Saturday, November 8

নিউট্রিনো শনাক্ত করবে চীনের বিস্ময় চুনো নিউট্রিনো ডিটেক্টর

নাম তার চুনো। পুরো নাম চিয়াংমেন আন্ডারগ্রাউন্ড নিউট্রিনো অবজারভেটরি। সম্প্রতি চালু হওয়া চীনের অতিকায় এ গবেষণাগারটি মূলত একটি ডিটেক্টর। যার কাজ হলো সূক্ষ্মতম কণা নিউট্রিনো শনাক্ত করা। আর বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী এ নিউট্রিনো ডিটেক্টরটি পুরোপুরি মেড ইন চায়না।

আমরা শক্তিশালী টেলিস্কোপে যে মহাবিশ্ব দেখতে পাই, তা মূলত আসল মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ। এর বাইরেও আছে অসংখ্য অদৃশ্য কণা, শক্তি আর গোপন সব প্রক্রিয়া, যেগুলো বোঝা ছাড়া মহাবিশ্বকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আর এসব রহস্যময় কণার মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত কণাটির নাম নিউট্রিনো। বিজ্ঞানীমহলে এ কণাকে বলা হয় ভুতুড়ে কণা। কারণ, এই নিউট্রিনো প্রায় সব কিছুর ভেতর দিয়ে অনায়াসে চলে যেতে পারে। এমনভাবে এ কণা ছুটে বেড়ায়, যেন তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই।

china juno neutrino detector

চীনের কুয়াংতোং প্রদেশের কাইপিং এলাকায় নির্মিত হয়েছে চুনো। ভূ-পৃষ্ঠের ৭০০ মিটার গভীরে একটি পাহাড়ের নিচে স্থাপিত এই সুবিশাল গবেষণা কেন্দ্রটি ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানীদের নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে। কেননা, অচিরেই এটি খুলে দিতে পারে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন নতুন দুয়ার।

চীনের এই মহা গবেষণার সঙ্গে জড়িত আছে ১৭টি দেশের অন্তত ৭০০ জন বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী। ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিজ্ঞানীরা তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করেছেন।

চীনের তৈরি চুনোর প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে নিউট্রিনো নিয়ে কিছু তথ্য জানা যাক।

সহজে বলতে গেলে নিউট্রিনো হলো একটি মৌলিক কণা, মানে একে আর ভাগ করা যাবে না। ইলেকট্রন বা প্রোটনের মতো এর কোনো বৈদ্যুতিক চার্জ নেই। তবে একেবারে ভরশূন্য বলা যাবে না নিউট্রিনোকে। এর ভর বলতে গেলে শূন্যের কাছাকাছি। অর্থাৎ ভুতুড়ে বলা হলেও নিউট্রিনো কিন্তু মোটেও কাল্পনিক কিছু নয়। এই নিউট্রিনোর ভর বা পরিমাণ কতটুকু, সেটা বুঝতে গেলে সেটাকে তুলনা করতে হবে পরমাণুতে থাকা নেগেটিভ চার্জযুক্ত ইলেকট্রনের সঙ্গে। নিউট্রিনোর ভর হলো সেই ইলেকট্রনের দশ লাখ ভাগের এক ভাগ।

প্রতি সেকেন্ডে সূর্য থেকে অগণিত নিউট্রিনো ছুটে আসে পৃথিবীতে। আবার পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর, সুপারনোভা বিস্ফোরণ এবং পৃথিবীর ভেতরের নানা প্রক্রিয়াতেও তৈরি হয় নিউট্রিনো। নিউট্রিনোগুলো ছুটে বেড়ায় স্বাধীনভাবে। কোনো কণার সাতে পাঁচে নেই তারা। এই যে এখন অনুষ্ঠানটি শুনছেন বা পড়ছেন, ঠিক এই সময়ই আপনার শরীরের ভেতর দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০ লক্ষ কোটি নিউট্রিনো চলে যাচ্ছে, অথচ আপনি কিচ্ছু টের পাচ্ছেন না। এ কারণেই নিউট্রিনোকে ধরা বেশ কঠিন একটা কাজ। আর সেই কঠিন কাজটি সম্ভব করতে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নিউট্রিনো ডিটেক্টরটি তৈরি করেছে চীন।

এবার প্রশ্ন উঠতে পারে এই নিউট্রিনো শনাক্ত করার দরকারটা কী?

সংক্ষেপে কয়েকটি কারণ যদি বলতে হয়, তবে সবার আগে আসবে মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের প্রসঙ্গ। মহাবিশ্বে যত কণা আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো নিউট্রিনো। বিগ ব্যাং-এর ঠিক পরই প্রচুর নিউট্রিনো তৈরি হয়েছিল। সেই কসমিক নিউট্রিনো কিন্তু এখনো মহাশূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ কণা নিয়ে যত বেশি তথ্য জানা যাবে, ততই খুলতে থাকবে মহাবিশ্বের গোপন দরজা।

অন্যদিকে, সূর্যের ভেতরে যে পারমাণবিক বিক্রিয়া ঘটে তার সরাসরি প্রমাণ নিউট্রিনো। অর্থাৎ সূর্যের ভেতরকার রহস্য জানার একমাত্র জানালা হলো এই কণা। আবার কোনো নক্ষত্র বিস্ফোরিত হলে, যাকে আমরা সুপারনোভা বলি, সেটা থেকেও সবার আগে বেরিয়ে আসে নিউট্রিনো।

এবার শোনা যাক কীভাবে চীনের চুনো ডিটেক্টর শনাক্ত করবে নিউট্রিনো? কী আছে এতে?

২০০৮ সালে প্রথম চুনো প্রকল্পটির প্রস্তাব দেন চায়না একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর হাই এনার্জি ফিজিক্স ইনস্টিটিউট। ২০১৫ সালে শুরু হয় টানেল ও ল্যাবরেটরি নির্মাণ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ভূগর্ভস্থ ল্যাবরেটরির নির্মাণ শেষ হওয়ার পর শুরু হয় ডিটেক্টর স্থাপন।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ডিটেক্টর সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হয় এবং তাতে ভরা হয় অতি-বিশুদ্ধ পানি ও সিন্টিলেটর নামের বিশেষ এক প্রকার তরল।

চুনোর মূল অংশটি হলো এর বিশাল স্বচ্ছ গোলাকার ডিটেক্টর, যার ব্যাস ৩৫.৪ মিটার।

এর ভেতরে ভরা আছে ২০ হাজার টন তরল সিন্টিলেটর। এই সিন্টিলেটর হলো এক ধরনের স্বচ্ছ তরল যা সামান্য প্রতিক্রিয়াতেই আলোর কণা ফোটন তৈরি করতে পারে। এর চারপাশে বসানো হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার ফোটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব। অতি ক্ষুদ্র আলোও এ সেন্সরের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না।

পুরো সিস্টেমটি ডুবে আছে ৪৪ মিটার গভীর একটি বিশাল পানির পুলে, যার উপরে প্রাকৃতিক ফিল্টার হিসেবে আছে ৭০০ মিটারের গ্রানাইট শিলার স্তর। মানে, এই ডিটেক্টরে নিউট্রিনো ছাড়া আর কোনো কণার প্রবেশাধিকারই নেই।

যখন কোনো নিউট্রিনো ওই সিন্টিলেটর তরলে থাকা সূক্ষ্ম কণার সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটাবে, তখনই তৈরি হবে ছোট্ট এক ঝলক আলো তথা ফোটন। ওই ফোটন তাৎক্ষণিকভাবে ধরা পড়বে ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউবে। এরপর সেটা তৈরি করবে একটি বৈদ্যুতিক সংকেত। বিজ্ঞানীরা সেই সংকেত বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবেন নিউট্রিনোর শক্তি কতটুকু, কোন দিক থেকে এসেছে এবং এর ধরন কী।

এই ফাঁকে জেনে নেওয়া যায় যে, প্রকৃতিতে বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত তিন ধরনের নিউট্রিনোর অস্তিত্বের ব্যাপারে জানতে পেরেছেন। এগুলো হলো ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন নিউট্রিনো ও টাউ নিউট্রিনো। মজার ব্যাপার হলো, চলার পথে তারা এক ধরনের থেকে অন্য ধরনের হয়ে যেতে পারে।

চীনের চুনো নিউট্রিনো ডিটেক্টরের মেয়াদ ধরা হয়েছে ৩০ বছর। ২০৩০ সালের দিকে এতে আরও কিছু নতুন প্রযুক্তি যোগ করা হবে, যাতে করে গবেষকরা নিউট্রিনো গবেষণার অন্যতম বড় রহস্য—নিউট্রিনোলেস ডাবল বিটা ডিকে অনুসন্ধান করতে পারবেন এবং নিউট্রিনোর আসল ভর বের করার চেষ্টা করবেন।

নিউট্রিনো নিয়ে এটি কিন্তু চীনের প্রথম গবেষণা নয়। চুনোর আগে চীনের প্রথম প্রজন্মের নিউট্রিনো ডিটেক্টর ছিল তায়া বে নিউট্রিনো এক্সপেরিমেন্ট।

২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল তায়া বে। ওই ডিটেক্টর দিয়েই চীনা বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনোর তৃতীয় আচরণটি আবিষ্কার করেছিলেন, যে আবিষ্কারের সূত্র ধরে নিউট্রিনোর তিন ধরনের মিশ্রণ তত্ত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিলেন সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা।

২০১২ সালে, সায়েন্স ম্যাগাজিন ওই আবিষ্কারকে সেরা ১০ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের একটি হিসেবে ঘোষণা করেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!