class="post-template-default single single-post postid-15886 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

গল্প : বড় হওয়া – রিমা বিশ্বাস

কুহেলির কথা জানার পর থেকে সুপ্রিয়ার মনটা চঞ্চল হয়ে রয়েছে। ছেলেটা বুঝতে দেয়নি কিচ্ছু! কবে থেকে এসব চলছে কে জানে! যখন রোহন ছোট ছিল তখন তো জল খাওয়ার আগেও মাকে জিজ্ঞেস করত। সুপ্রিয়ার শান্তিতে কোথাও যাওয়ার জো ছিল! মা খেতে না-দিলে খাবে না। কত বলত, ঠাম্মা খেতে দিক খেয়ে নে। ছেলে শুনবে? তারপর যখন পুজোর জামাকাপড় কেনা হত? সব দায়িত্ব মায়ের! মা যেমন কিনবে! সেদিনই তো খটকা লাগল সুপ্রিয়ার। যেবার ছেলে বলে কিনা ওর পিচ ‌রংয়ের শার্ট চাই! যে ছেলের কখনও জামাকাপড় নিয়ে কোনও মাথা ব্যথা নেই তার আবার এমন শখ! তাও ভেবেছে, কী জানি! বড় হচ্ছে। শখ বদলাচ্ছে। একদিন বলে, ‘‘কই মাছ খাব!’’
শুনে অবাক সুপ্রিয়া, ‘‘তুই খাবি মাছ? আবার কই!’’
‘‘হ্যাঁ! বাঙালি হয়ে সব মাছ না চেনাটা লজ্জার। বাবাকে বোলো তো রবিবার-রবিবার ভ্যারাইটিজ় মাছ আনতে।’’
সেদিন থেকেই সন্দেহ দানা পাকতে শুরু করে। যে ছেলে মাংস, ডিমের অতিরিক্ত কিচ্ছুটি ছোঁয় না, তার আবার মৎস্যপ্রীতি! একদিন তো সুপ্রিয়া জিজ্ঞেসই করে ফেলল, ‘‘তোর ব্যাপার কী বল তো! আজকাল এত চেঞ্জ। কথা কম বলিস! খাওয়ার হ্যাবিট, গান শোনার টেস্ট বদলে যাচ্ছে!’’
‘‘বদলাচ্ছে কোথায়? ট্রাই করছি! যেগুলো ভাল লাগত না ওগুলো ট্রাই করে দেখছি। হয়তো লাইফই বদলে গেল!’’
মাথাটাথা ঘুরে গিয়েছিল এমন সব কথা শুনে। তারপর সুপ্রিয়াও চোখ রাখতে শুরু করল। মোবাইল চেক করতেই হোয়াটসআপ মেসেজে সব ধরা পড়ল। মেয়েটার ডিপি দেখেই বুঝেছে, ছেলের মাথা খাচ্ছে!
কলিং বেল বাজতেই মাথায় ঝপ করে আগুন ধরে গেল। এখন বাড়ি ঢোকার সময়! রোমিওগিরি তোমার আজ ঘোচাচ্ছি! দরজা খুলতে দেখে ঘামে ভেজা রোহনের চোখ-মুখ কালো! ছেলের শুকনো মুখটা দেখে আর রাগ করতে পারল না সুপ্রিয়া। নরম স্বরে বলল, ‘‘এত দেরি হল যে তোর!’’
‘‘পিকুর বাবার হঠাৎ পড়ে গিয়ে পায়ে ফ্র্যাকচার! ওঁকে নিয়ে কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে ছোটাছুটি করতে হল।’’
বুকটা শান্ত হল সুপ্রিয়ার। যাক, তবে কুহেলির সঙ্গে ছিল না। তাও সন্দেহ দূর করতে বলল, ‘‘কে কে ছিলি তোরা?’’
‘‘আমি প্রশান্ত আর কুহেলি!’’
ধক করে উঠল বুক, ‘‘কুহেলি! ও তো মেয়ে!’’
হেসে ফেলল রোহন, ‘‘মেয়ে তো কী! ওই তো ডক্টরদের সঙ্গে কথা বলছিল। পিকুর মা তো নার্ভাস হয়ে কিছু শোনার মতো পরিস্থিতিতেই ছিলেন না! কুহেলি আবার মেডিকেল লাইনটা ভাল বোঝে!’’
‘‘কেন? ও কি ডাক্তারি পড়ছে!’’
‘‘নাহ! জুলজি অনার্স!’’
মাথা ঝনঝন করছে সুপ্রিয়ার। এতক্ষণ ধরে ওই মেয়েটার সঙ্গে ছিল রোহন। জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘‘কুহেলি তোর বান্ধবী?’’
‘‘হ্যাঁ!’’
‘‘শুধু বান্ধবী না অন্য কিছু!’’
একটু থমকাল রোহন, তারপর গুছিয়ে বলতে শুরু করল, ‘‘আমার ওকে ভাল লাগে। আমরা ক্লাস ইলেভন থেকে বন্ধু ছিলাম, কিন্তু এখন…’’
‘‘থাক! প্রেম করছিস? লেখাপড়া ছেড়ে এখন থেকে প্রেম করবি?’’
‘‘ওভাবে বলছ কেন? ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকাকালীনই  ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এত ভাল র‌্যাঙ্ক করলাম! দু’বছরে ভাল পার্সেন্টেজও এসেছে! আমার দিক থেকে আমি তো তোমাদের কোনও অভিযোগের সুযোগ দিইনি!’’

 

গল্প বড় হওয়া

আবার মাথা টিপটিপ করছে। ছেলে কত বদলে গিয়েছে। এখন ওকে বলে, ওভাবে কথা বলছ কেন? আগে মুখে রা ছিল না! শুধু বায়না করত এটা-ওটার, ‘মা বন্দুক কিনে দাও! গাড়ি দাও! মিলিটারি ড্রেস চাই…’ বায়না না মেটালেই ছেলের কান্না। একটু যখন বড় হল তখন মেজাজ। সেবার স্মার্টফোন কেনা নিয়ে কী অশান্তি! তবে এই কুহেলিকে যেন একদম সহ্য হচ্ছে না সুপ্রিয়ার।
রোহন সোফায় এসে বসতে সুপ্রিয়া বলল, ‘‘তোদের ওই কুহেলিকে একদিন বাড়িতে আনতে পারিস তো! একবার দেখতাম ওকে!’’
উজ্জ্বল চোখে তাকাল রোহন, ‘‘তুমি দেখবে ওকে! সত্যি বলছ মা!’’
‘‘হ্যাঁ রে বাবা, একবার বাড়িতে আন তো!’’
স্মার্টফোন পাওয়ার পরও রোহনের চোখে-মুখে এতটা আনন্দ দেখেনি যতটা কুহেলির কথায় হল।

সকাল থেকে সুপ্রিয়া ঘরদোর পরিপাটি করে গোছাল ।নিজেও সাজগোজ করল। কলিংবেলে টিং টং। বুকটা ধুকপুক করছে। নিজেকে শাসিয়ে নিল, ওই একরত্তি মেয়ের জন্য আবার হৃদ‌্কম্প! দরজা খুলতে দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। লম্বা, বলিষ্ঠ চেহারার ফরসা ত্বকের রোহনের পাশে একটা সফেদ হাতি! কুহেলি টুক করে ঝুঁকে একটা প্রণাম করল। ওকে দেখে হাসতে বড্ড কষ্ট হল সুপ্রিয়ার। দুনিয়ার যত রাশভারী লোক আছে সকলের ব্যক্তিত্ব জড়ো করে আনল নিজের ব্যবহারে। গম্ভীর ভাবে বলল, ‘‘এসো!’’
কুহেলি খুব ফরসা। তবে বেশ মোটা। মুখ মিষ্টি। বসার ঘরের সোফায় বসেছে তিনজন। সুপ্রিয়া বলল, ‘‘তুমি জুলজি নিয়ে পড়ছ?’’
হাসি-হাসি মুখে কুহেলি বলে, ‘‘হ্যাঁ, বায়োলজি ছোট থেকেই ভাল লাগত আন্টি, তাই এই সাবজেক্ট নিয়েছি।’’
‘‘ছোট থেকে বুঝি খেতেও ভাল লাগত!’’
খিলখিল করে হাসে কুহেলি, ‘‘আন্টি, তুমি ঠিক বলেছ! এই জন্য এত মোটু হয়ে গেছি। আমি জাংক ফুড খুব খাই। আর খাব না। এবার থেকে স্যালাড খাব।’’
‘‘সেটা তো তোমার অনেক আগেই করা উচিত ছিল। তোমায় বাড়ির লোক সতর্ক করেনি!’’
‘‘মা তো কত বলে! আমারই হয়ে ওঠে না।’’
‘‘ডাক্তার দেখিয়েছ? কোনও রোগ নেই তো! চেক করা উচিত!’’
‘‘না আন্টি, আমি একদম ফিট। আমার কোনও রোগ নেই।’’
‘‘কত ওজন তোমার?’’
রোহন ফট করে উঠে দাঁড়িয়ে কুহেলির হাত ধরে টানল। কুহেলি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
‘‘চল, অনেক হয়েছে! তোকে বাড়ি পৌঁছে দিই!’’ বলল রোহন।
‘‘কিন্তু আন্টি কিছু জানতে চাইছেন!’’
‘‘দরকার নেই!’’ রোহনের গলায় রুক্ষতা।
কুহেলির মুখে হাসি বিরাজমান, ‘‘আন্টি, আজ আসি! আমার ওয়েট সেভেন্টি কিলো, হাইট পাঁচ দুই,’’ ওর হাত ধরে টানতে-টানতে রোহন এক রকম জোর করেই ওকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
মাথাটা জ্বলে গেল সুপ্রিয়ার। কী আস্পর্ধা মেয়েটার। একে তো এত মোটা, আবার দাঁত বের করে ওজন বলছে। যেন গিনেস বুকে নাম উঠবে। নির্লজ্জের মতো আবার রোহনের হাত ধরে চলে গেল। আসুক রোহন আজ! হেস্তনেস্ত হবে।

রোহন ঘরে ঢুকতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সুপ্রিয়া, ‘‘শোন রোহন! প্রেম করছিস, কর! ঘোর, ফের, আনন্দ কর! যা ইচ্ছে কর! কিন্তু বিয়ে করতে পারবি না! এই মেয়েকে আমি বিয়ে করতে দেব না!’’
‘‘কেন?’’

 

‘‘কারণ বোঝার মতো বয়স হয়নি তোমার! আমার পছন্দ নয়। প্রেম পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু বিয়েটিয়ে আমি আমার পছন্দে দেব!’’
রোহন সোফায় দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘‘তুমি আমায় কী কুশিক্ষা দিচ্ছ মা! নিজে মেয়ে হয়ে বলছ, একটা মেয়েকে নিয়ে ঘুরেফিরে আমি বিয়ে করার সময় মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করব!’’
ধমক দিল সুপ্রিয়া, ‘‘কী বলছিস আজেবাজে কথা!’’
‘‘তুমি ওর শরীরটা দেখছ, আমি দেখেছি ওর মন! তুমি ওকে হ্যারাস করার জন্য সমানে ওর ওজন নিয়ে বিদ্রূপ করে যাচ্ছিলে, অথচ ও ধরতেই পারছিল না। হেসে-হেসে সব কথার উত্তর দিচ্ছিল। দ্যাট্স হোয়াই আই লাভ হার। সত্তর কেন, একশো কিলো ওজন হলেও আমি কুহেলিকেই বিয়ে করব!’’

রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে রোহন বেরিয়ে গেল। সোফায় শক্ত হয়ে বসে সুপ্রিয়া। বুক ধকধক করছে। মনে হচ্ছে প্রেশার অনেকটা উঠে গেছে। মাথা টিপটিপ করছে। রোহন বড় হয়ে গেল তবে! তবে কি সুপ্রিয়া বড় হতে পারল না এখনও!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!