও। ঘরে ফিরিজ নাই।’
‘মাছ কাইট্টা লইয়া যান। এত বড় মাছ কাটবো কিডা।’
ভালো বুদ্ধি দিয়েছে কিশোর। সে নিজে মাছ কাটতে পারে না। লাবনীও যে কেটে দেবে এমন ভরসা নেই।
যে কারণে মাছ বাজারে এসেছে তৈয়ব সেটা জানালো কিশোরকে। কিশোরের কথা শোনার পর প্রসঙ্গ ঘোরালো। মাছ কাটা থেকে নদী, নদী থেকে মাঝি। মাঝি থেকে নৌকার ভাড়া। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে কিশোরকে বিভ্রান্ত করে দিল। তৈয়বের প্রথম প্রশ্নটা এতোক্ষণে তার ভুলে যাওয়ার কথা। মনে রাখলেও লাভ নেই। কারণ পরবর্তী পাঁচ মিনিট তৈয়ব কেবল তার সংসারে কে আছে কে নেই সেই কথাই বলেছে।
শরবানু চাচীর আসার কথা আজ। তার ভরসায় আস্ত মাছ নিয়েই রিকশায় উঠল তৈয়ব। লুঙ্গি পরে আসলে ভালো হতো। প্যান্টে আঁশটে গন্ধ লেগে যাচ্ছে।
দরজা ঠেলতেই স্থির হয়ে গেলো তৈয়ব। উল্টো হয়ে মুখ ফিরিয়ে গ্যাঁট মেরে একটা লোক বসে আছে মোড়ায়। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। বয়স বোঝার জো নেই। বর্ণনা করার মতো চেহারাও নেই। খাটো আর হ্যাংলা মনে হলেও গায়ে জোর রাখে বোঝা যায়।
পায়ের দিকে চোখ গেল। লোকটার বাম পায়ের ডান পাশ ও ডান পায়ের বাম পাশে কালশিটে দাগ। হাতের তালুওখসখসে। তৈয়ব কি দরজা খোলা রেখেই বেরিয়েছিল? নাকি চাচী এসেছে? লাবনীতো তার সঙ্গেই ঘুম থেকে উঠলো। যথারীতি চলে গেছে বাবার বাড়ি। সেখানে গিয়ে বলবে শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে। অবলীলায় মিথ্যে বলার বিশাল ক্ষমতা আছে মেয়েটার।
‘আপনি রবিউল?’
মারবেলের মতো শান্ত চোখ দুটি ঘুরে তাকালো তৈয়বের দিকে। চোখাচোখি হতেই তৈয়বের মনে হলো এ লোক আলু ছেলার মতো খুন করতে পারে। তার কাছে খুন করা আর বাজার থেকে কলমি শাক কেনা একই কথা।
‘জি আমি গাছি রবিউল। ভাইসাব আমার খোঁজ করেছিলেন। পুলিশসহ গিয়েছিলেন বাড়িতে।’
‘পুলিশসহ যাইনি। পুলিশ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। পুলিশের সন্দেহ আমি একজনকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। মিজান আলী নাম লোকটার।’
‘আন্দাজে কথা বলবেন না। খুন আপনি করেন নাই। খুন আমি করেছি।’
‘ও।’
‘দরকার হলে আরও করবো। চাইলে আপনারেও ফাঁসাইয়া দিতে পারি।’
‘কী চাই আপনার?’
‘আপনি চইলা যাবেন। গেরাম ছাইড়া শহরে যাইবেন। শহরের মানুষের জন্য গেরাম না।’
‘নিজের বাড়ি ছেড়ে যাব কই?’
‘ধানমণ্ডির সাতাইশ নম্বর রোডের লাল ইটওয়ালা দোতলা বাড়িটায় যাইবেন। সেখানে আপনার মেয়ে মিনুর সঙ্গে খেলবেন। ওর সঙ্গে ফুলকলি আদর্শ বিদ্যানিকেতনে যাইবেন।’
মার্শাল আর্ট বা এ জাতীয় বিদ্যের একটা বড় বিষয় হলো নিজের শরীরের এক জায়গার শক্তি আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা। সবকিছুতে অতিরিক্ত আগ্রহ থাকায় তৈয়ব টুকটাক এসব বিদ্যা জানে। লাফিয়ে নিজের পুরো ভর ছেড়ে দিল রবিউলের গায়ে। তৈয়বের মনে হলো সে একটা পাথরের মূর্তির ওপর পড়েছে।গাছিরা গাছে চড়তে চড়তে গাছ হয়ে যায় নাকি?
লোকটাকে উঠে ভারসাম্য ঠিক করার সময় দিল না তৈয়ব। তার আগে গলা পেঁচিয়ে ধরলো। পেরে উঠছে না ঠিকমতো। অবাক হলো, বাধা দিচ্ছে না রবিউল। চোখমুখ শক্ত করে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে।
ধন্দে পড়ে গেল তৈয়ব। ঢিল দিলো হাতে। রবিউল কাশি টাশি দিয়ে আবার মোড়া টেনে বসলো।চেহারা কঠোর হয়েছে আগের চেয়ে।
‘আমার কতা শোনেন। কতা শোনার পর মন চাইলে মাইরা গাছে লটকাইয়া রাইখেন।’
লোকটার ভয় নেই। মানে তৈয়বকে ফাঁসানোর সব আয়োজন সেরেই এসেছে।
মাছের ব্যাগটা তুলে পাতিলে রাখলো তৈয়ব। মাছধোয়া বরফের পানি মেঝেতে পড়লে বীকট গন্ধ ছড়াবে। ওই গন্ধে দেখা যাবে আরও তিনদিন লাবনী তার বাড়িতে আসবে না।
চেয়ার টেনে বসলো তৈয়ব। সিগারেট ধরালো। রবিউলের দিকে বাড়িয়ে ধরলো।
‘আমি সিগারেট খাই না। তবে ভাবী মানে আপনের বউরে দেখলাম প্যাকেটে প্যাকেটে খায়।’
লোকটা সিমপ্যাথি পাওয়ার চেষ্টা করছে? নাকি তৈয়বকে ভয় দেখানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। সহজে চাল দেবে না ঠিক করলো তৈয়ব। অপেক্ষা করবে।
‘আপনে শহরের মানুষ। তবে সাধাসিধা থাকনের ভান করেন। আপনি সাধাসিধা না। আপনি ভেজাইললা মানুষ।’
তৈয়ব আখন্দ হঠাৎ ধরতে পারলো সে এতদিন নিজেকে ভুল জানতো। সে আসলেই সাধাসিধা না। সে ভালো অভিনয়ও করতে জানে।
‘কী চাও তুমি?’
‘আমার দরকার টেকা।’
‘পকেটে হাজারখানেক টাকা আছে। ব্যাংকে এক মাসের বেতন থাকতে পারে। এরপর আমার নিজেরও টাকার দরকার হবে রবিউল। তারপর আমি গিয়ে তোমার কাছে টাকা চাইবো বুঝলে?’
‘আপনের বাড়িটা আমার নামে লেইখা দেন। কাগজপত্র সব রেডি করবো। চিন্তা নাই।’
‘লিখে না দিলে কী করবে সেটাও বলে ফেলো, চিন্তা করি।’
‘আপনি মিজান আলীর খুনের মামলায় ফাঁসবেন। কঠিন ফাঁস। কারণ লাশের হাতের মুষ্টিতে আপনার চুল আছে। আপনি যখন ঘুমে ছিলেন তখন চাকু দিয়া আপনার চুল কাটসি। মিজান আলীর নখের ভিতরে ঢুকাইয়া দিসি। আপনার একটা ভিজিটিং কার্ডও জায়গামতো আছে। পুলিশ ওইটা এখন খুঁইজা পাইবো না। ফোন দিয়া কইয়া দিলে পাইবো। আপনার চেনাজানা উকিল থাকলে ঠিক করে রাখতে পারেন।’
‘এত কাজ কখন সারলেন? টেরই পেলাম না।’
‘বেতগাছের আড়ালে লুকাইয়া ছিলাম। আফনারে দেখলামতুফানের মইদ্যে ঘুম দিসেন। আজিব মানুষ আফনে। এমুন তুফানে কেউ ঘুমায়? নিশা টিশা করেন নাকি।’
‘আমি নেশা করি। কথা সত্য। কিন্তু তুমি যে সত্য বলছো প্রমাণ কী?’
‘আমি আপনার পকেট থেকে আপনার কার্ড নিসি। অফিসের কাগজপত্রও নিসি। অফিসে খোঁজ নিয়া আপনার বাড়িতেও গেসি। রবিউল কাঁচা কাম করে না। সিগারেটটা ফালান। আঙুল পুড়বো।’
সমীকরণে লাবনীকে কোথায় বসাবে ভাবছে তৈয়ব। তার নিজের জেল-ফাঁসি কিছুই হবে না জানে। মাঝখান দিয়ে থানা-পুলিশ হবে।রবিউল যত ভয়ই দেখাক, তৈয়বের হাতে এখনও একটা বড় চাল রয়ে গেছে।
‘পুলিশ এখনও জানে না ওইটা কার চুল। টেস্টে ধরা খাইবেন কিন্তু।’
‘ভালো বুদ্ধি। অবশ্য অনেক দিন ধরে খুন খারাবি করে আসছো। তোমার বুদ্ধি থাকাই স্বাভাবিক। এক কাজ করো। আজকেই ফোন দাও থানায়। আমাকে ধরে নিয়ে যাক।’
রবিউলের চোখ ধপ করে জ্বলে উঠতে দেখলো তৈয়ব। সহসা কিছু বললো না। চোখ দুটোকে আবার মারবেলের মতো শীতল করে বলল, ‘লাবনী কিন্তুক সুবিধার না। বড় বিপদে পড়বেন।’
‘আমিও সুবিধার না রবিউল। আমার ধারণা চুল দিয়ে আমাকে ফাঁসানোর আইডিয়াটাও লাবনীর। কিন্তু সে বুঝতে পেরেছে এতে কাজ হবে না।’
আহত দেখালো রবিউলকে। মনে হচ্ছে প্ল্যান ফসকে যাচ্ছে হাত থেকে।
‘আমি এখন আরেকটা কেস নিয়ে ব্যস্ত রবিউল। তবে তোমার জন্য একটা কাজ আছে। বিশ হাজার এখনই দিতে পারবো না। টাকার জন্য তোমাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।’
রবিউল কিছু বললো না। সে ভাবছে তার প্ল্যানে ফাঁকটা কোথায়।
‘মিজান আলী লোকটা সুবিধার ছিল না। লাবনী তাকে মারার জন্য তোমাকে ভাড়া করে উচিৎ কাজই করছে। তুমি না মারলে আমিই মারতাম। মিজান আলীর শার্টের পারফিউমের গন্ধ শুঁকেই বুঝেছি ব্যাপারটা। ওই পারফিউম একটা বিশেষ পারফিউম। কুমতলব না থাকলে বিপত্নীক একটা লোক অতো রাতে এটা গায়ে মাখতো না।বড়লোকি খায়েশ আর কি। তুমি অতো বুঝবে না। আপাতত তোমাকে আরেকটা খুন করতে হবে।’
‘কারে মারাইতে চান?’
রবিউলের কিছুটা সমীহ আদায় করে ফেলেছে এর মধ্যে। এবার ধীরেসুস্থে খেলা যাবে।
‘ঠিক করেছি গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে যাবো। চাচীর ভাই আছে। উনি কিনতে পারেন। অল্পদামে ছেড়ে দেব। বাড়ি বিক্রি করলে তোমারে বিশ হাজার কেন, চল্লিশ হাজার দেওয়া যাবে। তবে খুন করতে হবে একজন পুলিশকে। এসআই শামীম। পারবে?’