Tuesday, March 19
Shadow

আধ্যাত্মিক গল্প : অস্তিত্ব

শ্রাবন্তী আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভয় পায়। অতিপ্রাকৃত ভয়। নিজেকে কুৎসিত দেখবে এ ভয় তার নেই। তার রূপ বাহুল্যবর্জিত। অবশ্য দেখতে কেমন তা নিয়ে সে বিশেষভাবে কখনো ভাবেনি। তবু সে আয়না দেখে না। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই এক অপার্থিব ভয় গ্রাস করে।

শ্রাবন্তীর হাইপারটেনশনের সমস্যাও নেই। তবু নিজের প্রতিবিম্ব দেখলেই তার নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়। কপাল ঘামে। বুক ধড়ফড় করে। গলার কাছটায় কী যেন আটকে থাকে। বুকের এক কোণে তীব্র ব্যাথাও টের পায়। মনে হয়, যেন একটু পরই মঞ্চে তার ডাক পড়বে তাৎক্ষণিক অভিনয়ের জন্য।

রোমান্টিক গল্প

আয়না দেখে শ্রাবন্তী প্রথম ভয় পেয়েছিল ক্লাশ ফাইভে পড়ার সময়। আয়নায় নিজের চেহারা না দেখে মৃত দাদীকে দেখেছিল সেদিন। এখন অবশ্য নিজেকেই দেখে। পারতপক্ষে আয়নার মুখোমুখি না দাঁড়ালেও মাঝে মাঝে বেসিনে মুখ ধোয়ার সময় নিজেকে দেখতে হয়। দেখা মাত্রই চমকে উঠে। মনের ভেতর কে যেন বলে, ‘আরে! এতো আমি! আমি..আমি..আমি..’। অনাকাঙ্ক্ষিত এক ‘আমিত্ব’ গ্রাস করে শ্রাবন্তীকে। নিজেকেই কেমন যেন ভয় পেতে শুরু করে। ‘আমি’টাকে এক মূর্তিমান আতঙ্ক মনে হয়। ভাবে, নিজের ভেতরটাকে উপলব্ধি করার চেয়ে ভয়ংকর কিছু হতে পারে না। নিজেকেই কেমন যেন নিজের কাছে প্রশ্নের মুখে পড়ে যেতে হয়।

আজও সকালে দাঁত ব্রাশ করার সময় ভয়টা পেয়েছে শ্রাবন্তী। আয়নায় তাকিয়ে হুট করে মনে হয়েছে, ‘আমি! হ্যাঁ আমিই দাঁত ব্রাশ করছি। এ অন্য কেউ নয়! আমি আমিই!’।

সমস্যাটা কাউকে বোঝাতে পারবে না বলে সাইক্রিয়াটিস্টের চিন্তা বাদ দিয়েছে শ্রাবন্তী। সমস্যা? নিজেই ভাবে। একি কোনো সমস্যা? নিজের কাছে নিজের ধরা পড়ে যাওয়াটা কোনো রোগ হতে পারে না। তবে ভয় পাচ্ছে কেন? সংজ্ঞাবিহীন ভয়? প্রশ্নগুলো কিছুদিন হলো তাকে বেশ করে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মায়ের গতানুগতিক উপদেশ, বান্ধবীর লাগামহীন বকবক, ছেলে বন্ধুগুলোর সেন্ট্রাল টেন্ডেন্সি, কিছুই কানে ঢুকছে না। একটা অদৃশ্য আয়না তার পিছু ছাড়ছে না। চোখ বন্ধ করলেও ভেসে আসছে সহজ সরল এক আত্মবিম্ব। যে সরলতার মাঝে লুকিয়ে আছে রাজ্যের ভয়।

 

ক্লাশের জন্য তৈরি হচ্ছিল শ্রাবন্তী। মায়ের কথা শুনে কড়া ব্রেক কষতে বাধ্য হয়। ‘আজ যেতে হবে না, ছেলেপক্ষ আসবে’। শ্রাবন্তী ঘাবড়ে যায় না। তার টেনশনও হয় না। এ যেন প্রতিনিয়তই হচ্ছে। অথচ আজই তাকে প্রথম দেখতে আসবে।

ছেলেপক্ষ কখন আসে তার ঠিক নেই। বিকেলও গড়াতে পারে। শ্রাবন্তীর তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কোনো কিছু নিয়েই নেই। বিছানায় ব্যাগ ছুঁড়ে সোফায় ঝিম মেরে বসে আছে সে। দেখে মনে হবে অনুভূতিশূন্য এক জড় পদার্থ।

কিন্তু শ্রাবন্তী ভাবছে। সে ভাবছে, ছেলেপক্ষ কী দেখতে আসবে? তাকে? কিন্তু তাকে দেখবে কী করে? আয়নায় শ্রাবন্তী যাকে দেখে, ঠিক তাকে কি কখনো দেখা যায়? যাকে শ্রাবন্তী ভয় পায় একান্ত নিজের বলে। তাকে অন্যজন দেখবে কী করে?

নিজের কাছে ধরা খেতে পারে শ্রাবন্তী। কিন্তু তার সেই ‘আমিত্ব’কে আরেকজন ধরবে কীভাবে? মা এসে কিছুক্ষণ আড়চোখে শ্রাবন্তীকে দেখে যায়। অন্যরকম দেখা। চেহারার সুশ্রী ভাবখানা বেঁচে আছে কি-না তা দেখা। শ্রাবন্তী ওসবে গা করে না। তার সমস্ত চিন্তা ভেতরের সেই ‘আমি’টাকে ঘিরে। সেই চিন্তারও কোনো মাত্রা নেই।

ভেতরের এই ‘আমি’টাতো শ্রাবন্তীর ভেতর না-ও থাকতে পারতো। এই ‘আমি’ থাকতে পারতো রোগাটে সুজন, স্থূলকায় বান্টি কিংবা চা বিক্রেতা মতির কালসিটে শরীরের ভেতর। বিন্দুমাত্র তফাৎ থাকতো না তাতে। স্পষ্ট টের পায় শ্রাবন্তী।

‘তৈরি হয়ে নে, সময় হয়ে গেছে’। ভেতরের ‘আমি’টাকে কখনো তৈরি হতে হয় কি? ভাবছে শ্রাবন্তী। মায়ের তাগাদা তার ভাবনার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এখন আর কেন যেন ভয় পাচ্ছে না শ্রাবন্তী। নিজেকে নিয়ে ভাবতে বরং ভালোই লাগছে। একটা আবিষ্কারের আনন্দ টের পাচ্ছে। ভাবছে, তবে কি ‘আমি’কে পুরোপুরি ধরা গেলো, তাওতো সম্ভব না। সাপ কি কখনো নিজের লেজ খেয়ে শূন্য হয়ে যেতে পারে? তবে ভেতরের ‘আমি’টা অনেকখানি স্বচ্ছ হয়ে এসেছে শ্রাবন্তীর কাছে। নিজেকে এখন শুধুই কোনো মেয়ে কিংবা সন্তান ভাবতে পারছে না সে। অদ্ভুত কিন্তু ভালোলাগার একটি অনুভূতি তৈরি হয়েছে তার ভেতর। মায়ের কণ্ঠের উত্তাপও ফিকে হয়ে এসেছে। নিজেকে চিনতে পারার উত্তেজনায় শ্রাবন্তীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিড়বিড় করে বলে উঠে, ‘এ আমি! একান্তই আমার আমি!’।

শ্রাবন্তী বুঝতে পারে, বাইরের শ্রাবন্তীকে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। কিন্তু ভেতরের ‘আমি’টা স্বাধীন। সেই ‘আমি’টা নারী নয়, কারো সন্তান কিংবা স্ত্রী নয়। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অস্তিত্ব।

লেখক: ধ্রুব নীল

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!