মানুষ প্রথম সভ্য হয়েই গায়ে চাপিয়েছিল পোশাক। কিন্তু আজ থেকে সাড়ে আট হাজার বছর আগে প্রাচীন চীনে নতুন প্রস্তর যুগের একটি সমাধি খুঁড়ে যা পাওয়া গিয়েছিল তা দেখে অনেক ইতিহাসবিদের চোখ উঠে গিয়েছিল কপালে। ওই সময়ই চীনে রেশমের ব্যবহার ছিল বলে জানালেন প্রত্নতাত্তিকরা। পরে সেই রেশমের হাত ধরেই সারা বিশ্বের বস্ত্রশিল্পে আসে আধুনিকতা ও বিলাসিতার ছোঁয়া। কয়েক হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও রেশম তৈরির পদ্ধতিতে আসেনি কোনো পরিবর্তন। চীনের দেখানো পথে এখনও রেশমগুটি থেকেই তৈরি হচ্ছে দামি এ বস্তুটি।
সাড়ে আট হাজার হোক বা পাঁচ হাজার বছর হোক, চীনেই যে রেশমের জন্ম সেটার কথা লিখে গিয়েছিলেন স্বয়ং কনফুসিয়াস। এ ছাড়া আরও কিছু নথিপত্রেও দেখা যায়, পাঁচ হাজার বছর আগে চীনের কিংবদন্তীর হলুদ সম্রাট বা রাজা হুয়াংতির স্ত্রী সি লিং শিকে বলা হয় রেশম বা সিল্কের আবিষ্কর্তা।
সম্রাজ্ঞী সি লিং শির আরেক নাম লেইচু। তিনি কী করে সিল্কের কথা জানতে পারেন, তা নিয়ে প্রচলিত আছে মজার একটি গল্প। এক দিন বিকেলে একটি পাত্রে চা পান করছিলেন সম্রাজ্ঞী লেইচু। এ সময় তার চায়ে উড়ে এসে পড়ে একটি রেশমপোকার গুটি। গরম পানিতে গুটিটা পড়তেই সেটার ভেতরকার জৈবিক উপাদানগুলো ভেঙে চায়ের ভেতর ছড়াতে থাকে একটি পাতলা তন্তু। লেইচু তন্তুটি হাতে নিয়েই বুঝতে পারেন, এটি যেন তেন কিছু নয়। এরপর এমন আরও কিছু গুটি বা কোকুন সংগ্রহ করে পরীক্ষা শুরু করেন তিনি। সূক্ষ্ম ওই তন্তুটাকে পেঁচিয়ে রাখার জন্য বিশেষ একটি যন্ত্রও বানান তিনি। ওটাই হলো বিশ্বের প্রথম সিল্ক রিল। বা রেশম সুতা পেঁচানোর যন্ত্র।
এরপর একটি দুটি রেশমগুটির দিয়ে কাপড় বোনার মতো তন্তু হচ্ছিল না দেখে লেইচু তার স্বামী হুয়াংতিকে বলেন, তার কয়েকটি তুঁত গাছ চাই। কারণ তিনি দেখেছেন, বিশেষ জাতের ওই কীটটি শুধু মালবেরি বা তুঁত গাছের পাতা খায়। সেই থেকেই চীনে প্রচলন শুরু হয় রেশমের। আর চীনের শেখানো পথেই রেশম তৈরি হচ্ছে এখনও। তুঁতগাছের চাষ, রেশমগুটি থেকে সিল্ক তৈরি, এসব প্রক্রিয়াকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অজস্র কর্মসংস্থান।
এবার জানা যাক রেশম নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- শুরুর দিকে রেশম থেকে কাপড় তৈরির প্রক্রিয়া বেশ জটিল ছিল বলে ওই সময় এটি ছিল বেশ দামি একটি পণ্য। তাই প্রাচীন চীনে শুধু সম্রাট, তার পরিবার এবং উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সিল্কের পোশাক পরার অনুমতি ছিল। পরে ছিং রাজবংশের সময় এ নিয়ম শিথিল করা হয়।
- প্রাচীন চীনে রেশম এতটাই মূল্যবান ছিল যে কিছু সময়ের জন্য এটাকে মুদ্রা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। হান রাজবংশের সময়, কিছু সরকারি কর্মচারীর বেতন দেওয়া হতো রেশম দিয়ে। কৃষকরাও তাদের কর পরিশোধে শস্যের পাশাপাশি রেশম ব্যবহার করতো। এমনকি তখন কোনো কিছুর দাম পরিমাপের একক হিসেবেও রেশমের দৈর্ঘ্য ব্যবহার করা হতো।
- রেশম বেশ শক্তিশালী প্রাকৃতিক তন্তু। তাই পোশাক ছাড়াও এটি দিয়ে তৈরি হতো বাদ্যযন্ত্র, ধনুক, মাছ ধরার সুতা। কম খরচে কাগজ তৈরির আগে লেখালেখি ও ছবি আঁকার কাজেও লাগতো রেশম।
- একটি রেশমগুটি থেকে একটি লম্বা সুতা পাওয়া যায়, যার দৈর্ঘ্য দেড় কিলোমিটারও হতে পারে।
চীন থেকে কী করে অন্যরা পেল রেশমের ফর্মুলা? আবিষ্কারের পর অন্তত এক হাজার বছর সিল্ক তৈরির ফর্মুলাটি ছিল অতিগোপনীয়। পরে অবশ্য কিছু হাত ঘুরে রেশমের রেসিপি চলে যায় ভারতসহ ভূমধ্যসাগরীয় কিছু দেশে। ইউরোপে সিল্ক আসে তুলনামূলক বেশ দেরিতে। দেড় হাজার বছর আগে বাইজেনটাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের আমলে কয়েকজন নেস্তোরিয়ান সন্নাসী এসেছিলেন চীনে। তারাই গোপনে চীন থেকে নিয়ে যান রেশমগুটি। আর রেশমগুটি পাচার করতে তারা ব্যবহার করেছিলেন ফাঁপা বাঁশের নল। এভাবেই সিল্ক সম্পর্কে জানতে পারে ইউরোপীয়রা।
কিন্তু রেশমের এত কদর কেন? কেনই বা চীনের এ আবিষ্কারের জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছিল বাকি বিশ্ব? প্রথমত, রেশমের কাপড় প্রাকৃতিকভাবে তৈরি তন্তুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। আভিজাত্য প্রকাশ ও বাণিজ্যিক উপকরণ হিসেবে রেশম ছিল অন্যতম সেরা একটি উপকরণ। তবে আরও কিছু কারণও আছে। চলুন শুনি।
- রেশমকে বলা হয় হাইপোএলার্জেনিক। ত্বক যতই স্পর্শকাতর হোক না কেন, রেশমের স্পর্শে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে না।
- রেশম আপনাকে মশা থেকেও বাঁচাতে পারবে। রেশম মসৃণ ও পাতলা হলেও এর ভেতর দিয়ে মশা হুল ফোটাতে পারে না।
- প্রাকৃতিক অ্যান্টি-মাইক্রোবায়াল হিসেবেও কাজ করে রেশম। এর স্পর্শে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক বেড়ে উঠতে পারে না।
- কিছু বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, সিল্কের বালিশে মুখ রেখে ঘুমালে মুখে বলিরেখা সহজে পড়বে না। সিল্কে থাকা প্রাকৃতিক অ্যামিনো অ্যাসিডের কারণেই এমনটা হয়।
- রেশমের আরেকটি বড় গুণ হলো এটি প্রাকৃতিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রকের কাজ করে। শীতের সময় শরীরকে গরম ও গরমের সময় শীতল রাখতে পারে সিল্ক।
এবার জেনে নেওয়া যাক চীনের রেশম বাণিজ্যের হালচাল। বিশ্বে সিল্কের উৎপাদন ও রপ্তানি দুটোতেই শীর্ষে আছে চীন। গত বছর চীন থেকে রেশম রপ্তানি হয়েছিল প্রায় ৮০ কোটি ডলার মূল্যের। চীনের চিয়াংশু প্রদেশের সুচৌ শহরকে বলা হয় রেশমের রাজধানী। সেখানে একই সঙ্গে রেশমপোকার চাষ থেকে শুরু করে, রেশমগুটি সংগ্রহ, সিল্ক উৎপাদন ও বুননের সমস্ত কাজই হয়।
গড়ে এখন বছরে চীনে সিল্ক তৈরি হয় প্রায় দেড় লাখ টন। যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৭০ ভাগ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারতে উৎপাদিত হয় গড়ে ৩০ হাজার টন। তবে রেশমের উৎপাদন সারা বছর একই রকম থাকে না। এটি নির্ভর করে রেশমগুটির মৌসুমের ওপর। বিশেষ করে মে’র শেষের দিকে রেশমপোকার গুটি তৈরি হয়। চিয়াংশুর পাশাপাশি ওই সময় চেচিংয়াং ও সিছুয়ানেও শুরু হয় রেশমগুটি পালনের কাজ।
চীনের সুবিশাল ঐতিহ্য সিল্ক। আবার এই রেশমের হাত ধরেও চীনে গড়ে উঠেছে আরও কিছু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সিল্কের ওপর ধর্মীয় ছবি এঁকে চীনের সিচাংয়ে তৈরি হয় বিশেষ চিত্রকর্ম থাংকা, যা কিনা তিব্বতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আছে।
সূত্র: সিএমজি