Sunday, April 28
Shadow

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মনোদৈহিক গল্প : গন্ধবয়ান

গল্প‘আস্তা পাগল না হইলে কেউ এমুন করেনি! হালায় নেংটা হইয়া মাটিতে গড়ান দিতাসে। গ্যাদগ্যাদা প্যাঁকের মইদ্দে সে কি হাসন। আমি তো ডরে ডরে চাইয়া দেখি, ভুতে ধরলো নিহি! না তো! কাছে গিয়া দেখি আমারে দেইখা পুরাই শরমিন্দা। কইলাম, কিরে দলু তোর লুঙ্গি কোনহানে তুই কোনহানে। দলু কতা কয় না। কয় না তো কয়ই না। শ্যাষে আমি চইলা যাওনের ভান নিলাম। করই গাছের চিপাত্থন দেহি দলু প্যাঁকের মইদ্দে লুঙ্গি বিচরাইতেসে। মনে হইল যাইন, হবায় ক্ষেতের মইদ্যে কোনো মাইয়া লোকের লগে আকাম কইরা অহন পলাইবার লাগসে।’
ফুলতলা গ্রামের মানুষজন মাঝে সাঝে একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলেও এমনিতে তাদের সাধারণ দিনলিপিতে বিস্ময়ের স্থান বেশ সংকীর্ণ। জীবনের প্রতি চাওয়া ও চাওয়া পূরণের সঙ্গে তারা তাদের বিস্ময়বোধটাকে ব্যস্তানুপাতে মানিয়ে নিয়েছিল কয়েক পুরুষ আগে থেকেই। এর মধ্যে নতুন করে আবার অনিশ্চিত সময়কালের জন্য একটা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিল দলু। দবিরউদ্দিন বা মফিজ উল্লাদের মতো দুই খ- নাম পায়নি সে। এক চিলতে জমির মতো দলু। তার অনেক গুণ। জমিতে হাত দিয়ে বলে দিতে পারে ফসল ধরবে কোন দিন। কোন মাটি উর্বর, কোন মাটিতে সার দেওয়া লাগবে। এসব বলার আগে তাকে দীর্ঘক্ষণ মাটিতে হাত বুলোতে দেখা যায়। গ্রামের লোক উৎকণ্ঠা নিয়ে দলুর হাত বুলানো দেখে। মাটিতে হাত বুলানোর সময় দলুর চোখ বুঁজে আসে। ঠোঁট কাপে। হাঁপায়। গ্রামের লোক ভাবে দলুর মাথায় তখন বাতাস ধরে। দলু যেন পাখির পালকের মতো উড়তে থাকে সবার সামনে। কতক্ষণ হাত বোলানো চলবে তার কোনো ঠিক নাই।
গ্রামের লোকেরা দলুর এই গুণের কথা জানে এবং জমি চাষ করার আগে কিংবা ফসল বোনার আগে তাকে ডেকে নিয়ে যায়। দলু যেটা বলে সেইটাই হয়। এমন গুণওয়ালা লোক যে একটু পাগল কিসিমের হবে, এটাও তাদের মাথায় ছিল। আর তাই যুবক কৃষক সারওয়ারের কথা শুনে তারা নতুন করে বিস্ময়ের উপকরণ খুঁজে পায় না। কিন্তু সারওয়ার নাছোড়বান্দার মতো গল্পটা করেই যাবে। দলু যে আসলেই উলঙ্গ হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছিল এবং তাকে আরও অনেক কিছু সে দেখেছিল, এই বিষয়টা যতক্ষণ গ্রামবাসী ঠিকঠাক মতো কল্পনা না করছে, ততক্ষণ থামবে না ঠিক করেছে সারওয়ার।
কিন্তু বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সে আবার গুলিয়ে ফেলে এবং গ্রামবাসীর কল্পনার সুতা আবার কেটে যায়।
‘দলু লুঙ্গি খুঁজি পায় না। তারপর দেহি গুড়ুম কইরা দৌড় দিল। দাবড়ানি কারে কয়।’
‘কিন্তু সারওয়ার মিয়া, আমগোরে কও যে তার আগে হ্যায় কী করসে? ক্ষেতে কোনো মাইয়া মানুষরে তুমি দেখসোনি?’
‘আমি কী কইতেসি হালারপো তোমরা কান দেওনা ক্যান? কইসি না মাইয়া মানুষ নাই!’
গ্রামবাসী ধমক খেয়ে প্রথমে চুপসে যায়। এরপর সারওয়ার আবার বলে, ‘আমি হ্যারে সালিশে ডাকুম। দেইখো তোমরা। ও খারপ কাম করসে। কত্ত বড় হারামি।’

আরো পড়ুন : প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মনোদৈহিক গল্প : দর্শক

গল্প

‘তোমার জমিত আত দিয়া দলু কইসিল এইবার ধান অইবো না। তুমি তো মিয়া হ্যার কতা হুনলানা। অহন দলুর লুঙ্গির পিসে লাগসো ক্যালা।’
গ্রামবাসীর পাল্টা আক্রমণে দমে যায় না সারওয়ার। সে আসলে নিজের কাছে আগে পরিষ্কার হওয়ার চেষ্টা করে, সে যা দেখেছে সেটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এ বিষয়ে নিজের কাছে একটা সুস্পষ্ট অবস্থানে আসার আগ পর্যন্ত তার কানে বাদ বাকি পাল্টা অভিযোগ বিশেষ মূল্য পায় না।
যুবক কৃষক সারওয়ার সালিশ ডাকে। ঘটনার পর সারা দিন সে গুছিয়ে নিয়েছে যে সে আসলে ঠিক কী দেখেছিল। সন্ধ্যার পর পর খবর পেয়ে ময়লা লুঙ্গি আর খালি গায়ে দলুও আসলো সফিউল বেপারির মজলিশে। মিইয়ে গেছে দলু। জ্বর টর আছে মনে হয়। সালিশ কেন ডাকা হলো, কেনই বা তাকে আসতে হলো, মনে হয় জানে না। গতকালের স্মৃতিও ভাসা ভাসা। যুবক কৃষক সারওয়ার বারকয়েক রুদ্রচোখে তাকালেও দলু সেটা ধরতে পারে নাই। বৃষ্টির কালে শীত শীত লাগে দেখে কয়েকজন চাদর মুড়ি দেওয়া লোক সামনের সারিতে। তারা মনে হয় বাদলা মৌসুমে আর কোনো কাজ না পেয়ে সালিশের ফিরিস্তি শুনতে আসে। আবার এমনও হতে পারে সামনের সারির জুবুথুবু বসে থাকা চাদর জড়ানো লোকগুলো মানুষের গল্প শুনতে আসে।
‘দলু মাটির লগে খারাপ কাম করসে।’
সারওয়ার সবার সামনে দাঁড়িয়ে। এক দিন ভেবে সে এই বাক্যটাই বের করেছে। তার আর বিশেষ কিছু বলার নাই। মোড়ায় বসা সফিউল বেপারি, যিনি গ্রামের সবচেয়ে বিচক্ষণ লোক হিসেবে সম্মানিত, তিনি বিশেষ কথা বলেন না। যুবক সারওয়ারের কথায় তার ভ্রূও খানিকটা নড়ে চড়ে উঠলো। জমায়েতে গুঞ্জন ভারি হয়। আকাশে মেঘ ডেকে উঠলে উপস্থিত গ্রামবাসীর ভেতরটা আবার ভেজা ভেজা লাগে। তারা চাদর আরও টেনেটুনে বসে। সারওয়ার সবার দিকে দেখে। দলুর দিকেও তাকায়। দলু আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই।
‘তুমি বুজাইয়া কও।’
‘আফনেরা বুঝেন না খারাফ কাম কোনডা? হেইডা করসে। ঘরে বউ নাই, হ্যায় আইসে আমার জমিনের লগে অকাম করতে।’
উপস্থিত গ্রামবাসী বিভ্রান্তি দূর করতে চায় না সহজে। তারা সময় নেয়। দুয়েকজন হুঁকায় দম নেয়। পেছনে কে যেন বিড়ি ধরিয়ে কাশে। তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বলতে চায়। কিন্তু জাম, কদম আর লেবু গাছ বয়ে আসা ভেজা বাতাসে তাদের শব্দগুলো বিড়বিড়ানি হয়ে ধুয়ে চলে যায়। দলুর সরল হাসিতে নতুন করে আরও রহস্যে ডুবে যেতে থাকে গ্রামবাসী। এর মধ্যে তাদের কেউ দম নিতে হাঁসফাঁস করে না। আপাতত যেন কয়েক বছর বা যুগ পর চুপচাপ মরে যাওয়াই তাদের কাজ। গ্রামবাসীর মনে হয় তাদের একদিন মরে যাওয়াটাই জীবনে বড় রহস্য হয়ে সামনে পড়ে থাকে।
গ্রামবাসী সারওয়ারের কাছে আবার ঘটনার বৃত্তান্ত জানতে চায়। সারওয়ারের মনে হয় সে নিজে এবার নিজের অভিযোগের জালে আটকা পড়ছে। সে আবার ঘটনার বয়ান করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। যেহেতু সে তার থিকথিকা কাদা জমে থাকা ধানি জমিতে কোনো মাইয়া মানুষ দেখে নাই, তাই দলুর প্রতি শক্ত অভিযোগ আনতে পারে না। আর দলু এসবের ঊর্ধ্বে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে, যারা কান পেতে ছিল তার কথায়, তারাই কেবল সে কথা শুনতে পায় এবং কথাগুলো তাদের কাছে পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়, দলু তখন বলে, ‘আসমানের পানি পড়বো এইবার। জমিগুলান পোয়াতী হইবো। পোয়াতী জমির খিদা বেশি।’
যুবক কৃষক সারওয়ার আর সালিশ ডাকে না। সে খালি পাহারা দেয়। দুই দিন কি তিন দিন। দলুকে আর নিজের জমিতে পায় না সারওয়ার। মাঝে একদিন শুধু কাশেম আলীর সবজি ক্ষেতে দেখেছিল, একটা পাকুর গাছের আড়াল থেকে। নিড়ানি দেওয়া মাটির দলা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে আছে দলু। এরপর উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে কয়েক মিনিট, বা যেই সময়টুকু সারওয়ারের কাছে এক বেলা বলে মনে হয়। দুপুর হলে দলু উঠে আবার শোয়। মাটি গায়ে মাখে। ধীরে ধীরে। তাড়াহুড়ো নেই। দলা দলা মাটি ঝুর ঝুর করে পড়ে পোড়া হাড় জিরজিরে বুকে, কোমরে। উপুড় হয়ে শুয়ে মাটির গন্ধ শোঁকে। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে মাটি ঢুকে যায়। হয়তো মাটি খায়ও। তারপর সারওয়ার দুই কি তিনবার ‘হালায় একটা আস্তা পাগলা’ বলে গজগজ করতে করতে চলে যায়। সারওয়ার অনেক দূর চলে আসে। তবু দলুর তৃপ্তিমাখা মুখ চোখ থেকে সরে না। খুব কাছ থেকেই যেন সে দেখে, উপুড় হয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় দলুর শিরদাঁড়া কুঁচকে আসে। চোখ বুঁজে আসে ভীষণভাবে। মাটিতে মাথা গুঁজে দেয় জোরে। গন্ধ নেয় পাগলের মতো। দলুর একটা কিছু হয়েছে। ভীষণরকম কিছু একটা।
সারওয়ারের মাথা ঝিম ঝিম করে। সেদিন আর চারা রোপণ করতে জমিতে যায় না। তার ভেতর অন্য কেউ কথা বলে। দলুর মাটি মন্থনের ছবি ওঁৎ পেতে থাকা শূকরের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বেরিয়ে আসে।
‘কই গো, শইলডা বালা না। একটু হুঁকা বানাও।’
যুবক সারওয়ারের গেল শীতে বিয়ে করা বউ শিরিনের চোখের পাতা তির তির করে কেঁপে ওঠে। আমরা জানি না সেটা ভয় নাকি আনন্দের। নাকি গ্রামবাসীর মতো সেও বিভ্রান্তিতে থাকতে ভালবাসে। তাগড়া যুবক ও কৃষক সারওয়ার যে হুঁকা খাওয়ার জন্য বাড়িতে আসে নাই এটা ধরে নিতে আমাদের কষ্ট হয় না। তারপর আমরা কোনো একটা পাকুর কিংবা অশ্বত্থ গাছের আড়ালে থেকে সারওয়ারের দুর্বল বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই এক রহস্যময় মিলন দৃশ্য। শিরিনের শরীরে উপুড় হয় সারওয়ার। আবার চিৎ হয়ে শোয়। শিরিনের হাত ধরে শরীরের ওপর ছেড়ে দেয়। মাটির দলার মতো সে হাত ঝরে পড়ে বুকের কাছে। গড়িয়ে পড়ে যায় এক প্রান্তে। তারপর আবার উপুড় হয়। শিরিনের কানের কাছে মুখ এনে বেমক্কা শ্বাস নেয়। শিরিন ভয় পায়। চোখ বুঁজতেই চোখের সামনে জমিতে শুয়ে থাকা নগ্ন দলু। মাটিতে নাক চেপে গন্ধ নেয়। সারওয়ারও। তারপর সারওয়ার বিড়বিড় করে বলে এবং ক্রমাগত বলতেই থাকে, আমার জমি! জমিরে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!