‘কেমন আঁকে বললি?’
‘ফাটাফাটি!’
‘ছবির জন্য এটা কোনো বিশেষণ হতে পারে না।’
‘তা হলে দুর্দান্ত!’
‘এটাও হলো না। ছবির জন্য অন্য বিশেষণ দরকার, বা দরকারই নেই।’
বিথির মেজাজ গরম। বান্ধবীকে বোঝাতে পারছে না যে তার ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় বর্ষের ছেলেটা, যে কিনা কারো সঙ্গেই তেমন কথা বলে না, সে কেমন ছবি আঁকে। রেনু বিবিএ-তে। আঁকাআঁকিতে ঝোঁক আছে। ঝোঁকটা শেষপর্যন্ত আর জোঁক হয়ে চেপে বসেনি। চারুকলায় বন্ধু-বান্ধব আছে অনেকে।
‘তুই তার এত বড় ভক্ত কবে থেকে? ওর সঙ্গেও প্রেম করার খায়েশ?’
‘অবশ্যই! সে বললে একবাক্যে রাজি। নাইমকে বলে দিব, ও ভাই! তোমায় টা টা। আমি মিন্টুর সঙ্গে চললাম।’
‘পোর্ট্রটে আঁকে?
‘হুম, সবই করে। পোর্ট্রেট বললে কম হয়ে যাবে। ও একটা জিনিয়াস।’
‘তার মানে ও বললে একবাক্যে কাপড় খুলে দাঁড়িয়ে যাবি?’
‘অবশ্যই যাব! ও আমার একটা ন্যুড করে দিলে সেটা আমি নিজের হাতে নাইমকে গিফট করবো দেখিস!’
নাইম বিথির প্রেমিক। ছাত্র আন্দোলন করে বেড়ায়। আশির দশকের একটা স্টাইল ধরে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা চালায়। তবে সেটা কেবল সিগারেটের বেলাতেই। নাকেমুখে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দেশের মানুষ যে কতটা লুজ সেটাই বলে বার বার। রেনুর মাঝে মাঝে মনে হয় নাইমের নাক দিয়েও কথা বের হয়। বিষয়টা অদ্ভুত লাগে তার। নাইম কথা বলার সময় সে হা করে তার চিকন খাড়া নাকটার দিকেই তাকিয়ে থাকে।
‘মিন্টু হলো আর্টিস্ট। তুই না। কারণ তুই আর্ট বুঝিস না। ওর সামনে একটা তরমুজ যা আমিও তা। আমি মানে কাপড়ছাড়া আমি, বুঝলি! আর তুই মনে করিস না যে তোর সাদা চামড়া আর এই ফিগার দেখলে ওর মাথা আউলা হয়ে যাবে। কিছুই হবে না! বাজি ধরবি?’
‘হয়েছে হয়েছে। তুই তরমুজ। মানলাম। ভালো উপমা দিয়েছিস। টসটসা তরমুজ!’
‘হারামজাদি! উল্টোপাল্টা বলবি না। আর্টিস্টের কাছে তরমুজ যা ময়লা গন্ধওয়ালা মোজাও তা। তুমি তো আবার খুচরা আর্টিস্ট। তরমুজ তো পারবি, পারলে একটা ময়লা মোজা এঁকে দেখা!’
‘খেপিস না। বেশি খেপলে এখানেই সব খুলে ফেলতে পারিস। তোর মাথায় সমস্যা আছে। আমাকে দেখ, আমি কত কুল!’
‘কুল তো থাকবিই। যে সব পরে ঘুরে বেড়াস। আমি তো পারি না। বাসায় সিম্পলি কেটে ফেলবে। হোস্টেলে মহা আরামে আছিস রে! ওহ শিট! বারোটা বাজে! নাইম যাবে মেট্রোতে। ওর একটা ল্যাম্প কিনতে হবে। আমি গেলাম।’
বিথি চলে গেছে কতক্ষণ হলো সেটা টের পায়নি রেনু। ভাগ্যিস একটাই বান্ধবী তার। একা একা নিজের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে সুবিধা। হোস্টেলের দিকে না গিয়ে বসেই আছে চারুকলার ভেতরে। অনেকেই উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছে। কেউ তাকিয়েই আছে তার নগ্ন বাহুর দিকে। রেনু এসব দেখে ক্লান্ত। চোখে ভারি চশমাওয়ালা পরিপাটি এক ছোকড়াও আড়চোখে তার বুকের দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। রেনুর মনে হলো সে একটা বার্গার না তো? গিয়ে জিজ্ঞেস করবে নাকি ছোকড়াটাকে? ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে এ সব নিয়ে রেনু কয়েকবার হম্বিতম্বি করেছে। এখন আর গা করে না। দেখুক। দেখলে দোষের কী! সে সামনে এসে দাঁড়ালে ছেলেদের হাত দিয়ে চোখ ঢাকতে হবে এমন আইন নেই। মন চাইলে এক ইঞ্চি সামনে এসে হা করে দেখুক। রেনু এবার যথারীতি তার নিজের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে দিল। এটা তার রোজকার অভ্যেস।
‘তো রেনু, বিথি যে বলল তুমি আর্ট বোঝো না? সত্যি নাকি?’
‘বুঝি তো! অবশ্যই বুঝি!’
‘ও যে বলল।’
‘ও কচু জানে আমাকে। বন্ধু হলেই মনের সব খবর রাখবে, এটা ঠিক না।’
‘হুম। তো এমন কী আছে তোমার যে বিথি যেটা জানে না।’
‘আছে। আমার মন অতি ভয়ংকর! আমি চাইলেই মার্ডার করতে পারি। একটা তো করেছিই। কিন্তু এখন আর করি না। এটা কেউ না জানলেও আমাকে সবাই ভয় পায়। আড়ালে বেশ্যা বলেও গাল দেয় নাকি। বাট. আই ডোন্ট কেয়ার।’
‘কিন্তু তুমি তো এখন এটা ভাবছো না। তুমি দেখতে চাইছো মিন্টু ছেলেটাকে একটু বাজিয়ে নিতে।’
‘তাতে সমস্যা কী! যা খুশি করবো! আয়্যাম ফ্রি উইম্যান!’
‘অবশ্যই। কোনো সমস্যাই নেই। তুমি যা ভাববে তা-ই। আমি তোমার মন, আমি তুমি এক কথা। তবে এখন পেটের কথা শোন। লাঞ্চটা সেরে নাও। এরপর মিশন মিন্টু শুরু হবে।’
মিশন মিন্টুর জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না রেনুকে। রেনু এতই সুন্দরী যে তার মুখ থেকে কথা পায়ে যাওয়া লাগে না। তার আগেই বান্দা হাজির। তবে মিন্টু হাজির হলো না। হাজির হলো তার ঠিকানা। ফোন নম্বরও আছে। তবে মিন্টু নাকি ফোন ধরে না। তাই আর সে চেষ্টায় গেল না রেনু। তবে মনে মনে কথা বলার মতো মনে মনে ফোন করলো ও।
‘মিন্টু? আমি রেনু বলছি। আপনার জুনিয়র।’
‘জ্বি জ্বি বলুন।’
‘আমার একটা পোর্ট্রেট এঁকে দেবেন? আমি খুব সুন্দরী। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে গড়ে প্রতিদিন পনেরবার হাই সেক্সি শুনতে হয়।’
‘হা হা হা। বেশ মজার তো। গড়ে পনেরবার হিসাব করেছেন?’
‘জ্বি। আমি হিসাবে খুব শক্ত। বিবিএ পড়ি। বিথি আমার বান্ধবী। ও আপনার মহাভক্ত। আপনি বললে নাকি… না থাক।’
‘না না বলুন, কী করবে আমি বললে?’
‘আন্দাজ করে নিন।’
‘হা হা। আমার আন্দাজ ভাল না।’
কাল্পনিক কথাবার্তা বেশিদূর এগুলো না।
মিন্টুর সঙ্গে দেখা করতে রেনু রওনা দিল তার ধানমণ্ডির স্টুডিওতে। শ্রাবণের বিশ তারিখ আজ। বাংলা মাসের হিসাব রাখে রেনু। এটা তার অনেকগুলো বাতিকের একটা। ইদানীং বৃষ্টিটাও খুব স্বাধীনতা পেয়ে বসেছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলে হুট করে মনে হবে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়েছে কেউ। আজ তেমনটা হলো না। গুড়ি গুড়ি শুরু হতেই রেইনকোট চাপিয়ে বের হলো রেনু। রেইনকোট রেনুর প্রিয়। বৃষ্টি গা ছুঁয়ে যায়। আবার ছোঁয় না।
কলিং বেল চাপতে হলো না। দরজা খোলা।
‘কে!’
‘রেনু।’
‘রেনু কে?’
‘আপনি কোথায়?’
‘ভেতরে আসুন।’
খটমটে গলা শুনে খটকা লাগলেও রেনু সহজে সব সামলে নেয়। খানিকটা আড়ষ্টতা অবশ্য কাজ করছে। আপাতত নিজের মনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে নিচতলার ফ্ল্যাটটা দেখছে। ভেবেছিল এদিক ওদিক ক্যানভাস রং তুলি ছড়িয়ে থাকবে। তেমনটা নেই। সব পরিপাটি। ফার্নিচার কিছু নেই। ড্রয়িং রুমের এক কোণে বসার মতো একটা মাদুর পাতা। ভেতরের রুমে উঁকি দিল। রোগা পাতলা একটা ছেলে। মাথায় পরিপাটি ছাঁটা চুল। পাখির বাসার মতো নয়। সেলুনে গিয়ে সময় নিয়ে কাটানো হয়েছে। ছবি আঁকছে না। তারপিন, অয়েল পেইন্টের কড়া গন্ধ বাড়ি দিয়ে গেল নাকে। সয়েও এলো।
‘জ্বি বলুন?’
‘আমার একটা পোর্ট্রেট করাতে চাই। আপনিই কি মিন্টু?’
ঝট করে ঘুরে তাকাল ছেলেটা। চেহারার সঙ্গে মিন্টু নামটা ঠিক যাচ্ছে না। দেয়ালে ঝোলানো কয়েকটা পেইন্টিং। নিচে গোটা গোটা অক্ষরে নাম লেখা ‘মিন্টু’। অন্যদের মতো পেঁচানো সাইন না। রেইনকোটটা খুলে আলগোছে মেঝেতে রেখে দিল রেনু। রেইনকোটের একটাই সমস্যা। যতই বৃষ্টিতে ভিজুক। ভেতরে উত্তাপ ছড়ায়। রেনু এসব হিজিবিজি ভাবছে। ভাবতে ভাল লাগছে। তবে খটকাটা কাটছে না। ছেলেটা কথার জবাব না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কাজ বলতে কাঠের একটা ফ্রেমে ক্যানভাস লাগাচ্ছে। হাতুড়ি পেরেকে ঠোকাঠুকি।
‘কী সাইজের করাবেন?’
‘রেনু এদিক ওদিক তাকাল। একটা প্লাস্টিকের চেয়ার আছে। তার ওপর শুকিয়ে যাওয়া রং। ঘরের এক কোণে একটা খাট আছে। স্ট্যান্ডওয়ালা লাইট আছে কিছু।
‘কই বলেন! সাইজ কত হবে? অয়েল না অ্যাক্রিলিক?’
মিন্টু রেনুর দিকে তাকাচ্ছে না। ভাব ধরার চেষ্টা করছে বলেও মনে হচ্ছে না। রেনুর মনে হলো সে পুরান ঢাকার কোনো এক গলিঘুপচিতে থাকা কোনো এক পুরনো স্বর্ণকারের দোকানে গেছে গয়নার অর্ডার দিতে। স্বর্ণকার গভীর মনযোগে গহনার কারুকাজে ব্যস্ত। কিন্তু কাঠের ফ্রেমে ক্যানভাস লাগানো এমন আহামরি কাজ না যে রেনুর মতো রূপবতীর দিকে তাকানো যাবে না।
‘সাইজ তো জানি না। তবে বড় হলে ভাল। দেয়ালে ঝোলাবো।’
‘ত্রিশ-ছত্রিশ সাইজ ক্যানভাস রেডি আছে। সিটিং দিতে পারবেন? নাকি ফটোগ্রাফ আছে।’
রেনুর ভেতরটা নিজের সঙ্গে বকবক করার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু নিজেকে এই মুহূর্তে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
‘আমি বসি? এই চেয়ারে বসলে হবে?’
‘আপনার যেখানে ইচ্ছা বসতে পারেন। কাপড় বদলাতে চাইলে পাশের রুম আছে। আর…।’
‘আমি ন্যুড করাতে চাই।’
‘ওকে। তাহলে তৈরি হন। আমি হাতের কাজ শেষ করি। চা খেলে খেতে পারেন। কোণার টেবিলে ফ্লাস্ক আছে। বেসিন থেকে কাপটা ধুয়ে নিয়েন।’
আবার শুরু হলো রেনুর মনের সঙ্গে কথোপকথন।
‘রেনু! বেটা খুব বড় শিল্পী হয়েছে তাই না? দেখিয়ে দে তো ওকে!’
‘দেখাবো, আরেকটু যাক না।’
‘কীসের অপেক্ষা! ওকে! আগে চা খাওয়া যাক। বাইরে অনেক বৃষ্টি। চা মন্দ হবে না। কী মনে হয়, মিন্টু আর্টিস্ট? ছুহ! এমন কত এলো গেলো।’
‘আমারো একই কথা। বেটা খুব ভাব নিচ্ছে। কাপড় খুলে বসে পড়লে ঠিকই মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমার যে ফিগার, তাতে আরো কিছু.. হিহিহি।’
নিজের সঙ্গে কথা শেষ। চায়ে চুমুক দিচ্ছে রেনু। দেয়ালে ঝোলানো মিন্টুর ছবিগুলো এর মধ্যে দেখা শেষ। সম্বিত ফিরল মিন্টুর কথায়।
‘ত্রিশ ছত্রিশের দাম পড়বে বিশ হাজার। টাকা এনেছেন?’
‘জ্বি আছে।’
রেনু খোঁজ নিয়েই এসেছে। মিন্টুর কাজের যে হাত, সে তুলনায় টাকাটা বেশি মনে হয়নি তার কাছে। উল্টো অনেক কম। তবে এখানে টাকা আর ছবি কোনোটাই মুখ্য নয় রেনুর কাছে। তার মাথায় ঘুরছে মিশন মিন্টু।
‘আমি তৈরি।’
কথাটা মনে মনে বলেছে রেনু। মিন্টুর শোনার কথা নয়। তবে সে একবার আড়চোখে তাকাল। তার হাতের কাজ শেষ।
‘কই রেডি হন। বিছানায় পোজ দিতে পারেন। যেভাবে খুশি।’
‘কতক্ষণ লাগবে?’
‘এক দুই ঘণ্টা লাগবে। ড্রয়িংটা আর টুকটাক লাইন টানা হয়ে গেলে পরে আর টাইম লাগবে না।’
রেনুর চা শেষের দিকে। এদিকে ইজেল, কালার পেলেট আর রঙের টিউব গোছাল মিন্টু। রেনু একদৃষ্টে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার জন্য মায়ার মতো একটা অনুভূতিও টের পেল। একটু পরেই আবার মনের হম্বিতম্বি করা অংশটা শাসিয়ে দিল, এসব মায়া টায়া চলবে না। ছেলের মাথায় সমস্যা আছে। বিরাট সমস্যা। সমস্যা দূর করার দায়িত্ব এখন তোমার।
রেনুর মনে হলো সে বাড়াবাড়ি রকম ভাবছে। ঘটনা আসলেই সিম্পল। তাকে এখন তরমুজ হতে হবে। তরমুজের কথা মনে হতেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে। তারচেয়ে বরং পাথর হওয়া যাক। রডিনের টরসো অব আদেলে’র মতো একখণ্ড আঁকাবাঁকা পাথর। রডিনের সেই মডেল আদেলে আবরুজেসির মনের ভেতরটা কেমন করতো? কী ভাবতো মেয়েটা?
রেনুর দিকে ভাল করে তাকাল মিন্টু। এতদিন অনেকেই তাকিয়েছে। মিন্টুর তাকানোটা আলাদা। রেনুর ত্বকের রং বোঝার চেষ্টা করছে। কাছে এসে উঁকি দিয়েও একবার দেখে নিল। মোটেও অস্বস্তি লাগল না রেনুর। ত্বকের সঙ্গে মিলিয়ে পেলেটে রং বানানোর পালা এবার। পোর্ট্রেট পিংক কিংবা হলুদ লাল আর টাইটানিয়াম হোয়াইট। সঙ্গে এক চিলতে বাদামি। একটু একটু করে সাদার পরিমাণ বাড়াতেও হবে।
জামার বোতাম খুলতে শুরু করেছে রেনু। তার নিজের মনে এরইমধ্যে শুরু হয়ে গেছে অদৃশ্য এক ছবি আঁকা। একদিকে শিল্পীর নির্লিপ্ত চাহনি, অন্যদিকে আদ্যিকালের এক প্যান্ডোরার বাকশো। অন্য সময়ের চেয়ে হয়তো এখন কাপড় খুলতে একটু বেশিই সময় নিয়েছে রেনু। তবে এই কাপড় ছাড়ানোটাকে মনে হলো ছবি আঁকারই একটা অংশ। পোর্ট্রেটের জন্য এভাবেই বুঝি নগ্ন হতে হয়। বিথি থাকলে বলতো এটাও একটা আর্টরে বোকা! রান্তার যৌনকর্মীর কাপড় খোলা আর শিল্পীর মডেল হিসেবে খোলায় বিস্তর ফারাক। হলিউডের মুভিতে দেখিস না! সম্ভবত কথাটা বানিয়েই বলতো বিথি। তবু সেটা বিশ্বাস করতো রেনু। অনেক সময় স্রেফ বিশ্বাস করতে হবে বলেই বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বানায় তার মন।
রেনু পুরোপুরি তৈরি। চেয়ারটা পাশ কাটিয়ে বিছানাতেই গেল। প্রথমে অচেনা কোনো এক আকর্ষণে উপুড় হয়েই শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল। মনের কথাবলা অংশগুলো সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিল। এ পাশ ও পাশ করে ধাতস্থ হলো খানিকটা। চিৎ হয়ে আবার পাশ ফিরলো। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল জানালার দিকে। এক চিলতে আলো আসছে ওদিক দিয়ে। কোনো একদিকে একটা লাইট জ্বালালো মিন্টু। আলো এসে পড়ছে রেনুর গায়ের এক পাশে।
খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছে মিন্টু। চোখজোড়া রেনুর শরীরে আর হাতের পেনসিলটা চলতে শুরু করেছে ক্যানভাসে, তরতর করে।
‘কী এত আঁকছে ছেলেটা?’
‘কী জানি! যা খুশি আঁকুক। আমি তো এসেছি ওকে বাজিয়ে দেখতে। দেখাই যাক না কতক্ষণ পারে নিজেকে আটকে রাখতে!’
‘আচ্ছা, ও কি আদৌ নিজেকে আটকে রাখতে চাইছে? নাকি আমিও তার কাছে স্রেফ তরমুজের মতো, অথবা পুরনো মোজা?’
‘মোটেই না! আমার মতোন কজন সুন্দরী এসে এভাবে কাপড় খুলবে তার সামনে? আমার ক্ষমতার কাছে পিকাসোও তুচ্ছ!’
এসব ভাবতে ভাবতে বদলে যাচ্ছে রেনুর শোয়ার ভঙ্গি। আর্টিস্টের মডেল হতে যে স্থির হয়ে থাকতে হয়, ব্যাপারটা মাথায় নেই। পা-দোলাচ্ছে উপুড় হয়ে। এপাশ ওপাশও করছে। মিন্টু নির্বিকার। সে তাকিয়ে আছে। রেনুর মনে হলো মিন্টু স্রেফ তাকিয়ে থাকতে হয় বলেই তাকিয়ে আছে। মিন্টু আসলে তাকে দেখছে না। মিন্টুর চোখের ফোকাস ফ্ল্যাটের দেয়াল ভেদ করে আরো অনেক দূরে। রেনু মনের অনেকগুলো জানালা একে খুলে যেতে লাগল। জানালাগুলো থেকে হড়বড় করে আরো অনেকগুলো রেনু কথা বলতে চাইছে। রেনু সবাইকে চুপ করিয়ে দিল। মনের মুখের কপাট লাগিয়ে দিল ঝপ করে। শরীরটাকেই কথা বলতে দিল তার সহজাত ভাষায়। ধীরে ধীরে নিজেকে সিংহী ভাবতে শুরু করে দিল রেনু। চুলগুলো ছড়িয়ে দিল পিঠে। সিংহের মতো আকাশে তাকাল। এভাবেই বসে থাকল অনেকক্ষণ। নীরব শরীরী আহ্বান জানাচ্ছে কাউকে। কিন্তু আহ্বানে কাজ হবে না জানে সে। অদ্ভুত এক হাহাকার জেগে উঠল তার শরীরজুড়ে। সে চায় মিন্টু আসুক, তার শরীরেই রং মেখে তাকে এঁকে দিক। আবার চায়, না, এভাবেই চলুক। মিন্টু ব্যস্ত থাকুক তার হাইলাইট আর শ্যাডো নিয়ে। রেনু সিংহীর মতো পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে দেখুক সূর্যাস্ত।
শেষ হলো ছবি। গায়ে কাপড় না থাকলে রেনুর নিজেকে এখন আর নগ্ন মনে হচ্ছে না। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে এসে দেখতে চাইল ছবিটা। মিন্টু ইজেল থেকে ক্যানভাস খুলল যতœ করে।
‘শুকাতে হবে ছবিটা। এখন না, পরে নেন। টাকাটা দিয়ে যান। পড়শু এসে ছবি নিয়ে যাবেন।’
রেনু অবাক হলো। ভীষণ অবাক। আচমকা একটা অপ্রত্যাশিত চড় খেলো যেন। ক্যানভাসের মেয়েটা সে-ই। সন্দেহ নেই। মুখটা একদম হুবহু তারই। বাহু, ডান স্তনের পাশের ছোট্ট তিল থেকে শুরু করে কোনো ডিটেইলসই বাদ পড়েনি। কিন্তু বিছানায় এলোচুল ছড়িয়ে একরাশ উš§ত্ততায় জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলো দেখছে ছবির মেয়েটা। রেনুর হিংসে হচ্ছে খুব। এভাবে তো ও পোজ দেয়নি! মিন্টু এটা নিজের মতো করে এঁকেছে। ছবির রেনুর অভিব্যক্তিতে যে কামোত্তেজনা ছিটকে বের হচ্ছে সেটা যেন একটা প্রকাণ্ড ঝড়। ছবিটার দিকে চোখে যতবারই চোখ পড়ছে, শিহরণ খেলে যাচ্ছে রেনুর প্রতিটি নিউরনে। রেনু জানে, এ ছবিতে যে ঝড় শুরু হয়েছে সেটা কোনোদিনও থামবে না।