১৯৭২ সাল। সর্বশেষ অ্যাপোলো মিশনে চাঁদের বুকে হেঁটে আসেন নভোচারী জিন কার্নান। ফেরার সময় বলেছিলেন, বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না, আবার আসছি চাঁদে। কিন্তু হায়! গুনে গুনে পেরিয়েছে ৫০ বছর। কোনো এক অভিমানে নাসা আর কাউকে পাঠায়নি চাঁদে। অবশেষে যেন মান ভাঙতে চলল। চাঁদের পানে রওনা দিয়েছে আর্টেমিস-১। ভেতরে কোনো নভোচারী না থাকলেও রাশভারী এ মিশনের খুঁটিনাটি সব ঠিকঠাক থাকলে পরের কোনো এক মিশনেই আবার কেউ না কেউ হাঁটবে চাঁদের বুকে।
নামের নেপথ্যে
নাসার চন্দ্রাভিযানের নাম ছিল অ্যাপোলো। গ্রিক মিথোলজি মতে, তিনি মোটামুটি সবকিছুরই দেবতা। সেই অ্যাপোলোর যমজ বোন আর্টেমিসের জমিদারির সীমানায় আবার চাঁদও আছে। এ কারণেই এবার নাসার রকেটের এমন নাম। আবার আর্টেমিসের সামনে যে নভোযানে ভবিষ্যতে মানুষ চড়বে সে অংশটার নাম ওরিয়ন। এখানেও আছে গ্রিক পুরাণ। ওরিয়ন হলো পোসাইডনের শিকারি পুত্র। সরল কথায়—আর্টেমিসে ভর করেই চন্দ্রশিকারে যাবে ওরিয়ন।
হৈচৈ কেন?
অনেক রকেটই তো চড়ল মহাকাশে। এমনকি চাঁদে তো হাঁটাহাঁটিও করে এলো গুনে গুনে ১২ জন নভোচারী। তাহলে আর্টেমিস-১ নিয়ে বাড়তি শোরগোল কেন? মূলত এখানে চাঁদে যাওয়া ছাড়াও জড়িয়ে আছে আরও অনেক কিছু। বুধবার যে আর্টেমিস উড়াল দিল আকাশে, তাতে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট ব্যবস্থা—স্পেস লঞ্চ সিস্টেম। ১০০ মিটার আর্টেমিসকে ওপরে তুলতে গত বুধবার আর্টেমিসের দুপাশে দুটো রকেট বুস্টার তৈরি করেছিল ৪১ লাখ কেজির ধাক্কা। বিজ্ঞানের ভাষায় বললে যা দাঁড়ায় ৩৯ মেগানিউটনে। এর আগে ফ্যালকন হেভি নামের আরেকটি রকেট উড্ডয়নে সর্বোচ্চ লেগেছিল প্রায় ২৩ লাখ কেজির ধাক্কা।
তা ছাড়া এত ভারী পেলোড ও রকেট নিয়ে এবারই প্রথম মহাকাশে সফলভাবে উড়ে গেল কোনো রকেট। এ রকেট আবার ইলন মাস্কের স্পেস-এক্স তৈরি রকেটের চেয়েও শক্তিশালী।
মিশন
উড্ডয়নের ৯ ঘণ্টা পরেই আর্টেমিসে থাকা ওরিয়ন ক্যাপসুল থেকে তোলা পৃথিবীর একটি ছবি পেয়েছে নাসা। তাতে ৫৭ হাজার মাইল দূর থেকে পৃথিবীকে দেখাচ্ছিল নীলচে চাঁদের মতোই।
এ মিশনের সফলতার ওপরই নির্ভর করছে নাসার পরবর্তী মনুষ্যবাহী মিশনের সিদ্ধান্ত। তখন শুধু মানুষ পাঠানোই মুখ্য হবে না, চাঁদে ছোটখাটো কলোনি করে সেখানে নভোচারীদের কিছুদিন রাখা যায় কিনা, সেই স্বপ্নও ইতোমধ্যে দেখাতে শুরু করেছে আর্টেমিস।
এ কাজে ওরিয়নকেও কাজ করতে হবে ঠিকঠাক। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএস) মহাপরিচালক জোসেফ অ্যাশবাচার বললেন, ‘ওরিয়ন চাঁদকে ঘিরে নিরাপদে চক্কর খাবে, তারপর সেটাকে আমরা নিরাপদে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনব। কাজটা যেহেতু শুরু হয়ে গেছে, তাই এখন এটা বিশাল এক দায়িত্ব।’ ওরিয়ন পৃথিবীতে ফিরে আসবে উড্ডয়নের সাড়ে ২৫ দিন পর। সেই হিসেবে হাতে আছে আরও ২১ দিন। এর মধ্যে আর্টেমিস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওরিয়ন চাঁদের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যেও আসবে। আবার পরে চাঁদের ৭০ হাজার মাইল দূরেও একদফা চক্কর খাবে ওরিয়ন। ১১ ডিসেম্বর ওরিয়ন এসে পড়বে পৃথিবীর প্রশান্ত মহাসাগরে।
ওরিয়নের অগ্নিপরীক্ষা
ওরিয়ন যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে তখন এর গতি থাকবে ঘণ্টায় ৩২ হাজার কিলোমিটার। শব্দের গতির চেয়ে যা ৩২ গুণ বেশি! এ গতিতে চলার সময় ওরিয়নের বাইরের দিকে থাকা তাপরোধক আবরণীতে (হিট-শিল্ড) তৈরি হবে তিন হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ। ওরিয়নের ভেতরে থাকা কিছু অণুজীব ও মানুষের আদলে তৈরি পুতুলটা ওই সময় ঠিকঠাক থাকলেই বোঝা যাবে, পরবর্তী মানুষ ওই নভোযানে করে ফিরতে পারবে কিনা।
আসছে স্টারশিপ
এ যাত্রা নাসার এসএলএস স্পেস এক্সকে টেক্কা দিলেও খেতাবটা বোধহয় বেশি দিন রাখতে পারবে না। কারণ স্পেস এক্স খুব তাড়াতাড়ি ‘স্টারশিপ’ তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। ওই স্টারশিপে থাকবে আরও শক্তিশালী রকেট ও বড়সড় নভোযান। যার ভেতর যাবে মানুষ ও কার্গো। ওতে থাকবে সুপার হেভি নামে বুস্টার। নেক্সট জেনারেশন র্যাপটর ইঞ্জিন চালাবে ওই রকেট। ছয়টি র্যাপটর ও সুপার হেভি বুস্টারগুলো সম্মিলিতভাবে তৈরি করবে প্রায় ৭২ লাখ কেজির ধাক্কা।
ওই সময় অবশ্য স্টারশিপে করেই চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে নাসা। এখন পর্যন্ত যেসব সমীকরণে এগোচ্ছে, তাতে ২০২৫ ও ’২৭ সালে আর্টেমিস-৩ ও আর্টেমিস-৪ মিশনে করে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে হাঁটতে দেখা যাবে নাসার নভোচারীদের।