class="post-template-default single single-post postid-45612 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

জমিতে ইঁদুরের সমস্যা কিভাবে দূর করবেন

অনিষ্টকর প্রাণীর মধ্যে ইঁদুর মাঠ ফসল উৎপাদন ও গুদামজাত শস্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি প্রধান সমস্যা। প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন গুদামজাত শস্য ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি হয়ে থাকে। ইঁদুর মাঠের দানাজাতীয়, শাকসবজি, মূল জাতীয়, ফল জাতীয় ফসলের ক্ষতি করে থাকে। তাই জমিতে ইঁদুরের সমস্যা কিভাবে দূর করবেন এটা প্রত্যেক চাষীর জানা থাকা জরুরি।

ইঁদুর গম ফসলে শতকরা ৩-১২ ভাগ, ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ ফসল নষ্ট করে। এরা বছরে ধান ও গমের প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন পর্যন্ত ক্ষতি করে থাকে যার মূল্য আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকার ও বেশি। তাছাড়া ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে, খাবার খেয়ে ডিম ও ছোট মুরগি খেয়ে প্রতি বছর খামারপ্রতি প্রায় ১৮ হাজার টাকা ক্ষতি করে থাকে।

আবার গুদামঘরে সংরক্ষিত ফসলেরও মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে (প্রায় শতকরা ২০ ভাগ)। এরা যে শুধু ফসলেরই ক্ষতি করে তা নয়। বই খাতা, কাপড়, আসবাবপত্র, বিছানাপত্র ইত্যাদি কেটে নষ্ট করে। ইঁদুর প্রায় ৩০ প্রকার রোগ ছড়ায়। এছাড়া এরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সেচ নালায় গর্ত করে নষ্ট করে, অনেক সময় বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি কেটে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটায়। এজন্য ইঁদুর দমন অত্যন্ত জরুরি।

 

জমিতে ইঁদুরের সমস্যা কিভাবে দূর করবেন তা জানার আগে আরও কিছু বিষয় জেনে রাখা দরকার

ইঁদুরের বংশবৃদ্ধি : এদের বংশবৃদ্ধির হার অত্যন্ত বেশি। সুষ্ঠু পরিবেশ এক জোড়া ইঁদুর থেকে বছরে প্রায় তিন হাজার ইঁদুর জন্মলাভ করতে পারে। ইঁদুর বছরে প্রায় প্রতি মাসেই বাচ্চা দিতে পারে এবং প্রতি বারে ৬-৮টি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে। জন্মদানের ২ দিনের মধ্যেই এরা পুনরায় গর্ভধারণে সক্ষম হয়। জন্মানোর তিন মাসের মধ্যে বাচ্চা দিতে সক্ষম হয়। ইঁদুরের জীবনকাল ২ থেকে ৩ বছর।

 

ইঁদুরের আচরণ বা স্বভাব :

  • সব সময় কাটাকাটি করে। কারণ এদের দুই জোড়া কর্তন দন্ত যা অনবরত বৃদ্ধি পায়। এ দাঁতগুলোর আকার স্বাভাবিক রাখার জন্য এদের সব সময় কাটাকাটি করতে হয়।
  • নতুন জিনিসের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। যেমন- ফাঁদ বা বিষটোপের প্রতি লাজুকতা।
  • যে কোন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে ও বংশবিস্তার করতে পারে।
  • সাধারণত সূর্যাস্তের পরপরই এবং সূর্য উদয়ের আগে বেশি তৎপর থাকে।
  • ইঁদুর রাতে চলাচল করে এবং দিনে লুকিয়ে থাকে।
  • কিছু প্রজাতি আরোহণ এবং সাঁতারে পটু।
  • ইঁদুরের ঘ্রাণ শক্তি প্রবল এবং এরা খাদ্যের স্বাদ বুঝতে পারে তবে এরা রঙ নির্ণয় করতে পারে না।

ইঁদুরের প্রজাতিগুলো : বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ১৮ প্রজাতির ইঁদুর দেখতে পাওয়া যায়। এদের ক্ষতির ধরন ও তীব্রতা ভিন্নরূপ।

মাঠের কালো ইঁদুর : মাঝারি আকৃতির। পূর্ণ বয়স্কের ওজন প্রায় ১৫০-২৫০ গ্রাম। মাথাসহ দৈর্ঘ্যরে চেয়ে লেজ খাটো হয়। পিঠের পশম কালচে ধূসর এবং পেটের পশম ফ্যাকাশে ধূসর বর্ণের হয়। এরা মাঠ এবং ঘর উভয় স্থানেই গর্ত করে এবং ব্যাপক ক্ষতি করে।

মাঠের বড় কালো ইঁদুর : বড় আকৃতির। পূর্ণ বয়স্কের ওজন প্রায় ৫০০-১০০০ গ্রাম। মাথাসহ দেহের দৈর্ঘ্যের চেয়ে লেজ খাটো হয়। পিঠের পশম কালচে ধূসর এবং পেটের পশম ফ্যাকাশে ধূসর বর্ণের হয়। এরা মাঠ এবং সাধারণত নিচু স্থানে ব্যাপক ক্ষতি করে। এরা গর্ত করে বসবাস করে। মুরগির খামারেও এরা ক্ষতি করে থাকে।

গেছো ইঁদুর বা ঘরের ইঁদুর : মাঝারি আকৃতির। পূর্ণ বয়স্কের ওজন প্রায় ১২০-২০০ গ্রাম। মাথাসহ দেহের দৈর্ঘ্যরে চেয়ে লেজ বড় হয়। পিঠের কালচে বাদামি এবং পেটের পশম সাদা হয। এরা ঘরে এবং ফলফলাদির গাছে বাসা বাঁধে এবং ব্যাপক ক্ষতি করে। মুরগির খামারেও এরা ক্ষতি করে থাকে।

খাটো লেজযুক্ত ইঁদুর : মাঝারি আকৃতির। পূর্ণ বয়স্কের ওজন প্রায় ১০০-২০০ গ্রাম। মাথাসহ দেহের দৈর্ঘ্যরে তুলনায় লেজ অর্ধেক বা তার চেয়ে খাটো। পিঠের পশম ধূসর বাদামি এবং পেটের পশম কালচে ধূসর হয়। এরা মাঠে গর্ত করে বসবাস করে এবং ব্যাপক ক্ষতি করে।

নেংটি ইঁদুর : ছোট আকৃতির। পূর্ণ বয়সের ওজন প্রায় ১৫-২০ গ্রাম। পিঠের পেটের পশম হালকা বাদামি বর্ণের হয়। মাথাসহ দেহের দৈর্ঘ্যরে তুলনায় লেজ বড় হয়। এরা ঘরের মধ্যে বাসা বেঁধে বাস করে এবং বিছানাপত্রসহ ঘরের বিভিন্ন আসবাব কেটে ব্যাপক ক্ষতি করে।

 

জমিতে ইঁদুরের সমস্যা কিভাবে দূর করবেন : ইঁদুর যে ক্ষতি করে

  • ইঁদুর বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য যেমন- ধান, গম, ভুট্টা, বাদাম, ফলমূল বিশেষ করে শাকসবজি নারিকেল, পেয়ারা, সফেদা, লিচু, আম, লাউ, মিষ্টি আলু ইত্যাদি কৃষিজ ফসল খেয়ে ক্ষতি করে।
  • ইঁদুর ধান বা গমের শিষ আসার সময় ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে তেছরা করে কেটে গর্তের ভেতর নিয়ে বাসা তৈরি করে এবং খায়। এরা যা খায় তার চেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি নষ্ট করে।
  • খাদ্যদ্রব্যে মলমূত্র, পশম এবং রোগ জীবাণু সংক্রমিত করার মাধ্যমে ইঁদুর ক্ষতি করে।
  • গর্ত করে ঘরের কাঠামো নষ্ট করে এবং খাদ্যদ্রব্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করে।
  • মানুষ ও গৃহপালিত পশুপাখির জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন রোগের জীবাণু বহন ও বিস্তার করে।
  • গর্ত করে সেচ নালা, রাস্তাঘাট, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নষ্ট করে।
  • বিছানাপত্র, আসবাবপত্র, বইপত্রসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কাটাকাটি করে।

 

জমিতে ইঁদুরের সমস্যা কিভাবে দূর করবেন তথা ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা

ইঁদুর দমন পদ্ধতিগুলোকে আমরা সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি।

ক. পরিবেশসম্মত ভাবে দমন : কোনো রকম বিষ ব্যবহার না করে অর্থাৎ পরিবেশের কোন ক্ষতি না করে ইঁদুর দমনই হলো পরিবেশ সম্মতভাবে ইঁদুর দমন । বিভিন্নভাবে এটা করা যায়। যেমন-

১. পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা : বিভিন্ন পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইঁদুরের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়।

  • ইঁদুর নোংরা স্থান পছন্দ করে বিধায় বাড়িঘর, ক্ষেত খামার, পুকুরপাড়, বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদীর পাড় ইত্যাদি পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে হবে।
  • খাদ্য গুদাম এবং খড়ের গাদা মাটির সাথে তৈরি না করে, প্রায় ৬০-৭৫ সেমি. উঁচু মাচা তৈরি করে তার ওপর করতে হবে এতে ইঁদুরের উপদ্রব কম হবে। ক্ষেতের আইল মোটা হলে ইঁদুর গর্ত করে, তাই আইল ছেঁটে চিকন করতে হবে যাতে আইলের প্রস্থ ২০-২৫ সেমি. এর বেশি না থাকে।
  • বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বাড়ি বা গুদাম ঘরে ইঁদুর যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। অনুরূপভাবে নারিকেল বা সুপারি গাছে মাটি থেকে ৫-৬ ফুট উুঁচতে ও ২.৫ ফুট চওড়া মসৃণ টিনের পাত লাগিয়ে ইঁদুর প্রতিরোধ করা যায়। মানুষের মাথার চুল নেটের মাধ্যমে নারিকেল গাছে ব্যান্ডেজ করে রাখলে ইঁদুর ও কাঁঠবিড়ালি কম ক্ষতি করে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

২. নিবিড়ভাবে ফাঁদ পাতা : বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ইঁদুর দমন করা যায়। যেমন বাঁশ, কাঠের, টিন ও লোহার তার দ্বারা তৈরি ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। ফাঁদ সাধারণত ২ প্রকার, জীবিত অবস্থায় ধরা ফাঁদ এবং মৃত্যু ফাঁদ। মৃত্যু ফাঁদে সরাসরি ইঁদুর যাঁতাকলে আটকিয়ে মারা যায়। জীবিত ফাঁদে মারা যায় না। ফাঁদে স্ত্রী বা পুরুষ ইঁদুরের মলমূত্র, গায়ের গন্ধযুক্ত টোপ ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া ফাঁদে ব্যবহৃত দ্রব্য যেমন বিস্কুট, নারিকেল, শুঁটকি মাছ এর সাথে যদি কার্বন-ডাই সালফাইড মিশ্রিত করা যায় তবে দ্রুত ভালো ফল পাওয়া যায় (শতকরা ৫০-৬০ ভাগ বেশি)।

আঠা (Rat glue) দ্বারা বাসাবাড়িতে ও মাঠে ইঁদুর দমন করা যায়। নতুন গর্তের মুখে ইঁদুর চলাচলের রাস্তায়, ক্ষেতের আইলে বা ঘরের দেয়াল ঘেঁষে ফাঁদ ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। লক্ষ রাখতে হবে যেন ফাঁদ প্রতিদিন পরিষ্কার করা হয় এবং নতুন খাবার/টোপ দেয়া হয়। ফাঁদে টোপ হিসাবে শুঁটকি মাছ, নারিকেলে পারুটি বেশি কার্যকর।। বেড প্লান্টিং করে গম চাষ করলে ইঁদুরের আক্রমণ কম হয়।

৩. পরভোজী প্রাণী সংরক্ষণ : পেঁচা, গুইসাপ, বেজি, শিয়াল, বিড়াল ইত্যাদি প্রাণীর প্রধান খাদ্য ইঁদুর। এ প্রাণীগুলোকে সংরক্ষণ করলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ ইঁদুর সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।

জমিতে ইঁদুরের সমস্যা কিভাবে দূর করবেন

খ. রাসায়নিক পদ্ধতি : বিভিন্ন ধরনের বিষ ব্যবহার করে ইঁদুর দমনকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন বলে। দুই ধরনের বিষ সাধারণত পাওয়া যায়। তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ এবং দীর্ঘস্থায়ী বিষ।

  • তাৎক্ষণিক বিষ খাওয়ার ১-২ ঘণ্টার মধ্যেই ইঁদুর মারা যায়। কিন্তু কয়েক দিন ব্যবহার করার পর বাদ বাকি ইঁদুরেরা বিষটোপ তেমন আর খেতে চায় না। একে বলে বিষটোপ লাজুকতা। এই বিষটোপ ব্যবহারের পূর্বে ১ থেকে ২ দিন বিষহীন টোপ ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিক বিষ হিসাবে জিংক ফসফাইড বিষটোপ ব্যবহৃত হয়, যা বিভিন্ন নামে বাজারে বিক্রি হয়। জিংক ফসফাইড মিশ্রিত গম বিষটোপ গর্তের ভেতর প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

 

জমিতে ইঁদুরের সমস্যা কিভাবে দূর করবেন ?

 

  • দীর্ঘস্থায়ী বিষটোপ খাওয়ার ৬-৭ দিন পর ইঁদুর মারা যায়। তাই অন্যান্য জীবিত ইঁদুর বুঝতেই পারে না যে, এই বিষটোপই তাদের সঙ্গীদের মৃত্যুর কারণ।
  • ফলে ইঁদুর দমনের সফলতা বেশি আসে। অবশ্যই সরকার অনুমোদিত পেস্টিসাইড ডিলারের নিকট থেকে বিষটোপ কিনতে হবে। বাড়িঘর, ক্ষেত খামার যেখানেই ইঁদুরের আক্রমণ হোক না কেন, এক স্থানে অনেকগুলো বিষটোপ না রেখে ৪-৫ স্থানে বিষটোপ ইঁদুরের গর্ত ও চলাচলের রাস্তার আশেপাশে রাখা উচিত।
  • বিষটোপ প্রস্তুত বা ব্যবহারের সময় খুব সতর্কতা অবলম্বন করা একান্ত দরকার। বিষটোপ ছোট ছেলেমেয়েদের ও গৃহপালিত পশুপাখির নাগালের বাইরে রাখতে হবে। মৃত ইঁদুরগুলো একত্র করে গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে।
  • বিষটোপ ছাড়া এক প্রকার গ্যাস বড়ি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড দিয়েও ইঁদুর দমন করা যায়। প্রতিটি সতেজ গর্তে একটি ট্যাবলেট দিয়ে গর্তের সব মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে। গর্তের মুখ খোলা থাকলে বা মাটিতে ফাটল থাকলে গ্যাস বেরিয়ে যাবে এবং ইঁদুর মারা যাবে না।
  • ইঁদুর দমনের সফলতা নির্ভর করে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর। অতএব, সম্মিলিতভাবে ইঁদুর দমন করলেই ইঁদুরের উপদ্রব কমানো সম্ভব। ঘরে বা ফসলের মাঠে ইঁদুর দমনের পাশাপাশি উঁচু রাস্তা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সব স্থানেই একটি সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!