Friday, April 26
Shadow

প্রসঙ্গ গুলিস্তানে বিস্ফোরণ : ঢাকা যেন মৃত্যুকূপ

২০১৬ সালের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৭২ হাজার। ছয় বছরে হাতেগোনা কিছু ভবন ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে সাইনবোর্ড লাগানো ছাড়া ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ দুর্যোগের বিপর্যয় এড়াতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার ভূকম্পন হলে দুই কোটির বেশি মানুষের এই নগরীতে দেখা দিতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। এ তো গেল প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা; কিন্তু মানবসৃষ্ট বিপদের শেষ নেই ৪০০ বছরের বেশি প্রাচীন এ শহরে। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় বিপদের শঙ্কা। পুরো শহর যেন একটি মৃত্যুপুরী; অন্তত গত রোববার সায়েন্সল্যাব ও মঙ্গলবার গুলিস্তানে ভবনে বিস্ফোরণের পর এমন দাবি করাই যায়। এসব দুর্ঘটনার চিত্রে দেখা গেছে, ভবনের বিস্ফোরণে পথচারী মানুষজনও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন। এসি, গ্যাস সিলিন্ডার, স্যুয়ারেজ লাইনে জমে থাকা গ্যাস ডেকে আনছে বড় বড় বিপদ।

গুলিস্তানে বিস্ফোরণ ঢাকা

তবে এখানেই শেষ নয়। এ শহরের পথে পথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। ভবন নির্মাণ ও স্যুয়ারেজ লাইন পরিষ্কারের মতো কাজে নির্বিচারে মরছে শ্রমিক। ঝড়-বৃষ্টি হলে গাছ পড়েও মারা যাচ্ছে মানুষ। বায়ু ও শব্দদূষণে জটিল নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। শহরের উন্নয়ন স্থাপনার গার্ডার ধসেও প্রাণ যাচ্ছে পথচারীদের। সব মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ২০ ধরনের বিপদের মুখে এ শহরের নাগরিক জীবন।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীতে গ্যাসলাইন থেকে দুর্ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। লাইনের লিকেজ থেকে কোথাও গ্যাস জমাট বাঁধলে মশা মারার ব্যাট ব্যবহারের সময় অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।

রাজধানীর ভবনগুলো কেন এতটা দুঘর্টনাপ্রবণ—এমন প্রশ্নে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ বলছে, নিয়ম না মেনে ভবন তৈরি, অনিরাপদ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ, ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ মেরামত না করাসহ ভবনের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকাই চলমান দুর্ঘটনার মূল কারণ।

২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে বিপদগ্রস্ত মানুষের লাফিয়ে মৃত্যুর ঘটনা কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এ ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরও আগে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ২০১০ সালের ৩ জুন কেমিক্যালের গোডাউন থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ জনের মত্যু হয়। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন মারা যায়।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ২৩৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু গোটা বিশ্বের মানুষকে কাঁদিয়েছে। ২০১০ সালের ২ জুন তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ী এলাকায় একটি অনুমোদনহীন ভবন ভেঙে ২৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে ভবন ভেঙে দুজনের মৃত্যু হয়। ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজারে একটি ভবনের নিচে পাইপলাইনে জমে থাকা গ্যাসের কারণে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এতে ৮ জনের মৃত্যু হয়।

সর্বশেষ গত রোববার সায়েন্সল্যাব এলাকায় স্যুয়ারেজের লাইনে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণে একটি তিনতলা ভবন ধসে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশপাশের ভবনগুলোও। এক দিন পর মঙ্গলবার গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে ভবন বিস্ফোরণে ২০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। গেল দুই সপ্তাহে অন্তত রাজধানীর পাঁচটি বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বছরে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার ভবনের অনুমোদন দেয়; কিন্তু গড়ে প্রতিবছর ৯০ হাজারের বেশি ভবন তৈরি হচ্ছে। তাহলে বাকিটা কীভাবে হচ্ছে? তাই যারা ভবন তৈরি করছেন, তাদের অনুরোধ করব, বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুযায়ী যেন তৈরি করেন।’

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ঢাকা এখন টাইমবোমায় পরিণত হয়েছে। যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় বিপর্যয়। আর এ জন্য সেবা সংস্থাগুলোর দায়িত্বে অবহেলা ও জনগণের অসচেতনতাই দায়ী।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ কালবেলাকে বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জনসচেতনতার অভাব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে কাজ না করায় দিন দিন নগরে ঝুঁকি বাড়ছে।

লাইনে গ্যাস যেন কোনোভাবেই জমা না হতে পারে, এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, নিয়মিত গ্যাসের লাইন পরিষ্কার করা উচিত। অথচ লাইনের দায়িত্বে যারা আছেন, তারা তা করছেন না। নিজ থেকেও গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির লাইন নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক রাখা উচিত।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, নগরীতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হচ্ছে গ্যাসলাইন থেকে। গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকেও মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে নগর ও পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘রাজধানী ঢাকা একটি টাইমবোমার মতো বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ভূমিকম্পের পর অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। কারণ, অসংখ্য গ্যাসলাইন নগরীর তলদেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে তার নকশাও নেই। তারা জানেও না কোথায় কোথায় গ্যাসলাইন রয়েছে। আবার সেগুলোর সংস্কারও করা হচ্ছে না।

রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি গ্যাসলাইন দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা কালবেলাকে বলেন, আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প-কারখানায় গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। কোথাও গ্যাস জমে থাকার পর যদি মশার মারার ব্যাটও ব্যবহার করা হয়, তাহলে আগুন লেগে যেতে পারে। এ ছাড়া স্যুয়ারেজ লাইনে মিথেন গ্যাস জমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে।

প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুটি দুর্যোগের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মাকসুদ হেলালি কালবেলাকে বলেন, মানুষের তৈরি দুর্যোগ আধুনিক সভ্যতার অংশ। সময়ের কারণে আগুনের ব্যবহার বাড়বে। এজন্য সবাইকে সতর্ক হয়ে ব্যবহার করতে হবে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা ছাড়া রাজধানীতে চলমান দুর্ঘটনাগুলো প্রতিরোধ সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট এই নগরবিদ।

ক্ষতি প্রতিরোধে ভূমিকম্প সহায়ক ও বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণের পরামর্শ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও নগরবিদ ড. নূরুল ইসলাম নাজেম কালবেলাকে বলেন, জরাজীর্ণ ভবনগুলোর কারণে ভূমিকম্প হলে সাংঘাতিক ক্ষয়ক্ষতি হবে। কাজেই এ ব্যাপারে আগাম করণীয় ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা আইন মেনে কিছু করি না। যারা আইন মানাবে তারাও উদাসীন। নাগরিক সুরক্ষায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশনের কাজ অনেক। তারা তা পালন করছে না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ৪৬৮টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ২০১৭ সালে ঘটেছে ৫১টি।

ফায়ার সার্ভিসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে পুকুর, ডোবা, খাল, হাওর ও নদীপথে রাজধানীতে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৭৬০টি।

এদিকে, রাজধানীর বায়দূষণও ক্রমাগত ভয়ংকর হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালে কেবল জানুয়ারি মাসেই ২০ দিন ছিল ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’-এর তালিকায়। বায়ু ও শব্দদূষণের দিক থেকে ঢাকা এখন বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমোসফিয়ারিক পল্যুশন স্টাডিজের (সিএপিএস) উপাত্ত অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণ বছরের প্রথম মাসেই গত বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার গড় একিউআই ছিল ২২১, যেখানে ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে ২৮১ তে এসেছে।

২০২২ সালে করা বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার ৪০ ভাগ দূষণ হয় শহরের ভেতরে হওয়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণে। বাকি ৬০ ভাগ দূষণ পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর প্রভাবে। গবেষণায় দূষণের উৎসও উল্লেখ করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে যানবাহন, কারখানা, ইটের ভাটা, পাওয়ারপ্লান্ট, কাঁচা রাস্তা এবং নির্মাণাধীন এলাকা।

২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল দেশ। তখন আতঙ্কেই মারা যান ৬ জন। গত ১৫ বছরে ছোট-বড় ভূমিকম্প হয়েছে ১৪১ বার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারি বলেন, গত দু-তিন বছরে দেশে ভূমিকম্প অনেক বেড়েছে। আবার ১০০ বছরের মধ্যে আমাদের এখানে তেমন বড় ভূমিকম্প হয়নি। এটি আতঙ্কের বিষয়। তার মানে, ছোট এসব কম্পন শক্তি সঞ্চয় করছে। ফলে সামনে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা আছে। তুরস্কে যে ভূমিকম্প হয়েছে, এর চেয়ে ছোট, অর্থাৎ, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো প্রয়োজন। ভবন তৈরির পাশাপাশি ভবনে ফলস সিলিং, অতিরিক্ত আসবাব দিয়ে সাজানো ফ্যাশন হয়ে গেছে। দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে চাইলে এ বিষয়গুলোতে সচেতন থাকতে হবে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবদুল লতিফ হেলালী বলেন, ক্ষতি কমাতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলা এবং যেগুলো সংস্কারযোগ্য, তা সংস্কার করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!