Saturday, May 24

বিষাদের ধূলিঝড়ে অন্তিম যাত্রা

আজাদ: জীবনের পথে চলতে চলতে কখন যে দীর্ঘশ্বাস আমার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা মনে করেও আর ঠিক ঠাহর করতে পারি না। মনে হয়, চিরকাল যেন বুকের গভীরে দুঃখ জমে ছিল, আর আজ তা ফুসফুসের প্রতিটি কোষে বিষের মত ছড়িয়ে পড়েছে। চেষ্টা করি তা চেপে রাখতে, দমিয়ে রাখতে — কিন্তু সম্ভব হয় না। একসময় নিজের অজান্তেই সে দুঃখের বাতাস জোরে ফেটে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস হয়ে।


দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বুকের ভেতর জমে থাকা এই দুঃখের ভার কোনোভাবেই কমাতে পারি না। আশেপাশে হাজার হাজার মানুষের ভিড় — ফোন বুকেও জমে আছে প্রায় আড়াই হাজার পরিচিত নাম্বার। অথচ, যখন দুঃখে বুক ভেঙে যায়, যখন কাউকে প্রয়োজন হয় মন খুলে বলতে, তখন এই নাম্বারগুলো আমার কাছে হয়ে ওঠে কেবল শকুনের চোখে দেখা অচেনা ছায়া।


কত চেষ্টা করি, খুঁজে বেড়াই একটিমাত্র পরিচিত, আপন মানুষের সন্ধান, যে আমার ব্যথার কথা মন দিয়ে শুনবে, যে আমাকে সান্ত্বনা দেবে বা অন্তত একটা সম্ভাবনার আলো দেখাবে। কিন্তু না, তাদের মধ্যে কেউ নেই। যাদেরকে নিজের আপন মনে করেছিলাম, নিঃস্বার্থ বলেই বিশ্বাস করেছিলাম, তাদের সাথে সামান্য কিছু কথা বললেই সেই মোহের পর্দা ছিন্ন হয়ে যায়। কঠিন সত্যটা ধরা পড়ে — আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছিলাম। এত বছরের অভিজ্ঞতা, এত জীবনের ধুলোমাখা পথ পেরিয়েও আপন-পরের ঠিকঠাক বিচার করতে পারিনি।

ভদ্রতার খাতিরে বা বিব্রত না করার আশায় সরাসরি ফোন না দিয়ে ক্ষুদ্র বার্তা পাঠাই, যাহাতে সময় পেলে অন্তত তারা উত্তর দিতে পারে। কিন্তু অধিকাংশই সেই বার্তাগুলোর কোনো উত্তর দেয় না। কেউ কেউ দায়সারা কিছু শব্দ ছুঁড়ে দেয়, যেন আমি তাদের কাছে বিরক্তিকর এক বোঝা। কেউ কেউ আবার হোয়াটসঅ্যাপের সিন অপশন বন্ধ করে রাখে, যাতে বার্তা দেখেছে কিনা, তা বুঝতে না পারি।


প্রয়োজনের তাগিদে, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ফোন দিই — বারবার, অবিরাম, প্রায় বেহায়ার মত। অথচ তাতেও অধিকাংশ সময় ফোন ধরার সৌজন্যটুকু দেখায় না। তাদের এই নির্লিপ্ততা, এই অবজ্ঞা আবারও বুক ভাসায় দীর্ঘশ্বাসে। এখন তো এই দীর্ঘশ্বাসই আমার নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে।


একটা সময় ছিল, যখন তাদের ডাকে সাড়া দিতে কখনো দেরি করতাম না। তাদের বিপদে নিজেকে ভুলে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেছি, সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি। নিজের টাকা, নিজের সময়, নিজের সম্পর্কের ঝুঁকি নিয়ে হয়েছি তাদের রক্ষাকবচ। কতোবার নিজের সমস্যাকে তুচ্ছ করে অন্যের সমস্যা নিজের করে নিয়েছি! আজ সেইসব মানুষগুলোকেই দেখি — যেন তারা কোনোদিনই আমার কাছ থেকে কিছু পায়নি, কোনোদিনই আমার কাছে সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। কী অবলীলায় তারা ভুলে গেছে সেইসব দিনের কথা!

আজ যখন তাদের দেখি, তাদের এই নির্লজ্জতা, কৃতঘ্নতা মনে করিয়ে দেয়, কতটা বোকা ছিলাম আমি। তাদের জন্য সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলাম, অথচ তার বিনিময়ে পেয়েছি অবহেলা আর তাচ্ছিল্য।
এই কি মানবজীবন? এই কি জীবনধারা, যা সবাই মেনে নেয়? নাকি কেবল আমার সঙ্গেই এমন হয়েছে? কখনো মনে হয় উত্তর খুঁজবো, তারপরই মনে হয় — উত্তর খুঁজে কী হবে? যাদের মনুষ্যত্বই হারিয়ে গেছে, সেখানে প্রশ্নেরও আর কোনো মূল্য নেই।


আজ নিজের প্রতিচ্ছবির দিকেও তাকাতে ভয় হয়। আয়নায় দেখা সেই ক্লান্ত, হতাশ, বিধ্বস্ত মুখের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। নিজেকেই নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হয়। নিজের জন্ম, নিজের বংশ, নিজের পরিচয় — সবকিছু ঘৃণার আবরণে ঢেকে যায়। মনে হয়, যদি কোনোদিন এ জীবন শুরুই না হতো! যদি জন্মের আগেই শেষ হয়ে যেত সবকিছু!
এই বোঝা, এই গ্লানি এখন আমার নিত্য সঙ্গী। আর কখনো মুক্তি আসবে কিনা, তাও জানি না।


এখন কেবল টেনে নিয়ে যাওয়া — এই ক্লান্ত জীবন, এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় বিষাদের ধূলিঝড়ে হারিয়ে গেছি আমি।

লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ: mdabulkalamazad21@yahoo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!