সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মির প্রভাবে হাইপার মেলানোসিস হয় অর্থাৎ মেলানিন উৎপন্ন হয়। এর ফলে ত্বকের কিছু কিছু জায়গায় গাঢ় কালো ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায় যা মেছতা বা মেলাজমা নামে পরিচিত। মেলাজমা শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ মেলাজ (melas) থেকে যার অর্থ কালো। যে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে নারীরা বেশি আক্রান্ত হয় বিশেষ করে গর্ভবতী নারী যারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ ঔষ গ্রহণ বা হরমোন থেরাপি নেন। ত্বকের যে সমস্ত জায়গায় সূর্যরশ্মি বেশি পড়ে সে সমস্ত জায়গা যেমন- উপরের গাল, নাক, ঠোঁট এবং কপালে মেছতা দেখা যায়। এটি সাধারণত ৩০-৪০ বয়সের মধ্যে বেশি হয়। তবে মাঝেমধ্যে ঘাড়ের পাশে, কাঁধ ও উপরের বাহুতে দেখা যায়।
গ্রীষ্ম প্রধান ও সাবট্রপিক্যাল দেশগুলোতে যেখানে সূর্য রশ্মি প্রখর সেখানে মেছতার আধিক্য দেখা যায়। মেছতা কে সাধারণত ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১। এপিডার্মালঃ ত্বকের বহিঃ স্তরের উপরিভাগে এই প্রকার মেছতা দেখা যায়। এই প্রকার মেছতার রং গাঢ় বাদামী বর্ণের এবং লাইটের নীচে দেখলে আরো গাঢ় মনে হয়। শতকরা ৭০-৭৫ ভাগ রোগী এই শ্রেণীর এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এই মেছতা সহজে সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়।
২। ডার্মালঃ ত্বকের বহিঃ স্তরের নিচের স্তরে এই প্রকার মেছতা দেখা যায়। এই দাগ হালকা বাদামী বর্ণের এবং লাইটের নিচে দেখলে এর রঙের কোন পরিবর্তন হয় না। শতকরা ১৩ ভাগ রোগী এই পর্যায়ের এবং এদের চিকিৎসায় খুব কমই সাফল্য আসে।
৩। মিশ্রিতঃ এই প্রকারের মেছতা ত্বকের অন্তঃস্থ এবং বহিঃস্তর জুড়ে বিদ্যমান থাকে। দাগ হালকা এবং বাদামী উভয় রঙেরই হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসায় আংশিক সাফল্য আসতে পারে।
এছাড়া আরও কিছু প্রকারের মেছতা রয়েছে, যেমন
- মেছতা জেনেটিক
- মেছতা ইডিওপ্যাথিক
- মেছতা গ্রাভিডেরাম
- মেছতা এন্ড্রোক্রাইনো প্যাথিক
- মেছতা একটিনিক
- মেছতা আয়ারট্রোজেনিকা
- মেছতা কন্ট্রাসেপটিকা
- মেছতা হেপাটিকা
- মেছতা কসমেটিকা
- মেছতা ইউমেনোলজিক্যাল
- মেছতা মেনোপোজাল
মেছতার কারণ
বেশির ভাগ সময় মেছতার সুস্পষ্ট কারন খুঁজে পাওয়া যায় না, তবে হরমোন একটি অন্যতম কারণ। নিম্নে মেছতার প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করা হল-
- নারীদের সেক্স হরমোন ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন মেলানোসাইট বা রঞ্জক উতপাদক কোষগুলোকে উদ্দীপিত করে বেশি পরিমাণে মেলানিন উৎপাদন করার জন্য। এই বেশি পরিমাণে মেলানিন ত্বকে মেছতার সৃষ্টি করে।
- মেছতার আরেকটি কারণ হল সূর্যরশ্মি। সূর্যরশ্মির আলট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন (অতিবেগুনি রশ্মি) কোষ প্রাচীরে লিপিড পার অক্সিডেশন ঘটায়, ফলে ফ্রি রেডিক্যাল জমা হয় যা মেলানোসাইটিকে উদ্দীপিত করে বেশি পরিমাণে মেলানিন তৈরির জন্য। এজন্য যারা দীর্ঘক্ষণ বাইরে থাকেন বা সূর্যের আলোর সংস্পর্শে থাকেন তাদের মেছতা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। দীর্ঘ ওয়েভলেন্থও (UV-A, 320-700 nm) মেলানোসাইটকে উদ্দীপিত করে বেশি মেলানিন তৈরির জন্য।
- গর্ভাবস্থায় দেহে হরমোন পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় মেছতা দেখা যায়। বাচ্চা প্রসবের পর ধীরে ধীরে এই দাগ চলে যায়।
- ইস্ট্রোজেন বা প্রোজেস্টেরন হরমোন থেরাপি বা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ করার কারণেও মেছতা হতে পারে।
- ওভারিয়ান অথবা থাইরয়েড সমস্যায় ব্যবহৃত ঔষধের কারণেও মেছতা হতে পারে।
- সুগন্ধি সাধান, টয়লেট্রিজ এবং কসমেটিকস ব্যবহারের কারণেও অনেক সময় মেছতা হয়ে থাকে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল যদিও মেছতার একটি অন্যতম কারণ তবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খেলেই মেছতা হবে এমন কথা ঠিক নয়। আবার যারা জীবনে একদিনও এই পিল খাননি তাদের মুখেও মেছতার দাগ হতে দেখা গেছে।
তবে একথা সত্যি মেছতার দাগ আছে এমন কেউ যদি চিকিৎসা করাচ্ছেন অথচ জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খাওয়া বন্ধ করেননি সেক্ষেত্রে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম।
রোগ নির্ণয় (Diagnosis)
সাধারণত খালি চোখে দেখেই মেছতা নির্ণয় করা যায়। তবে উডস্ ল্যাম্পের (Wood’s lamp 340-400 wavelength) সাহায্যে পরীক্ষা করে বোঝা যায় ত্বকের ডার্মিস এবং এপিডার্মিস স্তরে মেলানিনের পরিমাণ।
আধুনিক চিকিৎসা
- মেছতার দাগ দূর করার জন্য সকল চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরাই হাইড্রোকুইনোনকে (২-৪%) আদর্শ হিসেবে ব্যবহার করেন। এই কেমিক্যাল টাইরোসিনেজ এনজাইমকে বাধা দেয়, কারণ এই এনজাইম মেলানিন উৎপাদনের সাথে জড়িত।
- ট্রিটিনয়েন (Tretinoin) এসিডকে অনেকে ব্যবহার করেন, কারণ এই এসিড ত্বকের কোষকে উপর থেকে তুলে ফেলে। তবে এই চিকিৎসা গর্ভকালীন সময়ে করা যাবে না।
- বর্তমানে এজিলেইক এসিড (২০%) এবং কোজিক এসিড (Kojic acid) ব্যবহার করা হয়। এই সমস্ত এসিড মেলানোসাইটের কার্যক্রম কমিয়ে দেয়।
- অনেক ক্ষেত্রে ফেসিয়াল পিলের (Facial peel) সাথে আলফা হাইড্রোক্সি এসিড অথবা কেমিক্যাল পিলের সাথে গ্লাইকোলিক এসিড ব্যবহার করা হয়।
- অনেক সময় কর্টিকোস্টেরয়েড যেমন হাইড্রোকর্টিসোন (hydrocortisone)। ব্যবহার করা হয়। স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সমূহ খুব দ্রুত মেছতার রং হালকা করে দেয়।
- মেছতার চিকিৎসায় সর্বশেষ ও কার্যকর সংযোজন হচ্ছে মাইক্রোডার্মোআব্রেশন (Microdermoabrasión)। একটি যন্ত্রের সাহায্যে ত্বকের সুক্ষ্ম ও সর্বোপরি স্তরটি তুলে ফেলা হয়। এতে কোনো রকম ব্যথা পাওয়া যায় না। এই অবস্থায় মেছতার ঔষধ প্রয়োগ করলে ঔষধের কার্যকারিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় এবং মেছতার ক্ষেত্রে আরো দ্রুত ভালো ফল পাওয়া যায়।
- মেছতার ক্ষেত্রে অনেক সময় লেজার চিকিৎসাও করা হয়। তবে এর ফল আশানুরূপ না হওয়ায় লেজারের ব্যবহার সীমিতই রয়ে গেছে।
যে সকল নিয়ম মেনে চললে চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে দ্রুত এবং ভাল ফল পাওয়া যাবে
- সূর্যের আলোতে বেরোনো বন্ধ করতে হবে। যদি বেরোতে হয় তবে বেরোনোর আধা ঘন্টা আগে অবশ্যই ত্বকে সান ব্লক ক্রিম বা সান্সক্রিন লোশন ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া ছাতা, স্কার্ফ এবং সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে।
- জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ এবং হরমোন থেরাপি বন্ধ করতে হবে।
আসলে মেছতার কোন স্থায়ী সমাধান নেই। চিকিৎসার মাধ্যমে সাময়িকভাবে দাগ চলে যায় কিন্তু সূর্য রশ্মির সংস্পর্শে এলেই আবার দাগ দেখা দিতে পারে।
মেছতা দূর করার হারবাল পদ্ধতি
১। ভিনেগারঃ ভিনেগার এবং সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে ব্যবহার করলে বেশ উপকার পাওয়া যায়। এটিতে ত্বক পরিষ্কার করে, উজ্জ্বলতা বাড়ায়, ময়েশ্চার এবং টোনার হিসেবে কাজ করে। ভিনেগার রাসায়নিকভাবে এসিটিক এসিড এবং এর ফর্সা ও উজ্জ্বলতা বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে। এছাড়াও এই মিশ্রণ ত্বক মসৃণ ও নরম করে।
২। পেঁয়াজের রসঃ পেঁয়াজের রসের সাথে সমপরিমাণ অর্গানিক ভিনেগার মিশিয়ে তুলার সাহায্যে আক্রান্ত স্থানে দিনে ২ বার লাগালে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। পেঁয়াজের রস বের করতে না পারলে পেঁয়াজ স্লাইস করে কেটে ভিনেগারে ডুবিয়ে সেই স্লাইস আক্রান্ত স্থানে লাগালেও উপকার পাওয়া যাবে।
৩। লেবুর রসঃ লেবুর রসে আছে এসকরবিক এসিড যা এন্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান। এই উপাদান ত্বকে অতিবেগুনি রশ্মি (Ultravioletray) শোষিত হওয়া প্রতিরোধ করে। লেবুর রস সরাসরি ত্বকে লাগানো যায় অথবা গ্লাইস করে কেটে তুলার প্যাডের সাহায্যে দাগের স্থানে সারারাত লাগিয়ে রেখে সকালে ধুয়ে ফেলতে হবে।
৪। ঘৃতকুমারীঃ মেছতা দূর করার আরেকটি উপাদান হল এলোভেরা বা ঘৃতকুমারী পাতার জেল এই জেলের রয়েছে ত্বকের যাবতীয় সমস্যা দূর করার ক্ষমতা। আক্রান্ত স্থানে আঙ্গুলের ডগার সাহায্য আস্তে আস্তে লাগাতে হবে এবং সারারাত লাগিয়ে রাখতে হবে। এভাবে কয়েক সপ্তাহ লাগালে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে। এছাড়া জেলের সাথে ভিটামিন ই এবং প্রিমরোজ ওয়েল মিশ্রিত করে লাগালে এক সপ্তাহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যাবে। একই সাথে জেলের শরবত খেলে ভাল হবে।
৫। হলুদঃ হলুদে থাকে কুরকুমিন নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট যা অক্সিডেটিভ ক্ষত মেরামত করতে সাহায্য করে এবং দাগ দূর করে। হলুদের পেস্ট ৫ টেবিল চামচ, দুধ ১০ টেবিল চামচ এবং ছোলার ডালের বেসন ১ টেবিল চামচ মিশিয়ে পেস্ট করে দাগের উপর পুরু করে লাগিয়ে রাখতে হবে ৩০ মিনিট। তারপর ঠান্ডা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে ফেলতে হবে।
হলুদের একটি মিশ্রণ বেশ কার্যকর। হলুদের পেস্টের সাথে লেলুর রস মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে ১০-১৫ মিনিট রেখে পরে পরিষ্কার ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
৬। পেঁপেঃ পেঁপেতে বিদ্যমান প্যাপাইন নামক এনজাইম ত্বকের উপরের মরা কোষ এবং রুক্ষতা দূর করে ত্বককে মসৃণ করে। পেঁপে পেস্ট করে আক্রান্ত স্থানে ১৫-২০ মিনিট লাগিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলতে হবে। পেঁপের পেস্ট ত্বকের রং উজ্জ্বল করে।
৭। আঙ্গুর বীজের নির্যাসঃ কিছু মেছতা আছে যা ছত্রাকের কারণে হয়ে থাকে। আঙ্গুর বীজের নির্যাসে আছে এন্টি ফাঙ্গাল উপাদান যা এই ধরনের মেছতার ক্ষেত্রে কার্যকর। সাধারণত আঙ্গুরের নির্যাস লিকুইড, পিল বা ক্যাপসুল আকারে পাওয়া যায়। তবে গর্ভবর্তী এবং দুগ্ধদানকারী মায়েদের বেলায় এই নির্যাস প্রযোজ্য নয়।
৮। যষ্টিমধুর নির্যাসঃ যষ্টিমধুর নির্যাস একটি প্রাকৃতিক উপাদান যাতে আছে ত্বক ফর্সা করার উপাদান লিকুইরিটিন এবং গ্ল্যাবরিডিন। গ্ল্যাবরিডিন তেলে দ্রবণীয় এবং ত্বকে লাগানো যায় আদর্শ পরিবর্তনকারী হিসেবে।