মাচায় শুয়ে আকাশ দেখতে গিয়ে নুরুল আফসারের মনে হয় তার মাথার ওপর যে বিস্তৃর্ণ আকাশ, তেমনি ওই আকাশের সাপেক্ষে সে-ও আছে অনেক উপরে। সে চাইলেই দূরের নক্ষত্রে যেতে পারছে না, নক্ষত্ররাও তার কাছে আসতে পারছে না।
আকাশে মেঘ। মেঘ যখন ছিল না তখন লালচে কূপির মতো বহুকাল আগের কোনো এক তারায় আটকে ছিল নুরুলের দৃষ্টি। মেঘ জমতেই একটা অদৃশ্য চাদর প্রবল বেগে মোচড় খেয়ে ঘিরে ধরে নুরুলকে। অর্থাৎ নুরুল তার কল্পনার আলো-আঁধারি জগতে ঢুকে পড়তে চলেছে। কল্পনার বিষয়টা তার কাছে গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যকার টানাটানির মতো। গভীরে কী ঘটে জানে না। তবে অস্বীকার করার জো নেই।
নুরুল আফসার আপাত-অদৃশ্য সেই চাদরে ডুব দিয়ে নিজের বলয়ে ঢুকে পড়ে। নিজের এই জগতে নুরুল অন্য মানব। ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে না। বৃষ্টি হয় তাল-লয় মেনে। ঘড়ির কাঁটা ঘোরে কল্পনাকারীর মর্জিমাফিক।
বাইরে ঝড়ের বাতিক। শীতে কেঁপে ওঠে নুরুল। আজ মগজের কুঠুরিতে বাস করা প্রেমিকা রৌশনারাকে বললে কি একটা সত্যিকারের চাদর নিয়ে আসবে? সে কল্পনায় যা চাইবে তাই করবে রৌশনারা। এ কারণেই তো সে কল্পনা। কল্পনায় নুরুল কখনও প্রেমিকপুরুষ, কখনও একচ্ছত্র ক্ষমতার ভয়ানক অত্যাচারী কেউ।
নুরুল আফসার জানে তার কল্পনাশক্তি নিম্নপর্যায়ের। মনে মনে সে তার কল্পনার নারীর একটা চেহারা দিতে পারেনি। কোমল তাপহীন প্রদীপের মতো দপ দপ জ্বলে নেভে। পরিচিত দুয়েকটা মুখ উঁকি দিয়ে শেষে পুরনো দিনের কম চেনা কোনো নায়িকার চেহারা জুড়ে বসে। বয়সের দিগবিদিক নাই। ওঠানামা করে পঁচিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে। আজ রৌশনারা তো গত রাতে নয়নতারা। কল্পনার প্রেমিকার নাম-চেহারা যখন তখন বদলানোর ক্ষমতা রাখে নুরুল। কল্পনার প্রেমিকা প্রতিবাদ করে না। খেলা যায় যেমন খুশি তেমন সাজাও।
‘রৌশনারা।’
‘আমপোড়া শরবত বানাই। আরাম পাইবেন।’
নুরুল কল্পনায় শরবত শেষ করতে পারে না। চুমুক দিতে গিয়ে বুঝতে পারে, বহুক্ষণ আগে তৃষ্ণা পেয়েছিল তার। শরবতে দেওয়া অচেনা খনিজ লবণের স্বাদটাও পেল না।
বাড়ির পেছনে উঠোন তেমন নেই। চিকন একটা পথ। জংলার ওপাশে খাল। খালপাড়ে মাচা। তাতে মমির মতো মিশে আছে একটা পাটি। খটখটে বিছানায় শুয়ে থাকা নুরুলের সঙ্গে রৌশনারার খুনসুটি বেশিদূর এগোয় না।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে মুখে। শোঁ শোঁ শব্দে দলা পাকানো বাতাসের সঙ্গে সায় দেয় দেবদারু আর নারকেল গাছগুলো। নির্লিপ্ত কলতলার পাকুর। রৌশনারা ভিজলে ভিজুক। কল্পনার নারীর জ্বর-কাশি হয় না।
‘তুমি ভেতরে যাও। খিচুড়ি রান্না হইসে। খাইয়া লও। আমি একটু ভিজবো।’
‘তুমি ভিতরে যাবা না দিলরুবা?’
‘না। আমার ইচ্ছা।’
‘তুমি ভিজবা কেন জবা?’
‘আমার ইচ্ছা।’
‘না, ভিজবা না। ভিজলে তোমার অসুখ হইব বেহুলা।’
‘আমার ইচ্ছা।’
‘রুবা এদিকে আসো। ভেতরে চলো।’
‘আমার ইচ্ছা।’
‘আসতে বলতেসি। কাজ আছে। কাঁথায় ওম বানাইয়া রাখব। ঝড় আসবে ঝড়।’
‘আমার ইচ্ছা।’
‘আসবা না?’
‘আমার ইচ্ছা।’
আজ নুরুলের কল্পনার ধার ধারল না রৌশনারা কিংবা দিলরুবা বা অন্য কেউ। খালের ওপর চিকন সাঁকো আছে। সেটা পার হলে চিকন একফালি পথ। ঘাস, কলমি আর পড়ে থাকা জবা ফুল মাড়িয়ে ওই পথে দিলরুবা হেঁটে গেল। এরপর ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েই রইল।
পথের শেষ প্রান্তে ঝোপঝাড় পেরুলে ছোট ধানিজমি। দুয়েকটা বাড়ির সীমানা ঘেঁষে যে চিকন রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে, সেখানে কিছু বসতবাড়ি। এ পথে লোকের আনাগোনা কম।
ক্ষণে ক্ষণে বজ্রপাত হলে এক প্রকারের আলো লেপ্টে থাকে দৃষ্টিতে। তাতে স্পষ্ট ফুটে আছে দিলরুবার অবয়ব। তাকিয়ে আছে নুরুল। টের পেল তার কল্পনার ক্ষমতা বেড়েছে। সেই জোরে কল্পনার মানবী হাতছাড়া হয়েছে অনেকটা। দিলরুবাকে আজ কী শাস্তি দেওয়া যায়? ভাবতে গিয়ে মনে হলো জ¦র এসেছে। মনে হলো দিলরুবা বা রৌশনারা এখন আর মগজে বাস করছে না। আলগোছে মাথা থেকে বের হয়ে দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে অন্ধকারে।
‘কিডারে! খাড়াইয়া আছে কিডা!’
দূর থেকে সজল দাশের গলা চিনতে পারল নুরু। ইতস্তত নড়তে দেখল দিলরুবাকে।
‘দেইখা ফালাইসে নাকি!’
কল্পনার মানবীকে কোথায় লুকাবে ভেবে বিচলিত হয় নুরুল। কল্পনা বন্ধ করলেই হয়। সেটা চাইলেও আজ হচ্ছে না।
নুরুলের কল্পনার দিলরুবা কিংবা রৌশনারাকে সজল দাশ দেখবে কেন?
দিলরুবার বিকার নাই। বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে ওপাশের রাস্তা ধরে দ্রুত হেঁটে যাওয়া সজল দাশের দিকে।
‘এইডা কিডা! থুহ! রনির মা! দেইখা যাওতো, নুরুলের বাড়িতে এইডা কিডা!’
নুরুল দুচোখ বুঁজে সারা শরীর কাঁপিয়ে চেষ্টা চালাল দিলরুবাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসে। কল্পনা করলো, ঘরের ভেতর আবার সেই আমপোড়া শরবত বানাচ্ছে দিলরুবা বা রৌশনারা কিংবা মনোয়ারা বা নামটা যা-ই হোক। সজল দাশ বা তার স্ত্রীর চোখে ধরা না পড়লেই হয়।
‘তুফান আসতেসে।’
‘কীসের তুফান। তুমি জলদি যাও ভিতরে রৌশনারা। দেইখা ফালাইব।’
‘আইজ কালবৈশাখী। আমার লগে চলো। তুফান তুফান খেলব। প্রেমের তুফান।’
নুরুলের মাথায় লেখা দিলরুবার কথাগুলোকে মনে হচ্ছে অনেক দিন আগের কথা। পুরনো শব্দরা ঝড়ের বাতাসে ভর করে ভেসে আসছে দূরের আকাশ থেকে। কল্পনা আর বাস্তবের মাঝে প্রতিসাম্যতা ঠিক করতে গিয়ে নুরুল বলে ফেরে, ‘আস্তে কও। লোকজন শুনবো।’
‘আমি তোমার কল্পনা। নুরু.. নুরু.. নুরু।’
‘রৌশনারা ওই দিনের মতো আবার মারধর করবো?’
কল্পনার মানবী ঘাড় ঘুরিয়ে বিষণ্ন চোখে নুরুলকে দেখে। নুরুলের চোখে চোখ পড়লেও সেই দৃষ্টি যেন ওই নক্ষত্র ছাপিয়ে বহুদূরে ঠেকে। আচমকা খা খা শব্দে হাসল দিলরুবা। অশরীরি এ হাসি মিশে গেল ঝোড়ো বাতাসে। দূরে একদল সারস ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। খা খা.. শাঁ শাঁ।
নুরুল আফসার মাচা থেকে নেমে গেল বাড়ির পেছনের দরজা লক্ষ্য করে। সিমেন্টের বাঁধানো জলাধারের পাশে মোটাসোটা বাঁশ পোঁতা। কল্পনার দড়ি ধরে কষে টান দিতে সেই বাঁশে মাথা ঠুকে দিল নুরুল। ব্যথা পেল না। তবে কাজ হলো। ছুটে এলো দিলরুবা। আর কারও চোখে ধরা পড়ার ভয় নেই আপাতত। দিলরুবা এসে জড়িয়ে ধরতেই নুরুল শিহরিত হয়, একরাশ আতঙ্কে! ভেজা শাড়ি ভেদ করে দিলরুবার শরীরের ভাপ পাচ্ছে সে।
‘ছাড়! ছাড়!’
দিলরুবা আরও জোরে আঁকড়ে ধরে।
‘কে তুই! ছাড়! ধরবি না খবরদার!’
‘আমি তোমার কল্পনা। দিলরুবা, রৌশনারা, জবা।’
‘না! না! তুই অন্য কিছু। তুই মানুষ না! তুই খারাপ কিছু!’
‘তুমি যেমন চাইসো, আমি তেমন। দেখো। দেখো আমারে নুরু।’
যথারীতি আলো-আঁধারি কল্পনায় হারিয়ে যায় কথাগুলো। কথাগুলোর কয়েকটি শব্দ কি দিলরুবার মুখ দিয়েই বের হলো? আর বাকিটা নুরুলের মাথার ভেতর।
ঘরের ভেতর পা রেখে ধাতস্ত হতে পারে না নুরুল। এমনটা আগে হয়নি কোনোদিন। দিলরুবার নরম শরীরের স্পর্শ যে এতটা ভয়ানক ঠেকবে কে জানতো!
দিলরুবার কথায় মন দেবে না ঠিক করে নুরুল আফসার।
‘দেখবা না আমারে? আমি যাই?’
‘যা! যা তুই! যাহ!’
নুরুল শব্দ করে কথা বলছে। কল্পনার মানুষের সঙ্গে মনে মনে বললেই হতো। এখন পারছে না। এখন সে কোনোভাবে জানে যে, মনে মনে বলা কথা দিলরুবার কানে যাবে না।
কল্পনায় অনেক কথা সহজে বলা যায়। মুখে শব্দ করে বলতে গিয়ে নুরুলের মনে হলো সে কিছুই বলতে পারবে না। অথচ মনে মনে এই দিলরুবা কিংবা মালতীকে সে ইনিয়ে বিনিয়ে কত আহ্লাদীমাখা কথা বলেছে।
‘আমি আসছি নুরু। আমি সত্যি সত্যি আসছি। কাছে আসো! মাধবীর কাছে আসো। আমি তোমার মায়াবতী জবা।’
নুরুল আফসার বুঝল, কল্পনায় নুরুল যেভাবে চাইত সেভাবেই কথা বলছে মাধবী কিংবা জবা কিংবা দিলরুবা। কণ্ঠে আহ্লাদ আর মাতাল প্রেম। কিন্তু শব্দগুলো বড্ড বেশি সত্যি হয়ে আজ কানে বাধছে। কল্পনার গণ্ডিতে আটকে থাকতে চাইছে না। ক্রমশ একটা সুতো যেন কেটে যাচ্ছে।
দিলরুবার গা থেকে আসা পুরনো সোঁদা ঘ্রাণেও বিভ্রান্ত নুরুল আফসার। ঘ্রাণের আবার নতুন-পুরান কী। প্রশ্নটার ব্যাখ্যাও এলো। দিলরুবা অনেক আগের কল্পমানবী। কত যুগ ধরে নুরুর মাথার কুঠুরিতে তার বাস। কল্পনার মানুষ কিছু খায় না, গায়ে গতরেও বাড়ে না। শুধু পুরনো হয়। পুরনো ঝুলপড়া গন্ধ ছড়ায়।
মধ্যরাতের আগে। দরজায় শব্দ। রুবা দাঁড়িয়ে। নুরুলের দিকে তাকিয়ে নেই। নুরুল দরজাটা লাগিয়ে ছুটে যায় বাড়ির পেছনে। ঘুটঘুটে আঁধারে মাচা লক্ষ্য করে ছুটতে গিয়ে আচমকা তার মনে হয় সে ঘরের বাইরে যায়নি, দরজাও লাগায়নি।
গাছের ডালে ডালে তাণ্ডব। থেমে থেমে বজ্রপাত। চক্রের ভেতর আটকে গেছে ঝড়। নুরুলের কল্পনা আর প্রতিকল্পনার মাঝে লড়াই চলছে বেশুমার।
ঘরে ঢুকে লাশের মতো নির্বিকার হেঁটে পেছনের ঘরে যেতে গিয়ে থমকে গেল দিলরুবা বা হাসনাহেনা। নুরুল হয়তো কল্পনা করেছিল যে কল্পমানবী তার জন্য চা বানাবে। অথচ তা ঘটেনি। আকাশের অন্ধকার অঞ্চলের মতো নির্বিকার বিভ্রান্তি নিয়ে কল্পনার মানবী দাঁড়িয়ে আছে একটি জানালার পাশে। মানবীর ধূসর পাথুরে দৃষ্টি কোথাও আটকে নেই। মৃত মাছের মতো নিষ্পলক দৃষ্টি অজানা অন্ধকারে।
নুরুল আফসার তার মোচড় খাওয়া মগজটা নিয়ে ত্রস্ত পায়ে বসে বিছানার ওপর। টের পেল, এক অ-জাগতিক ভয়ে আচ্ছন্ন তার মগজের প্রতিটি কোষ। কল্পনা এতটা স্পৃশ্য হবে এমনটাও কি সে কল্পনা করেছিল? ভয়ের সূত্রটা যে তার মগজেরই ভেতর। সেখানেই ঘাপটি মেরে আছে রাজ্যের ভয়। নুরুল জানে, সে পালাতে পারবে না আতঙ্কে এই ঘেরাটোপ থেকে।
মধ্যরাত পেরিয়েছে বহুক্ষণ। জানালা দিয়ে ছিটকে পড়ে বজ্রপাতের আলো। কেঁপে ওঠে নুরুল। হিম হয়ে আসে ভেতরটা। এবার যার চেহারা দেখল, সে তার চেনা কল্পনা নয়। সাদা ফ্যাকাসে রক্তশূন্য একটা পাণ্ডুর মুখ। মাথাটা ধীরে ধীরে ঘুরে গেল নুরুলের দিকে। ফ্যাসফ্যাসে কথাগুলোকে মনে হলো বাতাসের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ভেসে আসছে।
‘নুরু নুরু নুরুহ রুহ।’
‘কে! তুই কে! যাহ! যা কইতাসি!’
‘আমি। আমি।’
এ কণ্ঠে তাপ নেই। গলার ভেতর যেন কবরের শীতলতা। নুরুর মনে হলো তার মাথার ভেতরে দূরে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে কথাগুলো। মনে হলো কেউ কোনো কথা বলছে না, তবু পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে।
‘তোরে আসতে বলি নাই। তোকে চিনি না। এই চেহারা আমি চিনি না। তুই যা।’
‘নুরু। আমি আসছি। আমি। আমি আসি। আসি। আ…।’
‘চুপ! একদম চুপ। তুই কেউ না! তুই কেউ না!’
‘ওইখানে অনেক আন্ধার। ভয় করে। ভয় করে। ভয়…।’
নুরুল পালিয়ে যেতে পারে না। মাথার ভেতর যার বাস তার হাত থেকে পালানোর মন্ত্র জানা নেই। রক্তশূন্য বজ্রপাত পড়া সাদা প্রাগৈতিহাসিক মুখটা ভেসে ভেসে এগিয়ে আসে আরও কাছে। নুরুলকে খুব কাছ থেকে দেখে।
‘আমি রৌশন.. আমি দিলরু… আমি বউ বউ বউ। তোমার নয়নতারা নুরু.. নুরু.. নুরু।’
অন্তরভেদী দৃষ্টিটা নুরুলের চোখ ভেদ করে বহুদূরে ভেসে থাকে। নুরুলের প্রবল তৃষ্ণা পায়। নিজের চোখ জোড়ার ওপর অত্যাচার চালায়। কল্পনার হাত থেকে মুক্তি মেলে না। চেহারার মতো ফ্যাকাসে পুরনো লাশের মতো দুটো হাত জড়িয়ে ধরে নুরুল আফসারের গলা। বরফশীতল অশরীরী স্পর্শে ফের কেঁপে ওঠে নুরুলের গভীরে বাস করা আরেক নুরুল আফসার। এ তো কল্পনা নয়! এতদিন কল্পনায় যে প্রেয়সীর প্রেমে মশগুল ছিল, যার সঙ্গে যা খুশি তা করা যেত, সেই কল্পনার মানবী রক্তমাংসের ভর করতেই যেন নুরুলের মনের প্রাসাদ ভেঙে চুরমার হতে থাকে। প্রাগৈতিহাসিক সেই প্রাসাদে সে আর ক্ষমতাধর রাজা নয়, ভীতসন্ত্রস্ত ঠুনকো মানুষ!
জানালার কপাট বাড়ি খায়। বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিতে পারছে না অ-কল্পনীয় মানবীর অস্তিত্বকে। বজ্রপাতের আলো স্থির হয়ে থাকে সাদা রক্তশূন্য প্রায় মৃত ওই চেহারায়।
‘আমি রুবা। আমি হাসনাহেনা। আমি! আমি! আমারে নাও নুরু। আমি যাব না। ওইখানে আন্ধার। অনেক রাইত।’
নুরুল গলা দিয়ে কথা বলছে নাকি কল্পনায়, বুঝতে পারে না। তবে সে যা বলতে চায় তা হলো, ‘তোকে আমি চাই না। তুই আমাকে মারতে এসেছিস! আমাকে মারিস না।’
বজ্রপাতের পর বজ্রপাত। আলোর ঝলকানিতে দপ দপ জ্বলে উঠতে চায় মানবীর চোখজোড়া। নুরুলের গলা জড়িয়ে ধরা হাত দুটো শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে ক্রমশ। কাঠ সদৃশ হাতের প্রাচীন আঙুলগুলো সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরে গলার নরম দেবে যাওয়া অংশটা। ঝটকা মেরে সরে যায় নুরুল। ছুটে যায় রান্নাঘরে। পরিপাটি সাজানো তাক থেকে তুলে নেয় ছুরিটা।
নুরুলের দেহের ভেতরের কুঠুরিতে ভর করেছে অন্য কেউ। আদিম, হিংস্র ও বেঁচে থাকাই শেষ কথা যার কাছে শেষ কথা, সেই নুরুল আফসার প্রবল বেগে ছুরি বিঁধিয়ে দেয় তার কল্পনাবাস্তব প্রেয়সীর বুকে।
দিলরুবার বুক বরাবর শব্দ না করে ঢুকে যাওয়া ছুরির ফলাটা কি কল্পনা? এক ফোঁটা রক্তের দেখা নেই। নুরুল কল্পনা করতে চায় রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছে রক্ত। ছিটে এসে পড়ছে নুরুলের মুখে। মরে যাচ্ছে দিলরুবা? তা তো হচ্ছে না। ছুরি চালালো। একের পর এক। বুকের ঠিক মাঝ বরাবর। দিলরুবার নির্লিপ্ত মাথা নিচু করা চাহনি ছুরির দিকে। রক্তশূন্য চোখে বোঝার চেষ্টা করে নুরুল কী চায়।
‘নুরু, নুরু। যাব না। যাব না। আন্ধার।’
‘তুই মরবি! আমি বলসি তাই মরবি। তোরে আইজ ঘাই দিয়া দিয়া মারবো।’
নুরুল ঈশ্বর ঈশ্বর খেলতে চায় তার কল্পনার মানবীর সঙ্গে। এতটা জীবনঘেঁষা কল্পনা সে করতে চায়নি কোনোদিন। কল্পনাকে কে বলেছিল এতটা অকল্পনীয় হয়ে উঠতে!
‘আমি তোমার লগে থাকবো!’
মানবীর ফ্যাসফ্যাসে গলায় প্রাণের ছোঁয়া লাগে না। ঝোড়ো বাতাসে মিশে যাওয়া কথাগুলো মিলিয়ে যায় আকাশের অন্ধকারে। নুরুল ছুরি চালায়। একের পর এক ঘাই। তবু এক ফোঁটা রক্তের দেখা নেই।
মানবী এগিয়ে আসে। আরও কাছে। কল্পমানবী নিঃশ্বাস নেয় না। নুরুলের দম আটকা। কল্পনার নারী ক্রমে আরও বাস্তব থেকে বাস্তবতর হয়ে আসে। প্রাগৈতিহাসিক আঙুলের গিঁটগুলো চেপে বসে নুরুলের গলায়। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে গিয়ে নুরুলের মনে হয় সে অনন্তকালের জন্য দমহীন এক জগতে ঢুকে পড়েছে।
আবার ছুরি চালায়। বাস্তবে পারে না। কল্পনায় শক্তি সঞ্চয় করে ঘাইয়ের পর ঘাই দেয়। কল্পনা করে দিলরুবা, জবা, নয়নতারা সব মরে যাচ্ছে। বাস্তবে মরে না। ছুরিকাঘাতে শুধু কাতর হয় তারা।
‘নুরু। আমার নুরু। আমার লগে চলো। আন্ধারে চলো।’
নুরুল আফসার প্রতিবাদ জানাতে পারে না। চোখ কোটর ছাড়িয়ে আসছে। দম নেই। কল্পনার প্রেয়সী তাকে অবর্ণনীয় যন্ত্রণার সাগরে ভাসতেও দেয় না। চেপে ধরে সাগরের গভীরে। বৃষ্টির ছাঁটে ডুবে যেতে থাকে নুরুল। বজ্রপাতের আলোগুলো কালো রেখার মতো চোখের সামনে হারিয়ে যায়। দম পুরোপুরি ফুরিয়ে আসার আগে কল্পনায় নুরুল আফসার দেখতে পায় আরেকটা মুখ। নিজের গলা চেপে ধরা অবস্থায় নিজেরই বীভৎস চেহারাটা ফুটে ওঠে এক ঝলক।
[প্রসিদ্ধ পাবলিশার্স থেকে আসন্ন ‘ভয়াল’-এর একটি গল্প]