class="post-template-default single single-post postid-10581 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

এ প্রথা বিলুপ্ত হোক : তসলিমা নাসরিনের কলাম

তসলিমা নাসরিনপৃথিবীতে ৩০টি দেশের ৩০ কোটি মেয়ে যোনিচ্ছেদের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে। ৩০টি দেশের ২৭টি দেশই আফ্রিকার দেশ, সোমালিয়া, জিবুতি, মিসর, সিয়েরা লিওন, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া এরকম আরও অনেক। বাকি দেশগুলোর মধ্যে আছে ইন্দোনেশিয়া, কুর্দিস্থান, ইয়েমেন, ভারত, পাকিস্তান। হ্যাঁ, ভারত এবং পাকিস্তান। তবে ভারত আর পাকিস্তানের সব মুসলমানের মধ্যে যোনিচ্ছেদ প্রথা নেই, আছে দাউদি বহরা মুসলমানদের মধ্যে। এদের পূর্ব পুরুষেরা কোনও এককালে ইয়েমেন থেকে এই উপমহাদেশে পাড়ি দিয়েছিল, অথবা তারও আগে গুজরাটের কেউ কেউ মিসরে গিয়ে শিখে এসেছিল শিয়া সম্প্রদায়ের ইসমাইলি গোষ্ঠীর সংস্কৃতি। শুধু উপমহাদেশেই নয় এশিয়ার অনেক দেশেই, এমনকী ইউরোপ আমেরিকার অভিবাসীদের মধ্যে লুকিয়ে চুরিয়ে এই প্রথাটি মানা হয়। প্রথাটি ঠিক কী? প্রথাটি হলো, শৈশবে বা কৈশোরে মেয়েদের যোনির কিছু অংশ কেটে ফেলে দেওয়া হয়। যৌনাঙ্গ কর্তনের মূল উদ্দেশ্য হলো, যৌন সঙ্গমের কোনও সুখ যেন মেয়েরা না পায়। যে সব স্নায়ু যৌন অনুভূতি জাগায়, যৌন সঙ্গমের ইচ্ছে জাগায়, সে সব স্নায়ু কেটে ফেলে অকেজো করে দেওয়া হয়। ভগাংকুর নামে একটি ছোট্ট অঙ্গ, যেটি যৌনাঙ্গের ওপরের দিকে থাকে, যেটির কাজ যৌন-সুখ দেওয়া, সেটি তো কাটা হয়ই, যৌনাঙ্গের বৃহদোষ্ঠ এবং ক্ষুদ্রোষ্ঠও কেটে ফেলে দেওয়া হয়। কারও কারও তো আবার যৌনাঙ্গের দরজা সেলাই করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব করার কারণ, যে পুরুষেরা এই মেয়েদের বিয়ে করবে, তারা যেন অনাঘ্রাতা মেয়ের স্বাদ পায়। পুরুষের ভোগ যেন অত্যন্ত উপাদেয় হয়। যেন তাদের প্রচন্ড সুখ হয় যৌন সঙ্গমে। কুমারী মেয়ের লোভ পুরুষের মধ্যে ভয়ানক। কী যুবক, কী বৃদ্ধ, কী অবিবাহিত, কী বিবাহিত সব পুরুষই কুমারী মেয়ে ভোগ করতে চায়। যে করেই হোক, এমন যৌনাঙ্গ চায়, যে যৌনাঙ্গ অন্য কোনও পুরুষ স্পর্শ করেনি। যৌনাঙ্গেই, তাদের বিশ্বাস, সর্বসুখ। এ কারণেই পুরুষাঙ্গকে আরাম দিতে অধিকাংশ পুরুষই অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চায়, এ কারণেই পুরুষেরা অল্প বয়সী মেয়েদের শুধু নয়, মেয়ে শিশুদেরও ধর্ষণ করতে পিছপা হয় না। পুরুষের এই কামনার কারণেই দেশে দেশে মেয়েদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, স্বাভাবিক যৌনতার অধিকার থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। মেয়েরা অবর্ণনীয় যন্ত্রণা নিয়ে জীবনযাপন করছে, শুধু শারীরিক ক্ষতি নয়, অপূরণীয় মানসিক ক্ষতিও হচ্ছে তাদের।

পুরুষেরা কেন নারীর প্রাপ্য অধিকারের চেয়ে নিজের  আরামকে অধিক মূল্যবান বলে মনে করে? মনে করে কারণ জম্মে র পর থেকেই তাদের এই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, পুরুষাঙ্গের চেয়ে মহান এবং মূল্যবান কোনও অঙ্গ নেই। এই বিশ্বাস সমাজের এত গভীরে প্রবেশ করে বসে আছে যে, সমাজের প্রতিটি প্রাণীই পুত্র সন্তান কামনা করে, কন্যা সন্তান নয়। কেউ কেউ কন্যা সন্তান চায় বটে, যথেষ্ট পরিমাণে পুত্র সন্তানের জম্ম হওয়ার পরই চায়। পুরুষাঙ্গের অনুপস্থিতিই মানুষকে হিজড়ে, নপুংসক, খোঁজা, নারী ইত্যাদি বানায়। পুরুষাঙ্গের উপস্থিতি সমাজে যতটুকু সম্মান আনে, ততটুকুই অসম্মান আনে এর অনুপস্থিতি। মেয়েদের যৌনাঙ্গ কেটে বাদ দেওয়ার পেছনে কাজ করে এই যৌনাঙ্গের প্রতি মানুষের তীব্র ঘৃণা, এই তীব্র ঘৃণা সম্ভব হতো না, যদি মেয়েদের প্রতি তীব্র ঘৃণা না থাকত। নারীকে ঘৃণা করার রীতি বহু পুরনো। পুরনো বলেই, এই ঘৃণা দেখে দেখে মানুষ অভ্যস্ত বলেই, এই ঘৃণাকে ঘৃণা বলে মনে হয় না। নারীকে তাই ঘরবন্দি করা, নারীকে পরনির্ভর করা, নিয়ন্ত্রণ করা, নারীর শরীর আবৃত করার ব্যবস্থা করা, ঋতুস্রাবের সময় নারীকে অপবিত্র ঘোষণা করা, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর দৃশ্যকে অশ্লীল বলে আখ্যা দেওয়া, হিজাবে বা বোরখায় চুল বুক না ঢাকলে নারীকে অশালীন বলা, নারী নিজের স্বাধীনতা ভোগ করতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে জঘন্য মেয়েমানুষ বলে ভেবে নেওয়া… এইসবকে তাই অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হয়। নারীর যৌনাঙ্গকে নষ্ট বলা হয়, নোংরা বলা হয়। নারীর যৌনাঙ্গের তথা কথিত ‘দুর্গন্ধ’ দূর করতে প্রসাধন কোম্পানি যত ওষুধ বের করেছে বাজারে, তত কি পুরুষাঙ্গের দুর্গন্ধ দূর করতে বের করেছে? মোটেই না। মেয়েরা তাদের শিশু অবস্থা থেকে শুরু করে সারা জীবনই পুরুষের অবিশ্বাসের শিকার হচ্ছে। অবিশ্বাস আছে বলেই যৌনাঙ্গ কর্তনের প্রথা আছে। সে কারণেই যৌনাঙ্গ কর্তনের প্রথার বিরুদ্ধে শিক্ষিত সভ্য মানুষেরা আন্দোলন কিছুতেই সফল হচ্ছে না।

এই প্রথাটি পালন করার জন্য আল্ল­াহতায়ালা মুসলমানদের বলেননি, কোরআন হাদিসের কোথাও উল্লে­খ নেই যে মুসলমানদের এই প্রথাটি মেনে চলতে হবে। তারপরও, বড়ই তাজ্জবের ব্যাপার যে, যারা এই প্রথাটি মেনে চলে, তারা মূলত মুসলমান। ভারতের বহরা মুসলমান নারীরা কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছেন এই প্রথাকে নিষিদ্ধ করার অনুরোধ নিয়ে। এর চেয়ে চমৎকার খবর আর কী হতে পারে যে নারীবিরোধী এক জঘন্য প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে নারীরাই। যদিও আমি মনে করি, নারীর সমানাধিকারে যে পুরুষেরা বিশ্বাস করে, তাদের উচিত এইসব পুরুষতান্ত্রিক প্রথাগুলোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু অসহায় নারীকেই শত সহস্র বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হয়ে পুরুষ রচিত প্রথা ভাঙার জন্য কান্নাকাটি চিৎকার করতে হয়। পুরুষেরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ভাবেন, এ নারীর সমস্যা, নারীর সমস্যা নারীকেই দূর করতে হবে। যে সমাজে নারীর যোনিচ্ছেদের প্রথা চালু, সেই সমাজের পুরুষেরা যোনিকর্তন হয়নি এমন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করতে বা এমন মেয়েকে বিয়ে করতে নারাজ। নারাজ বলেই যৌনাঙ্গ কেটে নারীকে পঙ্গু বানানো হয়। এভাবেই নারীকে বিয়ের উপযুক্ত করা হয়।

যোনি কর্তন না করলে যৌন সংগমের সুখ জেনে ফেলবে নারী, পুরুষদের খুঁজবে নিজের সুখের জন্য। নারীর ওপর পুরুষের মালিকানা নষ্ট হবে, নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হবে। এ কোনও পুরুষই চায় না। পুরুষের চাহিদা অনুযায়ী নারীকে প্রস্তুত করা হয়। পুরুষের পতিতা চায় বলে নারীকে পতিতা বানানো হয়, পুরুষ সতী সাধ্বী নারী চায় বলে নারীকে সতী সাধ্বী নারী বানানো হয়। পুরুষ চায় যৌনতা শুধু পুরুষের হোক, নারীর না হোক। তাই নারীর ভগাংকুর কেটে ফেলার ব্যবস্থা পুরুষ করেছে।

নারীবিরোধী সব প্রথাই মূলত পুরুষের স্বার্থে বানানো। যে কোনও জাতিবিদ্বেষের, যুদ্ধের, হিংসের ঘটনা ঘটলে বিবেকবান মানুষ যেমন পথে নামে প্ল্যাকার্ড নিয়ে, প্লø্যাকার্ডে লেখা থাকে ‘নট ইন মাই নেম’, তার মানে আমার ভালো হবে এই ছুতো দেখিয়ে যুদ্ধ করছো, মানুষ মারছো, মানুষকে ঘৃণা করছো, না, আমার নাম আর ব্যবহার করবে না, আমি তোমার কার্যকলাপে সায় দিচ্ছি না। বিবেকবান পুরুষেরা তাদের স্বার্থে তৈরি নারীবিরোধী প্রথাগুলোকে সমাজ থেকে দূর করার জন্য এভাবে তো উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু নেয় না।

বাংলাদেশের মেয়েরা পুরুষতন্ত্র আর নানা রকম নারীবিরোধী কুসংস্কারের শিকার হলেও এই ভয়ঙ্কর যোনিচ্ছেদ প্রথার শিকার আজও হয়নি। সারা পৃথিবীতে আজ মেয়েদের যোনিচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে, এর ফলে অনেক দেশই যোনিচ্ছেদ প্রথার বিরুদ্ধে আইন তৈরি করেছে। পিছিয়ে থাকা আফ্রিকার দেশগুলোতেও এই জঘন্য প্রথার বিরুদ্ধে আইন আছে। কী কারণে ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে দাবি করা একটি দেশ যোনিচ্ছেদ প্রথার মতো একটি বর্বর প্রথাকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে তা আমার বোধগম্য হয় না। নারী বিরোধী অনেক প্রথাই তো বিদেয় হয়েছে। ধর্মের বইয়ে লেখা নেই এই প্রথার পক্ষে কোনও বাক্য। যদি লেখা থাকতোও, তা হলেও মানুষের অধিকারের পক্ষেই মানুষকে শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতেই হতো। যৌনতার অধিকার মানবাধিকারের অংশ। সে অধিকার পুরুষের থাকবে, নারীর থাকবে নাÑ এমন যারা বলে, তাদের চিহ্নিত করা হোক।      লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!