হাজার বছর আগের কাগজ ও চা থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার দিয়াশলাই ও ভূমিকম্পের মাত্রা শনাক্তকারী যন্ত্র সিসমোগ্রাফের কথা।
আগুন আবিষ্কারের পর থেকেই বলা যায় সভ্য হয়েছে মানুষ, পেয়েছে নিরাপত্তা এবং নতুন নতুন খাবারের সন্ধান। আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে আদি ও অকৃত্রিম এই আগুন কিন্তু চাই। এখন বেশ সহজ হলেও সভ্যতার শুরু থেকে মাত্র কয়েকশ বছর আগেও কিন্তু আগুন জ্বালাতে সত্যিকার অর্থেই কাঠখড় নিয়ে বেশ কুস্তি লড়তে হতো মানুষকে। আর সেই ঝামেলা থেকে বাঁচাতে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে প্রথম দিয়াশলাই তৈরি করে মানুষ। সভ্যতা পায় এক নতুন গতি। সহজে যখন তখন প্রয়োজন হওয়া মাত্রই আগুন জ্বালানোর সেই কাঙ্ক্ষিত দিয়াশলাই কিন্তু পুরোপুরি মেড ইন চায়না।
খ্রিস্টাব্দ ৫৭৭ সালে চীনে যখন পাঁচ রাজবংশের শাসন চলছিল তখনই আবিষ্কার হয় দিয়াশলাই। আর এ কথা লিখে গিয়েছিলেন চতুর্দশ শতকের চীনা লেখক ছো খেং লু । তার লেখনিতে জানা যায়, ওই সময় চীনা লণ্ঠনে আগুন জ্বালাতে কেউ কেউ ব্যবহার করতো পাইনউড কাঠের তৈরি লম্বা শলাকা। ওই শলাকার মাথায় লাগানো থাকতো সালফার। যে সালফারটিকে কাঠিতে লাগানোর পর শুকানো হলে সেটা কাঠিতেই লেগে থাকতো। পরে সামান্য উত্তাপেই ঝলসে উঠতো ওটা।
কালক্রমে আরও কিছু চীনা গবেষকের হাত ঘুরে অবশেষে আজকের আধুনিক রূপে আবির্ভূত হয় চীনের আবিষ্কার ম্যাচবক্স বা দিয়াশলাই। এখন বিশ্বে বছরে প্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি দিয়াশলাই।
প্রাচীন চীনা সাহিত্যেও দিয়াশলাইয়ের কথা উল্লেখ রয়েছে। ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি, থাও কু নামক একজন লেখক তার রেকর্ডস অব দ্য আনওয়াল্র্ডলি অ্যান্ড দ্য স্ট্রেঞ্জ গ্রন্থে ম্যাচবাক্সের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এটিকে ‘আগুন বহনকারী দাস’ নামে অভিহিত করেন এবং পরবর্তীতে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ফায়ার ইঞ্চি স্টিক বা আগুনের এক ইঞ্চি কাঠি।
থাও কু লিখেছিলেন ‘রাতে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত আলো জ্বালানোর জন্য এই কাঠিগুলো অসাধারণ এক সমাধান হিসেবে কাজ করত। সামান্য আগুন লাগালেই এটি জ্বলে উঠত এবং শস্যদানার মতো শিখা তৈরি করতো।
তার এ বর্ণনা এখনকার দিয়াশলাইয়ের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।
১২৭০ খ্রিস্টাব্দের চীনা বই উ লিন ছিউ শি’তে হাংচৌ শহরের বাজারে সালফার দিয়ে বানানো ম্যাচ বা দিয়াশলাই বিক্রির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সময় দিয়াশলাইকে ফা ছু বা শুই নামে ডাকা হতো। চীনে এসে সেই দিয়াশলাই দেখতে পেয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত ভ্রমণচারী মার্কো পোলো।
১৫৩০ সালের দিকে ইউরোপে বিভিন্ন ধরনের দিয়াশলাই প্রস্তুতের ধুম পড়ে। ১৮০৫ সালে জিন চ্যান্সেল নামের এক ব্যক্তি প্রথম আধুনিক দিয়াশলাই আবিষ্কার করেন। ম্যাচের সামনের অংশে পটাশিয়াম ক্লোরেট, সালফার, চিনি ও রাবারের দ্রবণ ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তবে ছিল না ঘষা দেওয়ার মতো কোনো বিশেষ কাগজ। ওই সময় ছোট একটি বোতলে সালফিউরিক এসিডের দ্রবণে প্রবেশ করালেই জ্বলে উঠতে ম্যাচের কাঠি। তার এ ধরনের দিয়াশলাইয়ের ধারণা চ্যান্সেল পেয়েছিলেন মূলত চীনাদের কাছ থেকেই।
লাইটার আবিষ্কারের পরও দিয়াশলাইয়ের প্রতি মানুষের কাজ করে এক অন্যরকম আবেগ। আর তাই অনেকেই আছেন যারা কিনা ডাকটিকিট ও মুদ্রার মতো নানা দেশের নানা ধরনের দিয়াশলাইয়ের কাভার সংগ্রহ করে থাকেন। এর চল শুরু হয় ১৯৪৩ সাল থেকে। যারা শখের বশে দিয়াশলাই সংগ্রহ করেন তাদের বলা হয় হয় ফিলুমেনিস্ট।
চীনের প্রাচীন ইতিহাসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আরেক অনবদ্য নিদর্শন হলো ভূকম্পন নির্দেশক যন্ত্র বা সিসমোগ্রাফ। ১৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সিসমোগ্রাফ বা সিসমোস্কোপ তৈরি করেছিলেন চীনের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ চাং হ্যং। এটি শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাসেই নয়, বরং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে চীনকে বিশাল এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল।
চাং হ্যং তার সিসমোগ্রাফটি তৈরি করেছিলেন কিছু প্রযুক্তিগত ধারণার ওপর ভিত্তি করে। প্রাচীন চীনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দ্রুত সতর্কতা প্রদান এবং সাহায্য ব্যবস্থা সক্রিয় করার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সিসমোগ্রাফটি একটি বৃহৎ ব্রোঞ্জের পাত্র ছিল, যার চারপাশে কম্পাসের আটটি দিক বরাবর আটটি ড্রাগনের মাথা স্থাপন করা ছিল। প্রতিটি ড্রাগনের মুখে একটি ব্রোঞ্জের বল ছিল, এবং প্রতিটি ড্রাগনের নিচে একটি ব্যাঙ ছিল যার মুখ খোলা।
কীভাবে কাজ করতো চাং হ্যংয়ের সিসমোগ্রাফ? নথিপত্র ও নকশা ঘেঁটে দেখা যায়, এটি চিল একটি বড় সিলিন্ডারের মতো পাত্র। এর ভেতরে ছিল একটি দোলক। এটি অতি সামান্য কম্পনও শনাক্ত করতে পারে। ভূমিকম্প হলে ওটা নড়াচড়া করত জোরে। ওই নড়চাড়ায় একটি ধাতব ড্রাগনের মুখ থেকে পড়ে যেত একটি করে ব্রোঞ্জের তৈরি বল। ওই বলটি নিচে গড়িয়ে পড়তো আরেকটি ধাতব ব্যাঙের খোলা মুখে। এতে তৈরি হতো শব্দ আর সতর্ক হতো মানুষ। যেত কোন ড্রাগনের মুখ থেকে পড়েছে তা দেখে বোঝা যেত ভূকম্পনের দিক, আজকের দিনে যেটাকে বলা হয় আর্থকোয়েক এপিসেন্টার।
চীনা বিজ্ঞানীর তৈরি ওই সিসমোগ্রাফটি ৪০০ মাইল দূরের ভূমিকম্পও শনাক্ত করতে পারত বলে জানা যায়।
এই বল পড়ার দিক থেকেই বোঝা যেত ভূমিকম্প কোন দিক থেকে আসছে। এটি ছিল এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি, যা দূরবর্তী ভূমিকম্পের দিক নির্দেশ করতে সক্ষম ছিল।
চাং হ্যং-এর সিসমোগ্রাফ প্রথমবার ব্যবহৃত হয় খ্রিস্টাব্দ ১৩৮ সালে, যখন চীনের একটি শহরে ভূমিকম্প ঘটে। যন্ত্রটি দূরবর্তী এই কম্পনের দিক সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিল।
চাং হ্যং তার এই যন্ত্রের জন্য তৎকালীন যুগের জ্ঞান, যেমন কম্পন তরঙ্গ এবং মাধ্যাকর্ষণ বলের ধারণা ব্যবহার করেন। যদিও আধুনিক সিসমোগ্রাফের তুলনায় এটি ছিল অনেকটাই সাধারণ, তবে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে ওটা ছিল বেশ উন্নত এক প্রযুক্তি।
সিসমোগ্রাফের মাধ্যমে চীন প্রাচীনকালেই ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থার সূচনা করেছিল। এটি চীনা রাজপরিবার এবং প্রশাসনকে ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম দ্রুত শুরু করতেও সাহায্য করত।
আধুনিক সিসমোগ্রাফের ভিত্তি স্থাপন করেছিল চাংয়ের ওই উদ্ভাবন। বর্তমানের উন্নত যন্ত্রগুলো আরও নির্ভুলভাবে ভূমিকম্পের মাত্রা, দিক এবং গভীরতা পরিমাপ করতে সক্ষম, তবে এর প্রাথমিক ধারণা আসে প্রাচীন চীনের এই সিসমোগ্রাফ থেকেই।
চাং হ্যংয়ের সিসমোগ্রাফ প্রমাণ করে, প্রাচীন চীনের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি কীভাবে মানবকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাসে চীনের অগ্রগতি এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতারও চমৎকার উদাহরণ।
সিএমজি বাংলা