চলন বিল—বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলাভূমি, যা তার অপার সৌন্দর্যের পাশাপাশি লুকিয়ে রেখেছে অজানা আতঙ্ক।
প্রাচীনকাল থেকে এই বিস্তৃত জলাভূমি শুধু প্রকৃতিপ্রেমীদের আকর্ষণ করেনি, বরং ঘিরে রেখেছে অদ্ভুত সব গল্প। এই বিল যেন রহস্যের এক বিশাল পাতা, যেখানে প্রতিটি ঢেউ আর প্রতিটি বাতাস মিশে থাকে ভয়ঙ্কর ইতিহাসের ছোঁয়ায়।
বর্ষাকালে চলন বিল তার ভয়াল রূপ ধারণ করে। গভীর রাতে যখন সবকিছু নিস্তব্ধ, হঠাৎই বিলে দেখা যায় নাচতে থাকা অদ্ভুত আলো। এই আলো কখনো নদীর এক প্রান্তে, কখনো আরেক প্রান্তে ঝলসে ওঠে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এটি বিলের পানিতে ডুবে মা**রা যাওয়া মানুষদের আত্মার সংকেত।
এক জেলে, আবদুল হাকিম, একবার এই আলো অনুসরণ করতে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। পরদিন সকালে তার নৌকা পাওয়া যায়, কিন্তু তার শরীরের কোনো চিহ্ন মেলে না। জেলেদের মধ্যে বিশ্বাস রয়েছে, যে এই আলো অনুসরণ করে, তাকে বিলের গভীর অন্ধকার টেনে নিয়ে যায়।
চলন বিলের গভীর থেকে মাঝেমধ্যে ভেসে আসে সঙ্গীতের সুর। এটি কোনো সাধারণ সঙ্গীত নয়। জেলেদের ভাষায়, এটি এতটাই মোহনীয় যে, যারা এটি শোনে, তারা যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সব কাজ ফেলে দিয়ে শুধু শুনতে থাকে। কিন্তু এর পরিণতি হয় ভয়াবহ।
২০২০ সালে, শওকত নামে এক জেলে রাতের সঙ্গীত শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সকালে তার সঙ্গীরা তাকে পানিতে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে। ফিরে এসে শওকত বলেছিলেন, “আমি দেখতে পেয়েছিলাম সাদা কাপড়ে ঢাকা অদ্ভুত মূর্তিকে। তারা গাইছিল, আর আমাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাকছিল।” কয়েকদিন পর শওকত নিখোঁজ হন, এবং তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়দের মতে, গভীর রাতে বিলের পাশে বসলে মাঝেমধ্যে পানির নিচ থেকে হাসি-কান্নার মিশ্রিত আওয়াজ আসে। কেউ কেউ বলেছে, তারা পানির নিচে অস্পষ্ট আলো দেখেছে, যেন সেখানে একটা নগরী এখনো জীবিত। কিছু সাহসী মানুষ সেখানে গিয়ে ফিরে এসে দাবি করেছে, তারা পানির নিচে প্রাসাদের মতো কাঠামো দেখেছে। তবে তাদের শরীরে ভয়াবহ ক্ষত ছিল, আর তারা বেশিদিন বাঁচেনি।
চলনবিল একসময় জলদস্যুদের আস্তানা ছিল। জনশ্রুতি আছে, বিলের গভীরে তারা তাদের ধনসম্পদ লুকিয়ে রেখেছিল। তবে সেই ধন পাহারা দেয় অদৃশ্য শক্তি। যারা সেই ধন খুঁজতে যায়, তারা কখনো ফিরে আসে না।
১৯৮৭ সালে, কিছু অনুসন্ধানকারী বিলের গভীর অংশে ডুব দিয়ে একটি বিশাল সিন্দুকের দেখা পেয়েছিল। কিন্তু সেই সিন্দুক স্পর্শ করার পরই তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তারা জানায়, সিন্দুকের কাছাকাছি গিয়েই তারা এক প্রচণ্ড শীতলতার অনুভূতি পায় এবং অস্পষ্ট ছায়ামূর্তির হাত তাদের চারপাশে ঘিরে ধরে।
চলন বিলের আশেপাশের গ্রামগুলোতে এমন অনেক গল্প শোনা যায়, যেখানে রাতের বিলে যাওয়া মানুষ আর ফিরে আসেনি। তাদের নিখোঁজ হওয়ার কারণ আজও অজানা। কেউ কেউ দাবি করে, তারা রাতে বিলের পানির ওপর দিয়ে চলতে থাকা ছায়ামূর্তি দেখেছে। তাদের শরীর মানুষের মতো হলেও, মুখ ছিল অস্পষ্ট এবং বিকৃত।
এক কৃষক একবার রাতের বিলে হেঁটে যাওয়ার সময় শুনেছিলেন তার পেছনে কারো পায়ের আওয়াজ। তিনি ফিরে তাকালে দেখেন, একটি বিকৃত মুখওয়ালা ছায়া তাকে দেখছে। আতঙ্কে তিনি দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসেন, কিন্তু পরদিন সকালে তাকে তার খাটে মৃ**ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
চলন বিল কোনো সাধারণ জলাভূমি নয়। এটি এক রহস্যময় স্থান, যা তার বুকে ধারণ করে আছে ভয়, আতঙ্ক এবং অজানা শক্তি। গভীর রাতে এখানে গেলে কে জানে, আপনি কি ফিরে আসতে পারবেন? কিংবা হয়তো আপনার গল্পও হারিয়ে যাবে চলন বিলের অন্ধকারের গভীরে।
রাতের অন্ধকারে, বিল শুধু সুন্দর নয়, বরং এক বিভীষিকাময় ফাঁদ।