পরীক্ষার প্রশ্ন ও নোট বই দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় এক বছর আগেই নুসরাত জাহান রাফিকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিলেন মাদরাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা। সেই প্রলোভনে সাড়া না দেওয়ায় রাফিকে হয়রানি করতেন সিরাজ। চার মাস আগে এক সহপাঠীর ঘটনা জানার পর তাকে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল রাফি। রাফি হত্যার ঘটনা দেশব্যাপী আলোচিত হওয়ায় সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা সিরাজের অপকর্মের ব্যাপারে মুখ খুলতে শুরু করেছে।
অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদরাসার ভেতরে ছাত্রীদের নিপীড়ন করার অনেক ঘটনাই দেখেছে কর্মীরা। অভিযোগ ওঠায় ধামাচাপা দিতে শিক্ষকদের উল্টো ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শোকজ করেন তিনি।
ভুক্তভোগীরা জানান, যৌন হয়রানির অভিযোগ ছাড়াও সনদ জালিয়াতি এবং ফেনীর উম্মল ক্বোরা দাখিল মাদরাসার সম্পদ বিক্রি করে প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আছে সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে। আত্মসাতের টাকায় ফেনী শহরের হাজি মাকসুদুর রহমান সড়কে ‘ফেরদৌসী মঞ্জিল’ নামে বাড়িও বানিয়েছেন তিনি।
এদিকে রাফিকে নিপীড়ন এবং হত্যাচেষ্টার ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি এখনো তদন্ত শেষ করতে পারেনি। গতকাল বৃহস্পতিবারও কমিটির সদস্যরা মাদরাসায় গিয়ে রাফির সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তদন্ত কমিটির প্রধান ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পি কে এম এনামুল করিম সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সভাপতির দায়িত্বেও আছেন। তিনি গতকাল বলেন, তিন দিনে তদন্তকাজ শেষ করার কথা থাকলেও কাজের কারণে সময় বাড়ানো হচ্ছে। এখনো কাজ চলছে।
রাফির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ও সহপাঠী নাসরিন সুলতানা ফুর্তি গতকাল বলে, ‘এক বছর আগে আমরা যখন প্রথম বর্ষে পড়ি তখন একদিন প্রিন্সিপাল হুজুর রাফিকে রুমে ডেকে কুপ্রস্তাব দেয়। তখন ও ভয়ে বের হয়ে যায়। কাউকে কিছু বলেনি। চার-পাঁচ মাস আগে আমার সঙ্গেও খারাপ আচরণ করে। তখন ও সেই ঘটনা জানায়। আমরা আগেও তার ব্যাপারে খারাপ কথা শুনেছি। সে একজনের বেশি ছাত্রীকে রুমে ঢোকাত না। এ কারণে আমরা সাবধান থাকতাম। একা কেউ যেতাম না। একজন ভেতরে ঢুকলে কয়েকজন বাইরে থাকতাম।’
হয়রানির ব্যাপারে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার আরবি বিষয়ের প্রভাষক মাওলানা আবুল কাসেম বলেন, ‘ছাত্রী নিপীড়নের বিষয়টি আমরা বিভিন্ন সময় শুনেছি। আমরা যখনই কোনো পদক্ষেপ নিতে গেছি তখনই আমাদের মুখ বন্ধ করতে উল্টো ষড়যন্ত্রের দায় চাপিয়ে দেন। অন্য লোক অভিযোগ করলেও তিনি সন্দেহ করে পরিচালনা কমিটির তিন শিক্ষক প্রতিনিধিকে (টিআর) শোকজও করেন।’
আবুল কাসেম বলেন, পূর্ব বড়ধলী মদিনাতুল উলুম দাখিল মাদরাসার সুপার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার ঘনিষ্ঠ। তাঁর মেয়েও রাফিদের সঙ্গে এবার আলিম পরীক্ষা দিচ্ছে। গত বছরের অক্টোবর মাসে এক দিন তাঁর কাছে গিয়ে সিরাজুল ইসলাম জানান, তাঁর মেয়েকে কক্ষে ডেকে যৌন নিপীড়ন চালিয়েছেন অধ্যক্ষ সিরাজ। সিরাজুল ইসলাম মাদরাসা পরিচালনা কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি (টিআর) কাসেম, বেলায়েত হোসেন ও হাসান আহমেদকে নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজকে এ ব্যাপারে জেরা করতে চান। তখন কাসেম বিষয়টি এড়িয়ে তাঁকে একাই যেতে বলেন। এর কিছুদিন পর মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতির কাছে অধ্যক্ষ সিরাজের এই কুকীর্তির ব্যাপারে বেনামে একটি লিখিত অভিযোগ করা হয়। এর অনুলিপি শিক্ষক প্রতিনিধি কাসেমের কাছে ডাকযোগে যায়। পরে যখন বিষয়টি পরিচালনা কমিটির সভায় অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়, তখন অধ্যক্ষ সিরাজ দাবি করেন, মেয়ের পরিবার এই অভিযোগ দেয়নি। তিন শিক্ষক নিজেরা মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন। ওই ঘটনায় তিন শিক্ষক প্রতিনিধিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। শিক্ষকরা কাজটি করেননি বলে নোটিশের জবাব দিলে পুরো বিষয়টিই চাপা পড়ে।
পূর্ব বড়ধলী মদিনাতুল উলুম দাখিল মাদরাসার সুপার সিরাজুল চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার মেয়ে বাসায় গিয়ে কান্না করছিল। আমি শিক্ষকদের নিয়ে তাঁর (অধ্যক্ষ সিরাজ) কাছে যেতে চাইলে ওরা রাজি হয়নি। একাই গিয়ে বললাম, আপনি আমার মেয়ের সঙ্গে এমন কাজ ক্যামনে করলেন? তিনি অস্বীকার করলে বলি, মেয়েকে ডেকে তাহলে ভয়টা কাটিয়ে দেন। তাও সে রাজি হয়নি। পরে শুনি কেউ অভিযোগ দিয়েছে। আমি না দিলেও ঘটনা সত্য ছিল। রাফির ঘটনায় তার সঙ্গে অন্য মেয়েরা যায়, কারণ ওরা জানত। বাচ্চারা এসব জানত বলে ভয় পেত।’
সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার নিরাপত্তাকর্মী মো. মোস্তফা বলেন, ‘ভয়ে কখনো মুখ খুলিনি। এর পরও সন্দেহ করে আমাকে চাকরি থেকে বাদ দিতে চাইছিল সে (অধ্যক্ষ)। আগে যখন পুরনো ভবনে তার অফিস ছিল সেখানে দুটি ছাত্রীর সঙ্গে তাকে জোর করে জড়াজড়ি করতে দেখি। যেদিন নতুন ভবনে অফিস উদ্বোধন, সেদিনও দেখি আরেকটা মেয়েরে ধরেছে। আমি শুধু দু-একজন হুজুরকে (শিক্ষক) বলেছি। এরপর সন্দেহ কইরা আমারে চাকরি থেকে বাদ দিতে চাইছিল। ভয় দেখিয়ে বলছিল, পাথরের সঙ্গে কপাল ঘষলে কি হয় জানিস?’
জালিয়াতির টাকায় অধ্যক্ষের বাড়ি ফেনী শহরে : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেনীর উম্মল ক্বোরা দাখিল মাদরাসার সম্পদ বিক্রি করে প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন সিরাজ উদ দৌলা। ওই ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মামলা হয়। আত্মসাতের টাকায় ফেনী শহরের হাজি মাকসুদুর রহমান সড়কে ‘ফেরদৌসী মঞ্জিল’ নামে বাড়িও করেছেন তিনি।
ফেনীর হাজি মাকসুদুর রহমান সড়কে উম্মল ক্বোরা দাখিল মাদরাসা ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের এক কোটি ৩৯ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ২০১৭ সালে মামলা করেছিলেন অংশীদাররা। ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কাইয়ুম ভুইয়া নিশান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাদরাসার টাকা মেরে তিনি (সিরাজ) ওই এলাকায় ফেরদৌসী মঞ্জিল নামে আলিশান বাড়ি করেছেন। অডিটে টাকা আত্মসাতের বিষয়টি ধরা পড়লে সাহস করে আমি মামলা করি। এ মামলায় তিনি জেলেও গেছেন। মামলা এখনো চলছে।’
অধ্যক্ষের অভিজ্ঞতার সনদ জালিয়াতি : জানা যায়, ২০০০ সালের ১ জুন সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের সময় সিরাজ আগে দুটি দাখিল মাদরাসায় চাকরি করেও আলিম মাদরাসায় চাকরির ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদপত্র জমা দেন। তিনি ফেনীর ধলিয়ার মমতাজ মিয়ার হাটের দৌলতপুর সালামতিয়া দাখিল মাদরাসাকে এবং নোয়াখালীর রঙমালা দাখিল মাদরাসাকে ফাজিল মাদরাসা দেখিয়ে ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ জমা দেন। এতে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সিলসহ প্রতিস্বাক্ষর জাল করেন। পরে এ বিষয়টি আলোচনায় উঠলেও প্রভাব খাটিয়ে ধামাচাপা দেন।
অধ্যক্ষের বিচার চান সবাই। অধ্যক্ষের অধ্যক্ষের অধ্যক্ষের
https://www.youtube.com/watch?v=AoO_iZhlnGs&fbclid=IwAR1fD4b0LralvLbo1wgWICRX_AsImAZQRl6QvyZoW8sSCHiMGgi0tL_3Iyo