অভিনয়ের জন্য ১১ মাস আগে সর্বশেষ ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান বাঁধন। নাটক বা টেলিছবির শুটিংয়ে এরপর আর অংশ নেননি তিনি। মাঝের সময়টাতে নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করার যুদ্ধে নেমেছিলেন। সিনেমায় অভিনয়ের জন্য নিয়মিত ব্যায়ামাগারে গিয়ে নিজের ওজন কমানো থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। জমকালো এক মহরতের মধ্য দিয়ে বাঁধনকে নায়িকা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। পরে ব্যক্তিগত কারণে সিনেমা থেকে সরে যান তিনি। অভিনয়ে দেখা না গেলেও বিভিন্ন মিডিয়া গ্যাদারিংয়ে তাঁর ঝলমলে উপস্থিতি সবার চোখে পড়ে। গতকাল ২৮ অক্টোবর ছিল বাঁধনের জন্মদিন। সেদিন তাঁর ব্যস্ততা, আগামী দিনগুলোতে অভিনয়ের পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
ছোটবেলায় জন্মদিন একভাবে পালন করা হতো। এখন জন্মদিনে কেমন লাগে?
জন্মদিনে সবাই শুভেচ্ছা জানায়, বেশ ভালো লাগে। বুড়ি হয়ে গেছি তো, তাই গিফট পাই না (হাসি)। তবে এবার জন্মদিনটা একটু আলাদা।
কেন?
এত বছর পর আমার উপলব্ধি হয়েছে, নারী হওয়ার চেয়ে মানুষ হয়ে ওঠা জরুরি। এই উপলব্ধি হয়তো আমাদের সমাজ একটা মেয়েকে করতে দেয় না। আমার মনে হয়েছে এত দিন একজন নারী হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি, সেটা ভুল ছিল। উচিত ছিল আগে মানুষ হওয়ার চেষ্টা করা। এটা কিন্তু সমাজ আমাকে শেখাতে পারেনি। সমাজ আমাকে শুধু নারী হতে শিখিয়েছে। এ কারণে আমি নিজে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করছি, সবকিছু চেপে গেছি। আমার সঙ্গে অন্যায় হলেও চুপ ছিলাম। ভেবেছি এসব বললে সমাজ আমাকে খারাপ বলবে। প্রতিবাদ করছি অনেক পরে। চার বছর পরে বলছি, আমার ডিভোর্স হয়েছে। এসবের মুখোমুখি হতে পারিনি শুধু সমাজের কথা ভেবে। ভাবতাম, এই ডিভোর্সের কথা কেউ জানলে ভবিষ্যতে আমার মেয়ের বিয়ে হবে না। একটা সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বলতে হবে। সমাজের সবাইকে হয়তো বদলাতে পারব না, আমি তো আমাকে বদলাতে পারব। আমার বদলটা আমার সন্তানের মধ্যে কোনোভাবে দিতে পারব। যদিও জানি না, সে ভবিষ্যতে কী করবে। কিন্তু আমার জীবনের কিছুটা প্রভাব তার জীবনে থাকবেই। চেষ্টা করব আমার মেয়ে যেন একজন নারী নয়, মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে।
এই উপলব্ধি কবে হলো?
এক বছর আগে। ডিভোর্সের পর সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার নিয়ে লড়াই করার পর। এক বছরে আমার জীবনে যে ভ্রমণটা হয়েছে, তার মধ্যে কিছু ভালো মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। যাঁরা প্রকৃত অর্থে মানুষ, জেন্ডার হিসেব করলে তাঁরা পুরুষ। কিন্তু তাঁরা সত্যিকার অর্থে মানুষ। তাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি কিছু বই পড়ছি। এর মধ্য হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ বইটি আমার ভাবনার দরজায় প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে। এই বই আমাকে অনেক ভাবিয়েছে।
বইটি পড়ার জন্য কেউ বলেছিল?
না। আমি একটা ফটোশুটে গিয়েছিলাম, ওই ফটোগ্রাফারের স্ত্রীর কাছে বইটি ছিল। বইটা দেখে মনে হলো, হাতে নিই, পড়ি। তারপর ভাবির কাছ থেকে বইটি চেয়ে নিয়ে আসি। সব সময় সহজ বই পড়তে পছন্দ করি। কঠিন কিছু কখনো ভালো লাগে না। ওই যে বললাম, কিছু ভালো মানুষ আমার চারপাশে আছেন, যাঁরা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছেন। তাঁরা বলেছেন, তুমি শুধু নারী নও, একজন মানুষও। কেন নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছ। আমি এই জীবনে এত কিছু অর্জন করেছি, শুধু বিয়ে ভেঙে গেছে বলে আমার সব অর্জন শেষ হয়ে যাবে? কোনোভাবেই না। সমাজ কেন শেখাবে, বিয়েতে ফেল করা মানে তোমার জীবন শেষ!
আপনাকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে?
অনেক। এখন অবশ্য সবকিছু বদলাচ্ছে। আমার এত এত অর্জন, সব কিন্তু বিয়ে দিয়ে বিচার করা হচ্ছিল। এসব দেখে নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। নেতিবাচক ভাবনা আমার ভেতরে তৈরি হয়। এমনও ভাবলাম, কিছু হবে না আমাকে দিয়ে। হতাশায় ডুবতে থাকলাম। এই বিষয়গুলো সমাজ একটা মেয়েকে উপলব্ধি করাতে বাধ্য করে। এই ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেয়েছি, একটা পর্যায়ে পেরেছি। এই ভাবনা আরও মানুষের ভেতর দিতে পারব কি না, জানি না; তবে আমার মেয়ের মধ্যে দিতে চাই। আমি চাই, সে নিজেকে মানুষ ভেবে বড় হোক। আমি একটা মেয়ে, এটা পারব না, ওটা পারব—এসব ভেবে যেন বড় না হয়।
ভালো মানুষ বলতে আপনি কী বোঝেন?
তাঁকে একজন মানবিক মানুষ হতে হবে, মানবতা যাঁর ধর্ম হবে। একজন ভালো মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে, সমাজের জন্য ভালো কিছু করবে, কারও ক্ষতি করবে না। যাঁর মূল্যবোধ থাকবে, নীতি থাকবে। একটা মেয়েকে অর্ধেক শেষ করে দেওয়া হয় নারী বানিয়ে। বিশাল প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে সে বেড়ে ওঠে। একটা মেয়ে পাইলট হতে চায়, তাঁকে প্রথমেই শুনতে হবে, দরকার নাই। অনেক ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে। তুমি বরং শিক্ষক হও। শুরুতেই কিন্তু মেয়েটাকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা। ছোটবেলা থেকে একজন মেয়ে ছোট মন নিয়ে বেড়ে ওঠে। একটা মেয়ের বাসা শ্বশুরবাড়িও না, নিজের বাড়িও না—তাহলে মেয়েটার বাসা কোথায়? একটা মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দাও। মেয়ের বাসা যেটা, ছেলের বাসাও সেটা। মেয়েটা নিজে কাজ করবে, ছেলেটাও কাজ করবে। মেয়েটা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবে, ছেলেটাও স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবে। এই জায়গাটা খুব বেশি দরকার। এই মানবিক দিকগুলো থাকতে হবে। ভালো মানুষ বলতে এটাই বুঝি।
যাঁরা আপনাকে উৎসাহ দিচ্ছেন, অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন; তাঁদের নাম বলা যাবে?
এভাবে নাম বলা ঠিক হবে না। দেখা যাবে একজনের নাম বলছি, আরেকজন মন খারাপ করবেন। আমাকে যাঁরা উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেন, তাঁদের বেশির ভাগই পুরুষ। তাঁরা আসলে মানুষ। কিছুসংখ্যক নারীও আছেন, যাঁরা অনুপ্রাণিত করেন। অনেকে ভাবেন, আমি হয়তো পুরুষবিদ্বেষী। মোটেও তা না।
এমন কেউ আছেন, আপনি যাঁর মতো হতে চান?
প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা আমি খুবই অনুপ্রাণিত। তাঁর ভেতরের শক্তির জন্য তাঁকে অনেক ভালোবাসি। তিনি একজন মমতাময়ী মানুষ, নিজের লক্ষ্য জানেন, কোনোভাবেই নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হন না। এটা বড় ব্যাপার। আমি এই সরকারের আমলে সন্তানের অভিভাবকত্ব পেয়েছি; যা বাংলাদেশে নয়, উপমহাদেশে বিরল ঘটনা। তাঁর দ্বারা আমি প্রভাবিত, আমি তাঁর মতো মানুষ হতে চাই।
অভিনয়ের খবর বলুন।
সত্যি বলছি, আমার আরেকটা উপলব্ধি, ভালো কিছু কাজ করা উচিত। ভালো কাজের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। হুট করে ঠুসঠাস কাজ করে ফেললাম। ঈদের আগে থেকে অনেক অভিনয়ের প্রস্তাব পাচ্ছি।
ওজন কমানোর পর আপনাকে নিয়ে সবার আগ্রহ বেড়েছে?
প্রথমত আমার নিজের ইচ্ছা। ফিটনেসও এখানে ভূমিকা রেখেছে। এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু একটা ভুল ধারণা মানুষের মধ্যে সব সময় ছিল। আমি যখন ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতা থেকে বের হই, তখন খুব গ্ল্যামারাস ছিলাম। সবাই ভাবতেন, আমি গ্ল্যামারভিত্তিক কাজ চাই, আসলে বিষয়টা মোটেও এ রকম ছিল না। আমি এখন ক্ষুধা থেকে কাজ চাই। ভালো কাজ চাই। যেখানে আমি নিজেকে ভাঙতে পারব, অভিনয়ের প্রমাণ দিতে পারব। ও রকম অভিনয় পাইনি বলে কাজ শুরু করতে পারিনি। যে কজন ভালো পরিচালকের সঙ্গে কথা হয়েছে, সবাই একাগ্রতার খুব প্রশংসা করেছেন। অনেকে আবেদনময়ী বলে শেষ করে দেয়, তাঁদের বলতে চাই—এটাকে প্রাধান্য না দিয়ে আমার একাগ্রতাকে আর চেষ্টাকে সম্মান করুন। আমার চেষ্টা ছিল বলেই গত এক বছরে এই জায়গায় আসতে পেরেছি। দেখা গেছে, গত বছর এই দিনেও আমি বাসায় বসে কান্নাকাটি করছিলাম। সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে শুধু একাগ্রতার কারণে নিজেকে সামলে নিতে পেরেছি।
কী দিয়ে ফিরছেন, নাটক নাকি সিনেমা?
দুজন ভালো নাট্য নির্মাতার সঙ্গে আলাপ চলছে, চূড়ান্ত হলেই শুরু করব। এর মধ্যে যদি কোনো সিনেমার ব্যাপারে কথা হয়, সেটাও করতে পারি। হয়তো দেখা যাবে, বিজ্ঞাপনচিত্র কিংবা ওয়েব সিরিজেও কাজ শুরু করে দিয়েছি। আমার কর্মক্ষেত্রকে অনেক শ্রদ্ধা করি। আজকে আমি বাঁধন হয়েছি, এখানে কাজ করার কারণে।
হলিউড আর বলিউডে ‘#মি টু’ আন্দোলন শুরু হয়েছে। আপনাকে এই ধরনের কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে?
শুনছি তো অনেক কিছুই। আমার বয়স এখন ৩৪। বুদ্ধি হওয়ার বয়স থেকে এখন পর্যন্ত এ রকম অনেক নিপীড়নের শিকার হয়েছি। মাকে বলতেও পারিনি। এখন অবশ্য আমার মেয়েকে এসব সম্পর্কে শেখাই। আমাদের এখানে মেয়েদের সেই অর্থে কোনো কিছু বলতে দেওয়া হয় না। মেয়েদের প্রতিবাদ কীভাবে করতে হয়, তা যদি ছোটবেলা থেকে শেখানো হতো, তাহলে ‘#মি টু’ পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন হতো না। আমাদের সময় বলা হতো, চেপে যাও চেপে যাও। এই চেপে যাওয়াকে প্রতিপক্ষ দুর্বল ভেবে আরও সুযোগ নেয়। আমরা ঢাকার চাঁদনি চক মার্কেটে যাই, ভিড়ের মধ্যে কত নোংরা হাত যে গায়ে চলে এসেছে! এই ঘটনা কিন্তু সব জায়গায় ঘটে। কোথায় বাদ দেবেন। শুধু মিডিয়াকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন কেন? নায়িকাদের সবকিছু শুনতে খুব মজা লাগে? এই জায়গাটা নষ্ট জায়গা প্রমাণ করতে মজা লাগে? নষ্ট তো আসলে সব জায়গা।
অভিনয় করতে এসে কখনো এমন আপত্তিকর অভিজ্ঞতা দেখতে হয়েছে?
সবাই জানেন, আমি সব সময় প্রতিবাদী। ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর পর সবাই তা টের পেয়েছেন। আমি নানাভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছি। অস্বীকার করে লাভ নেই। আমি কোথাও গেছি, আপত্তিকর মন্তব্য শুনেছি—এটাও তো একধরনের নিপীড়ন। চোখ দিয়েও তো প্রতিদিনই ধর্ষিত হচ্ছি। আমাদের এখানে চোখের সমস্যা, মনের সমস্যা। তা না হলে কেন শিশুরাও ধর্ষিত হবে! আপত্তিকর প্রস্তাবে অনেক কাজ বাদ দিয়েছি। যেখানে কিছু বিকিয়ে দিতে হবে, সেখান থেকে ফিরে এসেছি। কেন জানি, আমি সবকিছু আগে থেকে বুঝে যাই। ভালো মানুষ হঠাৎ করে শয়তান হয়েছে, এমনটা দেখা যায় না। শয়তান যারা, তারা প্রমাণিত শয়তান।
তাদের নাম বলা যাবে?
এসব নাম এখনই বলতে চাই না। সময় হলে ঠিকই বলব। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছি, এটা মিডিয়ার অনেকেই জানেন। তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদও করেছি।
কবে বলবেন?
বলব। আমি কোনো কিছুতে ভয় পাই না। আজকের অবস্থানে আসতে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি। আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে আরেক ধরনের মেয়ে আছেন, তাঁরা বলেন আমার সঙ্গে এমন কিছুই হয়নি! আমি হিপোক্রেট হতে পারব না, আমার সঙ্গে অনেক হয়েছে।