class="post-template-default single single-post postid-16950 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

রিয়াজুল হকের কলাম : পিতাদের নিঃসঙ্গতা এবং আর্থিক সংকট

রিয়াজুল হক কলাম

রিয়াজুল হকের কলাম

বিষয়টা নিয়ে হয়ত অনেকের ভাবার সময়ই হয়না। পিতা খুব সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে দায়িত্বশীল এবং নিঃসঙ্গ মানুষের নাম। যার কাজই হচ্ছে পরিবারের সকলের সব ধরণের চাহিদা পূরণ করার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিশ্রম করে রাতে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়া। যাদের জন্য সারাটা দিন পরিশ্রম করা হয়, তাদের সাথে মন খুলে কথা বলারও সুযোগ থাকে না। সুযোগ না থাকার অভাবে একটা সময় সন্তানরাও বাবাকে খুব রিজার্ভ মনে করা শুরু করে। কিছুটা দূরত্ব তৈরী হয়। প্রয়োজন হলে যেন সন্তানরা কাছে আসে। আর বাবা ডাকলে সন্তানরা কাছে আসে, ঠিক যেন এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তর দেওয়ার মতো। এখানে সস্তানদের দোষ দেওয়া হচ্ছে না। আসলে পরিস্থিতি এমনটা তৈরী করে দিয়েছে। মায়েরা সন্তান, সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর বাবা ব্যস্ত থাকে পরিবারের জন্য আয় রোজগার করার জন্য। তবে আজকের এই লেখাটা মূলত মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য প্রযোজ্য। অঢেল অর্থবিত্তের মালিক বাবাদের জন্য এই লেখা প্রযোজ্য নয়।

মশিউর রহমান (ছদ্মনাম) জেলা শহরের একটি এমপিও ভুক্ত মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষক ছিলেন। স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। সন্তানদের ভালো করে লেখাপড়া করানো, বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ানো, সংসারের যাবতীয় খরচ মিটানোর পর তেমন কোন সঞ্চয় থাকত না। দুই ছেলে মাষ্টার্স পাস করেছে। দুই ছেলেই চাকরি করছেন এবং তারা বিবাহিত। তবে ছোট ছেলের চাকরি এমনি এমনি হয়নি। মশিউর রহমান অবসরোত্তর সুবিধা হিসেবে ১০ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন, সেটা দিয়ে তাঁর আগে থেকেই সঞ্চয়পত্র কেনা ছিল। তিন মাস পর পর কিছু মুনাফা পেতেন। কিন্তু ছোট ছেলের চাকরির জন্য সঞ্চয়পত্রের সেই টাকা তুলে ছেলের চাকরির উৎকোচের জন্য ১০ লক্ষ টাকা দিতে হয়েছিল। এখন তার নিজের কাছে কোন টাকা নাই। বড় ছেলে চাকরির সুবাদে অন্য জেলা শহরে থাকেন। ছোট ছেলের সাথেই তারা স্বামী স্ত্রী আছেন। তবে ছোট ছেলেরও নাকি বদলি হবার কথা শোনা যাচ্ছে। এরপর কি হবে মশিউর রহমান স্যারও নিজেও জানেন না। নিজের হাতেও টাকা পয়সা নেই। চাকরিকালীন সময়ে ব্যস্ততার কারণে পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। আর অবসরকালীন সময়ে পরিবারের অন্যরা ব্যস্ত হয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। বাবাদের জীবনটা সবসময় যেন নিঃসঙ্গতার চাদরে মোড়া থাকে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত একটা লেখা পড়ে চোখ আটকে গেল। সেটাই তুলে ধরছি- “বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ প্রাণীরনাম হচ্ছে- বাবা! বিয়ের আট-দশ-পনের বছর পরে বউয়ের সাথে আর আগের সেই ভালোবাসাটা থাকে না। ভালোবাসাটা অভ্যাসে পরিনিত হয়।নিত্যদিন আলু-পেয়াজ, বাচ্চার স্কুল-কলেজ ইত্যাদি আলাপে ঘুম নেমে আসে চোখে। একান্ত নিজের কথা, নিজের ভাবনা, ভালোলাগা কিছু বলার অবকাশহয় না। বিয়ের শুরুতে অথবা প্রেমিক জীবনে, হয়ত বাচ্চার নাম ঠিক করেছিলেন- দুইজন মিলে। রোমান্টিসিজম ছিল। সন্তান জন্মের পরে একরাশ দ্বায়িত্বকাধে চাপে। সন্তানের স্কুল- ভালো রেজাল্ট- বিয়ে- বাড়ি- গাড়ি। এইসব আলাপেই দুইজন ব্যস্ত থাকেন। এক সময় হয়ত দুপুরে অফিসের ব্যস্ততার ফাকেফোন দিয়ে স্ত্রীর সাথে নানা অর্থহীন গল্প গুজবে ভালোবাসা খুজে পেতেন। এখন দুপুরে ফোন দিলে হয়ত, স্ত্রী বলে উঠেন, ‘ডিপোজিটের টাকাটা জমাদিয়েছো/কারেন্ট বিল, গ্যাস বিল দিয়েছো?’ বাসায় ফিরে দেখেন, স্ত্রী বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত। যদি স্ত্রীকে বলেন, ‘আসো একটু নিরিবিলি কথা বলি,আমাদের কথা বলি।’ উত্তরে স্ত্রী হয়ত বলে উঠেন, ‘ ঢং করার জায়গা পাও না? আমার রান্না আছে ! একটু পরে বলবা ভাত দাও’ কিংবা হয়ত বলেউঠবেন, ‘বাচ্চারা বড় হয়েছে, সে খেয়াল আছে?’ কোন কোন সময় হয়ত আমাদের মায়েরা ফ্রি থাকেন। দুই কাপ চা নিয়ে দু’জন বসে পরেন পুরানো স্মৃতিরোমন্থনে। হঠাৎ করেই হয়ত প্রতিবেশির মেয়ের বিয়ের দাওয়াতের কথা মনে পড়ে। কমদামে, সন্মানজনক গিফট কেনার চিন্তা গ্রাস করে বসে দুজনকে।বাবারা যে কতটা নিঃসঙ্গ – তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মেলে, যখন আমাদের মায়েদের সাথে তাদের অভিমান পর্যায় চলে।
আমাদের বেশির ভাগ সন্তানই মা ঘেষা। বাবার সাথে কেমন যেন একটা দুরুত্ব থাকে। সন্তানেরা ভাবে, ‘বাবা প্রানীটা কেমন। সেই সকালে বেরিয়ে যায়,রাতে ফিরে। দেখা হলে কেবল রেজাল্ট জিজ্ঞাসা করে। এমন কেন এই লোকটা?’ মায়েরা সন্তানকে নিয়ে সংসার নামক পার্লামেন্টে ঐক্যজোট করে। বাবাদেখে তার সন্তানেরাও তার পক্ষে নাই। যাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তিনি বাবা-মা, ভাই-বোন,বন্ধু-বান্ধব সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। যাদের সাথে বিছানা শেয়ার করেছেন, এক পাতে খেয়েছেন- সেই ভাই বোনেরাও সংসারের চাপে, জমি-বাড়ি-সম্পদ ইত্যাদি বৈষয়িক ঝামেলায় দুরেরমানুষ হয়ে যায়। বিভিন্ন কারনে এক সময়ের কাছের বন্ধুদের সাথেও সে রকম যোগাযোগ থাকে না। কিংবা থাকলেও নানান রকম সামাজিক অনুষ্ঠান,বৈষয়িক কথাবার্তা , ছেলেমেয়ের রেজাল্টের খবর আদানপ্রদানে আটকে থাকে, সেই সকল যোগাযোগ। কলিগদের সাথেও একটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য বজায়রেখে চলতে হয়। যাকে বলে প্রফেশনালিজম। কারো সাথে একত্রে বসে, নিজের মনের একান্ত কিছু কথা বলার কেউ থাকে না। কেউ না। মায়েরা হয়তকথায় কথায় বলতে পারেন, আমি বাপের বাড়ি/বোনের বাড়ি চলে গেলাম। কিন্তু বাবাদের চলে যাবার মত কোন জায়গা থাকে না। একরাত কারোবাসায় গিয়ে থাকার মত কোন জায়গাও অবশিষ্ট নাই তাদের”।

আজিজুল ইসলাম(ছদ্মনাম) সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অত্যন্ত সম্মানের সাথে চাকরি জীবন শেষ করেন। অবসর জীবনের বয়স প্রায় ১৩ বছর। স্ত্রী মারা গেছেন আজিজুল ইসলামের বয়স যখন ৩৮ বছর। দুইটি সন্তানকে ঠিকমত মানুষ করার জন্য আর বিয়ে করেন নি। সন্তান দুইটি অনেক বড় হয়েছেন। একজন অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং অন্যজন সৌদি আরবের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। অনেক নামকরা দুইজন। ভীষণ ব্যস্ত তারা। বাহাত্তর বছর বয়স্ক বাবার খোঁজ খবর নেবার সময় নেই তাদের। দুই মাস পরপর বাবার ব্যাংক হিসেবে তারা টাকা পাঠায়। আজিজুল স্যার ব্যাংক থেকে টাকা তোলেন না। সন্তানদের জন্যই রেখে দিয়েছেন, যদি ভবিষ্যতে তাদের কোন কাজে আসে। বয়সের ভারে নিজের পেনশনের টাকা তোলা , বাজার করা, দরকারি জিনিসপত্র কেনা, কাপড় ধোয়াসহ বাড়ির সবকিছু দেখভাল করা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। হৃদরোগ, ডায়াবেটিকসসহ বিভিন্ন রোগতো আছেই। প্রতিবেশীরা প্রায়ই বলে, সন্তানদের কাছে চলে গেলেই তো পারেন। আজিজুল স্যার প্রতিবেশীদেরও বলতে পারেন না সন্তানদের অনীহার কথা। অনেক বার চেষ্টা করেছেন সন্তানদের কাছে যাবার। নাতি নাতনীদের সাথে সময় কাটাবার। কিন্তু সন্তানরা চায় না। বৃদ্ধ বয়সে একাকীত্ব যে কত বড় যন্ত্রণার, সে কথা কাউকে বলা যায়না। নিজের একাকীত্ব দূর করার জন্য আজিজুল স্যার চলে এসছেন বৃদ্ধাশ্রমে। দুঃখ করেই স্যার একদিন বলেছিলেন, সন্তানদের বেশি বড় মানুষ করতে নেই। আপন থাকে না, পর হয়ে যায়।

আধুনিকতার নামে আমরা সত্যিই বর্বর হয়ে যাচ্ছি। বড় বাড়িতে বাবার থাকার জন্য সামান্য একটু জায়গা আমরা দিতে পারছি না, লক্ষ টাকা আয় করেও বাবা বিনা চিকিৎসায় যদি দিনের পর দিন পার করে, তবে সন্তান থাকার চেয়ে না থাকাই যে ভালো। বাবা কি সারাটা জীবন কষ্ট করার জন্যই পৃথিবীতে আসে? চাকরি জীবনে সন্তানের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে নিজের স্বাদ কখনও পূরণ করতে পারেনা, বৃদ্ধ বয়সেও যদি সন্তানের অবহেলা সহ্য করতে হয়, তবে সন্তান দিয়ে কি হবে? আমরা যারা সন্তান, একবারও ভাবছি না, আমাদের শরীরের এই শক্তি একদিন থাকবে না। আস্তে আস্তে সব নিঃশেষ হয়ে যাবে। প্রত্যেক সন্তানের উচিত, তাদের বাবা-মায়ের সেবা যত্ন করা।

প্রত্যেকটি সন্তানকে অনুরোধ করব, বাবাদের একটু সময় দিন। তারা হয়ত নিজেদের একটু রিজার্ভ করে রাখেন। আমরা সন্তানরাই না হয় বাবাদের কাছে যাবো। হয়ত বাবারা একটু কম কথা বলবে, কিন্তু বিশ্বাস করুন তাদের মনটা ভরে উঠবে। আমাদের জন্যই তো তাদের দিন রাতের পরিশ্রম। আমাদের জন্যই শেষ জীবনে বাবাদের কোন সঞ্চয় থাকে না। অনেক বাবাদের বলতে শুনেছি, জীবনের অর্জিত সকল অর্থ, মূল্যবান সময়গুলো পরিবারের মানুষগুলোর সুখ শান্তির জন্য ব্যয় করেছি। অথচ জীবন সায়াহ্নে এসে দেখি সকল কষ্টই বিফলে গেছে। মনে মনে নিজের বার্ধক্যকে ধিক্কার দেয়। সন্তান হিসেবে এটা আমাদের ব্যর্থতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!